যার হাত ধরে বাঙালি পেয়েছিলো প্রথম নোবেল পুরস্কার জয়ের স্বাদ। যার কাছে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য চিরঋণী। শুধু বাংলা সাহিত্যই নয়, অনেক শিল্পী, নির্মাতা, লেখক তার সাহিত্যকে অবলম্বন করে টিকে আছেন। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি কবিদের গুরু।
আজ তার ১৫৭তম জন্মদিন। বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদ পুরুষকে স্মরণ করছেন নানা অঙ্গনের মানুষেরা। রবি ঠাকুরের সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছে শিল্পের নানা মাধ্যম। সেই সমৃদ্ধির ছোঁয়া পেয়েছে এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনও। হিন্দি, বাংলা- নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে তার সাহিত্য নিয়ে চলচ্চিত্র। হয়েছে প্রশংসিত, নন্দিত। এক নজরে দেখে নেয়া যাক সেই তালিকা-
চোখের বালি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে যতো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তারমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়, প্রশংসিত এবং নন্দিত বলা চলে ‘চোখের বালি’-কে। একই নামের উপন্যাসকে ভিত্তি করে চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন অনেক নির্মাতা। সর্বপ্রথম এই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা বানানো হয় ১৯৩৮ সালে। সতু সেন পরিচালিত সেই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়, ইন্দিরা রায়, শান্তিলতা ঘোষ, রমা বন্দ্যোপাধ্যায়, হরেন মুখোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস, মনোরঞ্জন ভট্টচার্য প্রমূখ।
এরপর ২০০৩ ‘চোখের বালি’ বানিয়ে হৈ চৈ ফেলে দেন প্রয়াত নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ। এতে অভিনয় করেন ঐশ্বর্যা রাই, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, রাইমা সেন, টোটা রায়চৌধুরী, লিলি চক্রবর্তী প্রমূক।
বিনোদিনী নামের এক বিধবার মানসিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ছবিটির কাহিনী। দুই বিধবার মধ্যকার বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক নিয়ে ছবিটির কাহিনী পায় নতুন মাত্রা।
চারুলতা ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। চারুলতা ছবিটির কাহিনী নেয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ গল্প থেকে। অবহেলিত এক গৃহবধূর গল্প বলা হয়েছে ছবিটিতে। যেখানে দেবরের সঙ্গে ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র চারুর এক অব্যক্ত সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
উপহার উপহার ছবিটির কাহিনী ধার করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘সম্পত্তি’ থেকে। ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মিনু বেশ সহজ সরল। ছবির নায়ক অনুপের সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও নিজের সারল্য থেকে বের হতে পারে না মিনু। কিন্তু নিজের শাশুড়ি সংস্পর্শে ভেঙে যায় মিনুর সহজ সরল ভাবমূর্তিটি।
শাস্তি বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হাতে গোনা যে ক’টি ছবি বানানো হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই নির্মিত হয়েছে ইমপ্রেস টেলিফিল্মস’র ব্যানারে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘শাস্তি’ (২০০৪), ‘সুভা’ (২০০৬), ‘কাবুলীওয়ালা’ (২০০৬) এবং ‘অবুঝ বউ’ (২০১০)। সরকারী উদ্যোগ কিংবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যবসায়িকভাবে খুব কমই কাজ হয়েছে রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে কাজ করতে এগিয়ে আসেন চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ গল্প অবলম্বনে ‘কাঠগড়া’ নামের একটি ছবির কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। তবে নানা জটিলতায় কাজটি শেষ করতে পারেননি তিনি। পরে সেই একই গল্প ২০০৪ সালে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের হাত ধরে উঠে আসে ‘শাস্তি’ ছবির মাধ্যমে। এভাবেই নির্মিত হয় বাংলাদেশের প্রথম রবীন্দ্রসাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্র।
এ ছবির গুরুত্বপূর্ণ চার চরিত্রে অভিনয় করেন ইলিয়াস কাঞ্চন, চম্পা, রিয়াজ ও পূর্ণিমা। । এ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কারও জিতে নেন চম্পা ও ইলিয়াস কাঞ্চন।
সুভা চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘সুভাষিণী’ অবলম্বনে নির্মিত এ ছবিতে অভিনয় করেন বাণিজ্যিক ছবির জনপ্রিয় তারকা শাকিব খান ও পূর্ণিমা। ‘সুভা’ চরিত্রে বাকপ্রতিবন্ধী মেয়ের ভূমিকায় পূর্ণিমার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিলো সর্বমহলে। শাকিব খানের অভিনয়ও নজর কেড়েছিলো সমালোচকদের। ইমন সাহার সংগীত পরিচালনায় বাপ্পা মজুমদারে কণ্ঠে ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ গানটিও ছিলো চমৎকার।
অবুঝ বউ নারগিস আখতার পরিচালিত ছবি ‘অবুঝ বউ’। রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত এ ছবিতে ছবিতে অভিনয় করেন ববিতা, ফেরদৌস, শাকিল খান ও নিপুণ। এ ছবির জন্য সেরা পচিালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার জেতেন নারগিস আখতার। এ ছাড়া সংগীতায়োজক হিসেবে পুরস্কৃত হন সুজেয় শ্যাম। সেরা সম্পাদনা বিভাগেও পুরস্কৃত হয় ছবিটি।
কাবুলিওয়ালা ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্প থেকে একই নামে তৈরি করা হয় চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটিতে ফুটে ওঠে আফগানিস্তানের খোরমা-খেজুর বিক্রেতা রহমতের সঙ্গে গ্রামের ছোট মেয়ে মিনুর বন্ধুত্ব। আফগানিস্তানে মিনুর বয়সী রহমতেরও একটি মেয়ে ছিল। বাবা ও মেয়ের বন্ধনকে সুনিপুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে ছবিটির গল্পে।
এই গল্প নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তপন সিংহ। ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ভারতীয় বাংলা নাট্য চলচ্চিত্র হিসেবে এর খ্যাতি রয়েছে। এতে অভিনয় করেছিলিন ছবি বিশ্বাস, আশা দেবী, জহর রায়, ঐন্দ্রিলা ঠাকুর প্রমূখ।
এরপর বাংলাদেশে ২০০৬ সালেও নির্মিত হয় ছবিটি। এখানে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন প্রয়াত নায়ক মান্না। এটি পরিচালনা করেছিলেন কাজী হায়াৎ।
অতিথি এই ছবিটি করেছেন পরিচালক তপন সিংহ। ছবিটি যে শুধু আনন্দই দেবে তা কিন্তু নয়। এটি আপনাকে অবাকও করবে। ছবিটিতে ‘তারা’ নামের একটি ছোট বালকের গল্প বলা হয়েছে। যে জীবনকে উপভোগ করতে নিজের ঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসে।
ডাকঘর গল্পের নামেই রাখা হয়েছে ছবিটির নাম। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন যুল ভেল্লানি। ছবিটিতে বলা হয়েছে ‘অমল’ নামের এক বালকের গল্প। যে শারীরিক অসুস্থতার জন্য ঘরের বাইরে যেতে পারে না। কিন্তু বাইরে যেতে না পারলেও তার মনের ডাকঘরে সে চিঠি আদান প্রদান করে চলে অবিরত।
নৌকা ডুবি রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নৌকাডুবি আগে হিন্দিতে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। মিলন নামে এই সিনেমায় অভিনয় করেন দিলীপ কুমার, পাহাড়ী স্যান্নাল প্রমুখ। ছবিটির পরিচালক ছিলেন নীতিন বোস।
এরপর তবে বাংলায় নৌকাডুবিকে চলচ্চিত্রের পর্দায় সার্থক করে তোলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ ২০১১ সালে। এটি একটি সামাজিক এবং গভীর আবেগপ্রবণ একটি চলচ্চিত্র। এতে অভিনয় করেছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, যীশু সেনগুপ্ত, রাইমা সেন ও রিয়া সেন। ১৯২০ সালের প্রেক্ষাপটে তৈরি এই পিরিয়ডিক ছবিটি মুক্তি পায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে।
ঘরে বাইরে রবীন্দ্রনাথের ঘরে-বাইরে উপন্যাসকে চলচ্চিত্রের পর্দায় তুলে আনেন সত্যজিৎ রায় ১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিতে। এ ছবিতে দুই আবাল্য সুহৃদ সন্দীপ ও নিখিলেশের সম্পর্কের টানাপড়েন সার্থকভাবে রূপায়িত হয় রুপালি ফিতায়। নিখিলেশের স্ত্রী বিমলার প্রতি সন্দীপের আকর্ষণ, তাদের প্রেম আর ইংরেজবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের অনেক সূক্ষ্ম বিষয় তুলে ধরে উপন্যাসটির এই চিত্ররূপ। বিমলা চরিত্রে ছিলেন স্বাতীলেখা চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং নিখিলেশ ছিলেন ভিক্টর ব্যানার্জি।
সন্দীপ এ ছবির নায়ক নন আবার খলনায়কও নন। মানবজীবনে নায়ক ও খলনায়কের মধ্যে যে অস্পষ্ট এক রেখা দেখা যায় সেই দ্বন্দ্ব খুব সার্থক অভিনয়ে তুলে ধরেন সৌমিত্র। বিমলার ঘর থেকে বাইরের পৃথিবীতে আসা এবং ঘরের প্রতি মমতার নিখুঁত চিত্রায়ণ ঘটান সত্যজিৎ রায়। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মাননা পায় ‘ঘরে-বাইরে’।
চতুরঙ্গ ছবির কাহিনী নেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ থেকে। ঔপনিবেশিক উত্তাল বাংলাকে তুলে ধরা হয়েছে ছবিটিতে। শচীশ নামের চরিত্রের কর্মকাণ্ড ও চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে এগিয়ে গিয়েছে ছবিটির কাহিনী।
লেকিন ছবিটির কাহিনী ধার করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্প থেকে। ছবিটি পরিচালনা করেছেন গুলজার। ছবিতে সামির নামের এক যুবক প্রেমে পড়ে রেবা নামের একটি নারীর বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। সারাক্ষণই নিজের মনে রেবাকে খুঁজে বেড়াতে থাকে সামির।