আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বিংশ শতাব্দীর মার্কিন কূটনীতিক দ্বিতীয় অ্যাডলাই ই. স্টিভেনসন। বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ ও কথার জন্য সুপরিচিত এই প্রাক্তন ইলিনয় গভর্নরের একটি উক্তি বেশ বিখ্যাত: “আমেরিকায় যে কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারে। এই ঝুঁকিটা তোমাকে নিতেই হবে” (In America, anybody can be president. That’s one of the risks you take.)। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই উক্তিটি গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বারবার ঘুরে ফিরছে।
৮ নভেম্বরের নির্বাচনে মার্কিন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প। জনগণের ভোটে হিলারি এগিয়ে থাকলেও ইলেকটোরাল কলেজের ভোট ট্রাম্পের পক্ষে বেশি পড়ায় তিনি জিতে যান। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে হওয়া নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতে কোন ‘তন্ত্র’টি আসতে যাচ্ছে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই।
একনায়কত্ব প্রিয়তা
গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত এই রাষ্ট্রপ্রধান স্বৈরতন্ত্র ও একনায়ক হিসেবে পরিচিতদের খুব পছন্দ করেন এবং নিয়মিতভাবে প্রকাশ্যে তাদের প্রশংসাও করেছেন। পাশাপাশি নিজ দেশের নেতাদের নিয়ে উপহাসও করেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি নিজের দেশ পরিচালনা করছেন। তিনি একজন নেতা, অন্তত আমাদের দেশে যেমন আছে তেমন না। নর্থ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনকে নিয়ে বলেছেন, “তাকে কৃতিত্বটুকু দিতেই হবে। তিনি যান, দখল করেন, নেতা হয়ে যান। অসাধারণ একটা ব্যাপার।” আর ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের প্রশংসা করে বলেন, “তিনি সন্ত্রাসীদের মেরেছেন কাজটা তিনি কত ভালোভাবে করেছেন। তার সরকার সন্ত্রাসীদের তাদের অধিকার পড়ে শোনায়নি!”
একনায়কদের ভালো লাগাটা এখানে মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো, ট্রাম্পের ভালো লাগে ‘একনায়কত্ব’। সবকিছুর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রহী ব্যক্তি এবার হলেন গণতন্ত্রের কথা বলা একটি দেশের গণতান্ত্রিক নেতা।
সহিংসতায় ও বৈষম্যে আগ্রহী
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী র্যালিতে, বিতর্কে, ভাষণে বারবার মার্কিন সরকার ব্যবস্থাকে আরও কঠোর করার কথা বলেছেন। টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হলে প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারিকে জেলে পুরবেন তিনি। মানহানি আইন কঠোর করা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কমানো ছাড়াও নির্বাচনের আগে গেটিসবার্গে দেয়া এক বক্তৃতায় ট্রাম্প জানান, তার বিরুদ্ধে যারা যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন, ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম ১শ’ দিনের মধ্যেই সেই সব নারীর বিরুদ্ধে তিনি মামলা করবেন।
প্রচারণা র্যালিতে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালানোর জন্য ট্রাম্প তার সমর্থকদের উৎসাহ দিয়েছেন। এমনকি বলেছেন এ কারণে সমর্থকরা গ্রেফতার হলেও ট্রাম্প তাদের বের করে আনবেন। সেই ট্রাম্প জয়ের পর তার বিরুদ্ধে হওয়া আন্দোলনকে ‘অন্যায়’ বলেছেন। নির্বাচনে নিজে জয়ী না হলে ফলাফল মানবেন না বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এবং বিশ্বশান্তির কথা বলে আসা যুক্তরাষ্ট্র এমন এক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেছে যিনি আমেরিকান নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও একজন বিচারককে তার মেক্সিকান ঐতিহ্যের জন্য তিরস্কার করেছেন। প্রকাশ্যে বলেছেন, সেলিব্রেটি হলে নারীকে যেভাবে খুশি ব্যবহার করা যায়। এমনকি ন্যাটো ভাঙ্গার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সৌদি আরব ও জাপানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতেও উৎসাহ দিয়েছেন। আর এ সবই তিনি করেছেন নির্বাচনের আগে।
তারপরও ট্রাম্প
অথচ সবকিছুর পরও ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ট্রাম্প। অবশ্য সংবিধান অনুসারে, জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত ইলেকটোরাল কলেজের সদস্যদের সিদ্ধান্ত বদলানোর সুযোগ রয়েছে। সেজন্য ৩৪ লাখেরও বেশি মানুষের সইসহ কলেজ বরাবর একটি পিটিশন করা হয়েছে, যেন ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এই অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’র ফলাফল বদলানো হয়। তবে এখন আর সেই আশা নেই বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভালো দিক
ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাজারো দোষ ও নেতিবাচক দিক থাকলেও তার একটি ভালো দিক আছে বলে মনে করেন মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ‘ভক্স’-এর প্রধান সম্পাদক এজরা ক্লেইন। আর সেটি হলো: ট্রাম্প কখনোই নিজের চরিত্র বা মনোভাব লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেননি। তিনি যা, তা-ই হয়ে সবার সামনে এসেছেন। যা মনে হয়েছে সেটাই বলেছেন। মুখে মেকি হাসি লাগিয়ে রাখেননি। যখন যেমন লেগেছে, তেমন উদ্ভট মুখভঙ্গি করে কখনো হাস্যকর, কখনো আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ভেতরে অভদ্র হয়ে ভদ্রতার মুখোশ পরেননি ট্রাম্প। এটাও তার পক্ষে ভোট এনে দেয়ার অনেক বড় একটা কারণ বলে মনে করেন ক্লেইনের মতোই আরও অনেক বিশ্লেষক।
রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়?
ট্রাম্প বারবার বলেছেন অন্যান্য দেশ থেকে কোম্পানি গুটিয়ে দেশে ব্যবসা বাড়াবেন, দেশের বেকার মানুষগুলোর চাকরির ব্যবস্থা করবেন। প্রেসিডেন্ট হয়ে প্রথম ভাষণেও এ কথা বলেন ট্রাম্প। প্রচারণার সময় আরও বলেন, অভিবাসীদের, বিশেষ করে মুসলিম অধিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকা বন্ধ করে দেবেন। রোববার এক ঘোষণায় তিনি জানান, ৩০ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে তাৎক্ষণিকভাবে দেশ থেকে তাড়াবেন।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, আমেরিকার ট্রাম্পকে বেছে নেয়ার পেছনে কারণ হলো লম্বা একটি সময় ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক যন্ত্রণা, জনগণের মাঝে অস্থিরতা ও এলিটগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ। অন্তত ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে বিষয়গুলো প্রবলভাবে কাজ করেছে। এসব জটিলতার ফল হিসেবেই প্রেসিডেন্টের গদিতে চড়তে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এই ব্যাখ্যাকে মেনে নিলে বলা যায়, ট্রাম্প হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের মতোই একটি ‘রাজনৈতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ’-এর নাম। একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে যেমন সঠিক পরিমাণ বায়ুপ্রবাহ, তাপমাত্রা আর আর্দ্রতা দরকার, ট্রাম্প নামের একজন মানুষ প্রেসিডেন্ট হতেও তেমনি দরকার হয় ওপরের ব্যাখ্যাটির মতো পরিস্থিতি।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে যেসব বিতর্কিত বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট হয়ে সেগুলোর সব বাস্তবায়ন শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ফলাফল কী হবে তা নিয়ে আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে, অর্থাৎ ‘ট্রাম্প ঘূর্ণিঝড়’-এ ক্ষতি বেড়ে গেলে মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ তুলে (অভিসংশন করে) তাকে রিপাবলিকানরাই সরিয়ে দেবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন মার্কিন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক অ্যালান লিটম্যান।