তাসপিয়া আমিন। ১৫ বছর বয়স। পড়াশোনা চট্টগ্রাম নগরীর সানশাইন গ্রামার স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণিতে। বুধবার (২ মে) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকা থেকে অজ্ঞাত হিসেবে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সৈকত এলাকার ১৮ নম্বর ব্রিজের উত্তর পাশে পাথরের উপর উপুড় হয়ে পড়েছিল তাসপিয়ার লাশ।
পতেঙ্গা থানার উপপরিদর্শক আনোয়ার হোসেন বুধবার জানিয়েছিলেন, সকালে স্থানীয় পথচারীরা লাশটি দেখতে পেয়ে থানায় খবর দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে। একই সাথে সিআইডি সংগ্রহ করে লাশটির সকল তথ্য-উপাত্ত। এ ঘটনায় তাসপিয়ার বয়ফ্রেন্ড আদনান মির্জাকে আটক করেছে পুলিশ। আদনান নগরীর দক্ষিণ খুলশী এলাকায় থাকে। তাদের গ্রামের বাড়ি লোহাগাড়ার পদুয়া ইউনিয়নে। আর পড়ালেখা সানশাইন গ্রামার স্কুলেই।
বৃহস্পতিবার (৩ মে) ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে তাসপিয়ার লাশ হস্তান্তর করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের মর্গের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হয় তাসপিয়ার বাবা মোহাম্মদ আমিনের।
এসময় তিনি দাবি করেন ‘তাসপিয়াকে গণধর্ষণের পর হত্যা করেছে পাষণ্ডরা। এমনকি ধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশটি ফেলে দেয়া হয় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের উপকূলে।’ মোহাম্মদ আমিন বলেন, ‘আদনান ও তার সহযোগীরা এসব করেছে। জড়িতদের গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেন সন্তানহারা হতভাগ্য এই বাবা।’
বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে আদনান মির্জাসহ ছয়জনকে আসামি করে সিএমপির পতেঙ্গা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন তাসপিয়ার বাবা।
এর আগে বুধবার তাসপিয়ার লাশ উদ্ধারের পর সুরতহাল প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই কিশোরীর ওপর চালানো ভয়াবহ চিত্র। নিহত তাসপিয়ার পিঠজুড়ে পাওয়া গেছে নির্যাতনের ছাপ। কিশোরীটির পিঠ, বুক ও স্পর্শকাতর অঙ্গসহ সব স্থানেই দেখা গেছে ভয়াবহ নির্যাতনের ছাপ। গোলাকার মুখমণ্ডল থেঁতলানো। চোখ দুটোও যেন নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আর বুকের ওপর একাধিক আঁচড়ের দাগও দেখা গেছে। নিহতের হাতের নখগুলো ছিল নীলবর্ণ।
লাশটি পাওয়ার পর সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেছেন সিএমপি পতেঙ্গা থানার উপপরিদর্শক আনোয়ার।
এদিকে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাসপিয়ার ময়নাতদন্ত হয়। এই ময়নাতদন্তে অংশ নেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুমন মুর্শিদীর নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি টিম। টিমের অপর সদস্যরা হলেন- একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুজন, ডা. জাহানআরা রোজি ও ডা. স্মৃতি। দীর্ঘ এক ঘণ্টা সময় নিয়ে ময়নাতদন্ত শেষে দুপুর দেড়টায় তারা লাশকাটা ঘর থেকে বের হন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. সুমন মুর্শিদী বলেন, ‘ভিসেরা ও সিআইডি রিপোর্ট পাওয়ার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। এই দুই রিপোর্ট পাওয়ার পরই বিস্তারিত জানানো যাবে।’
এদিকে তাসপিয়ার চাচা নুরুল আমিন দাবি করেছেন- আদনান, কথিত বড় ভাই ও তার তৈরি করা ‘রিচকিডস’ গ্যাংয়ের সদস্যরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পূর্বপরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় তারা হত্যা করে লাশটি সমুদ্র উপকূলে ফেলেছে, যাতে তাদেরকে কেউ ধরতে না পারে। এরা শুধু একজন বা দুজনই নয়। এই গ্যাংস্টার গ্রুপের অনেক সদস্যই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত। আদনানকে তিনি ঠাণ্ডা মাথার খুনি হিসেবেও মন্তব্য করেন।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার বিকালে পতেঙ্গা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্ত (ওসি) আবুল কাশেম ভূইয়া মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘আদনান মির্জাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে আদালতে।’
ওসি আরও জানান, বুধবার দিনগত মধ্যরাতে নগরীর দক্ষিণ খুলশীর জালালাবাদ আবাসিক এলাকা থেকে আদনান মির্জাকে আটক করা হয়। জব্দ করা হয়েছে মোবাইল ফোন সেট। তার মোবাইলের কললিস্ট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্যান্য অ্যাপসের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদানের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
নগর পুলিশের কর্ণফুলী জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে সবকিছু বলা সম্ভব নয়। আমরা বেশ কয়েকটি ইস্যু নিয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছি।’
এর আগে মঙ্গলবার (১ মে) সন্ধ্যায় নগরীর ওআর নিজাম রোডের গোল পাহাড় মোড়ে চায়না গ্রিল নামে একটি রেস্টুরেন্টে প্রেমের এক মাস পূর্তিতে মিলিত হয় তাসপিয়া ও আদনান। সেখানে প্রায় ২০ মিনিট অবস্থান করে তারা দুজন।
রেস্টুরেন্টের বয় উজ্জ্বল জানান, মঙ্গলবার শবে-বরাত ও মে দিবসের ছুটির কারণে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রেস্টুরেন্ট খোলা হয়। এর প্রায় আধা ঘণ্টা পর অর্থাৎ ৫টা ২০ মিনিটের দিকে রেস্টুরেন্টে আসে ওই যুগল। তারা রেস্টুরেন্টের ৮নং কেবিনে বসে। এরপর খাবার ওর্ডার নিতে গেলে শুধু দুটি আইসক্রিম অর্ডার করে তারা। প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট অবস্থানের পর দুজন চলে যায়।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েই তাসপিয়াকে একটি সিএনজি অটোরিকশাতে তুলে দেয় আদনান। পরে আরেকটি সিএনজি অটোরিকশাযোগে আদনানও স্থান ত্যাগ করে।
তাসপিয়ার পরিবারের সঙ্গে আলাপকালে স্বজনরা জানান, তাসপিয়ার ব্যবসায়ী বাবা মো. আমিন মঙ্গলবার বিকেলে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন মসজিদে। বাসায় তাসপিয়ার মা ব্যস্ত ছিলেন গৃহস্থালি কাজে। তাসপিয়া বাসা থেকে কাউকে না বলেই বেরিয়ে যায়।
নামাজ পড়ে এসে তাকে বাসায় না পাওয়ায় বিচলিত হন বাবা। আগে থেকেই আদনানের সাথে তাসপিয়ার সম্পর্কের বিষয়টি জানা ছিল তার। খোঁজাখুঁজির পর তাসপিয়াকে না পেয়ে তার বন্ধুদের কাছ থেকে আদনানের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করেন বাবা। এরপর কল করে আনা হয় আদনানকে। তাকে নিয়ে মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে চায়না গ্রিল রেস্টুরেন্টে যান তারা। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বিস্তারিত বোঝার চেষ্টা করেন।
আদনানও স্বীকার করে একসাথে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার কথা। এরপর তাসপিয়াকে আদনান সিএনজি অটোরিকশায় তুলে দিয়েছিল বলেও জানায়। মঙ্গলবার বিকেল ৬টা ১০ মিনিট পর্যন্ত ঘটনা আদনানের স্বীকারোক্তির সাথে মিলে গেছে। সিসিটিভি ফুটেজও বলছে একই কথা। তবে এর পরের ঘটনা উল্টো।
অভিযোগ করা হয় নগরের পাঁচলাইশ থানায়। পুলিশ রাত সাড়ে ৯টার দিকে আদনানকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এ সময় ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় আদনানকে। সেখানে প্রায় দুই-দেড় ঘণ্টার মাথায় আদনানের কথিত দুই বড়ভাই ফিরোজ ও আকরাম তাসপিয়াকে বাসায় পাঠানোর শর্তে ছাড়িয়ে নেয় আদনানকে।
রফিকুল ইসলাম নামে তাসপিয়াদের এক নিকটাত্মীয় জানান, সন্ধ্যায় যখন তাসপিয়াকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন তাসপিয়ার মা বেগম আমিন আদনানকে মোবাইল ফোন করে বাসায় ডাকেন। রাত ৮টার দিকে আদনান ওআর নিজাম রোডে তাসপিয়াদের বাসার সামনে গিয়ে তাসপিয়ার মায়ের সাথে দেখা করে। এসময় তাসপিয়া কোথায় জানতে চাইলে আদনান জানায়, রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েই তাসপিয়া বাসায় চলে এসেছে। তবে তাসপিয়া সে সময়ও বাসায় ফিরেনি।
রফিকুল ইসলাম আরো জানান, ফেসবুক ও ইমোতে যখন ম্যাসেজ আদান-প্রদান হতো, বিষয়টি ঠিকই টের পেয়েছেন তাসপিয়ার মা। এ সময় থেকে মেয়েকে চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করেন তিনি। তবে এর মধ্যেও যে এমন হবে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাসপিয়ার এক আত্মীয় জানান, তাসপিয়ার সাথে আদনানের সম্পর্কের কথা তাসপিয়ার বাবা মোহাম্মদ আমিনকে কয়েক দিন আগে জানিয়ে দিয়েছেন তাসপিয়ার মা। ওই সময়ই তাসপিয়ার বাবা মোহাম্মদ আমিন আদনানকে ডেকে শাসিয়ে দেন। মেয়ের পথ থেকে সরে যেতে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেন তিনি।
এ ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পতেঙ্গা থানার উপপরিদর্শক আনোয়ার জানান, সকালে মৃতদেহ উদ্ধারের পর দুপুরের দিকে তাসপিয়াকে শনাক্ত করেন পরিবারের সদস্যরা। এর আগে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি ও সিআইডি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। বিকেল ৫টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় ময়নাতদন্তের জন্য।
আনোয়ার জানান, তাসপিয়াকে পাথরের উপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকাবস্থায় পাওয়া গেছে। পরনে হালকা গোলাপি সালোয়ার কামিজ। গায়ের রঙ ফর্সা। তবে দুই চোখ ও হাঁটুতে হাল্কা আঘাতের চিহ্ন আছে। মুখের মধ্যে ফেনা ছিল।
ধর্ষণ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে এই তদন্তকারী অফিসার জানান, সেটা সিআইডির ফরেনসিক রিপোর্ট পেলে বলা যাবে। সে ব্যাপারে সিআইডি তাদের প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করেছে। এছাড়া তাসপিয়ার বয়ফ্রেন্ড আদনানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বলা যাবে ঘটনাটি কী।