পিতার হাতে ৬১ বছর আগে যে রাজনৈতিক জোটের উত্থান, পুত্রের হাতে তার সমাপ্তি ঘটল। ৬১ বছরের বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) এই প্রথম পরাজয়ের স্বাদ পেল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন একনায়কদের উত্থান হচ্ছে, চলছে লোকরঞ্জনবাদী বীর, সঙ আর ধুরন্ধর নেতাদের জয়জয়কার, তখন মালয়েশিয়া এক বিরাট ব্যতিক্রম। বিভিন্ন দেশের শাসকেরা যখন শক্তি, ছলনা কিংবা লোভ দিয়ে জনগণকেই বদলে দিচ্ছে, মালয়েশিয়ার জনগণ তখন গণতান্ত্রিকভাবে সরকার বদলের নজির রাখল। যুগের পর যুগ একচেটিয়া ক্ষমতায় থাকা বারিসান ন্যাশনালকে হারাল সদ্যগঠিত জোট পাকাতান হারাপান। মাহাথিরের হারাপান পেয়েছে ১২১টি আসন, আর ক্ষমতাসীনেরা পেয়েছে ৭৯টি এবং তৃতীয় জোট পাকিতান রাকিয়াত পেয়েছে ১৮টি। মজার বিষয়, ২০১৩ সালের থেকে ক্ষমতাসীনেরা হারিয়েছে ৫৪টি আসন, আর এবারের বিজয়ীদের আসনও বেড়েছে ঠিক ৫৪টিই। কীভাবে তা ঘটল?
বিরোধী দলের প্রধান নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে কারাগারে পুরে মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। গত দশ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কোনো জনপ্রিয় নেতার দেখা পাওয়া যায়নি। তাছাড়া হাতে রয়েছে এমন এক কালো আইন, যা দিয়ে যে কাউকে নির্বাচনে অযোগ্য, বাতিল কিংবা জেলে পোরা যায়। পরাশক্তিদের সমর্থনও তাঁর পক্ষে। বিরোধী যে জোট তাঁকে রুখতে চায়, তাদের শীর্ষ নেতা ন্যক্কারজনক অভিযোগে কারাদণ্ডে দণ্ডিত। জোটের দলগুলোও তেমন শক্তিশালী নয়। এ অবস্থায় মালয়েশিয়ায় পরিবর্তনের জন্য দরকার ছিল একটি তুরুপের তাস। আধুনিক মালয়েশিয়ার উন্নতির রূপকার মাহাথির মোহাম্মদ স্বয়ং হাজির হলেন সেই তাস হিসেবে। তিনি জাতীয়তাবাদী হলেও ছিলেন বাস্তববাদী। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয় জাতি তাঁর ওপর আস্থা রাখত, কিন্তু চীনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের প্রতিও তিনি বৈষম্য করতেন না। কঠোর হাতে দেশ চালালেও দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে কাবু করা যাবে না। কোনো পরাশক্তির প্রতি অতিরিক্ত প্রেমও তিনি দেখাননি। দেশের প্রয়োজনে তাঁকেই দাঁড়াতে হলো মালয়েশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী এবং আন্তর্জাতিক মদদপুষ্ট নাজিব রাজাকের সরকারের বিরুদ্ধে। ৯২ বছর বয়স ছাড়া আর কোনো দুর্বলতা তাঁর ছিল না।
দেশি-বিদেশি বিশ্লেষকদের অনুমানের পাল্লা নাজিবের দিকেই হেলে ছিল। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন জরিপ সংস্থাও সে রকমই আভাস দিচ্ছিল। ফল প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা আগেও তাঁর ওপর বাজি ধরার নিরপেক্ষ লোক পাওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু সেটাই ঘটেছে। এই জয় সাধারণ হলে মালয়েশীয় গণমাধ্যম একে ‘মালয়েশীয় সুনামি’ বলত না আর চীনের রাজধানী বেইজিংয়েও সতর্কঘণ্টা বাজত না।
এক এক করে আসা যাক। যে বিরোধীরা এবার বিজয়ী হলো, মালয়েশিয়ার ইতিহাসে কখনো তারা ক্ষমতার স্বাদ পায়নি। আর সেটা কিনা ঘটল সেই নাজিব রাজাকের কারণে, যাঁর পিতা মালয়েশীয় রাজনীতির প্রধানতম পুরুষ। নাজিব রাজাকের পিতা তুন আবদুর রাজাক ৪৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বারিসান ন্যাশনাল জোটের প্রতিষ্ঠাতা এবং নেতা। এই জোটেরই প্রধান দল এউএমএনওর তিনি সবচেয়ে সফল মানুষ। দুর্নীতি ও স্বৈরশাসনের কারণে পিতার ঐতিহ্যকে তলায় নামিয়ে আনায় নাজিব রাজাককে ইতিহাস নিশ্চয়ই দায়ী করবে।
চোখের দেখায় আমরা জানলাম, লড়াই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বনাম মাহাথির মোহাম্মদের মধ্যে। রাজনীতি ও জনমনে নেতার ব্যক্তিত্ব অবশ্যই বড় ব্যাপার। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। মাহাথিরের নেতৃত্বে বিরোধীদের জয় হয়েছে তাদের কর্মসূচির জন্যও। নাজিব তুলেছিলেন উন্নয়নের ধ্বনি আর বিরোধীরা বলেছিল তারা ক্ষমতায় এলে বিরোধীদের দমনপীড়নের সংস্কৃতি বন্ধ করবে। মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে কালাকানুন বাতিল করবে। গণবিরোধী কর (জিএসটি) ও টোল তোলা বন্ধ করবে এবং বন্ধ হওয়া ছাত্রঋণ আবার চালু করবে। দুর্নীতি ও বিদেশি বিনিয়োগে পক্ষপাত নিয়ে কঠোর তদন্ত চালাবে। নাজিব সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল সরকারিভাবে গঠিত বিনিয়োগ তহবিলে বিরাট দুর্নীতির ঘটনা। যথারীতি তিনি সেসব অস্বীকার করেছেন। কিন্তু মাহাথিরের আপত্তিটা ছিল নীতিগত। তিনি মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে যেসব দ্বিপাক্ষীয় চুক্তি ও বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে, সেসবকে অস্বচ্ছ ও জাতীয় স্বার্থের জন্য হানিকর বলে মনে করেন। এ অভিযোগের দায় একা নাজিবের নয়, তাঁর উন্নয়নসঙ্গী চিনের বিরুদ্ধেও যায়। মাহাথির তাঁর আমলে যেভাবে দেশের শিক্ষা ও শিল্পোন্নয়নকে প্রধান গুরুত্ব দিয়েছিলেন, এসব কর্মসূচি ও বক্তব্য ছিল সেসবেরই প্রতিধ্বনি।
ওদিকে নাজিব উচ্চ প্রবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে গেছেন আর বাস্তবে দাবড়ে বেড়িয়েছেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের। সত্য যে নাজিব রাজাকের আমলে বিপুল পরিমাণ চীনা বিনিয়োগ এসেছে; কিন্তু সেসবে মালয়েশিয়ার স্বার্থ রক্ষা পায়নি বলে অভিযোগ মাহাথিরের। তাছাড়া গত আট বছরের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধি ছিল সর্বোচ্চ। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে প্রধান বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে সমকামিতার অভিযোগে জেলে পোরার ব্যবস্থা। মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে কালো আইন জারির কারণে সরকারের বিপক্ষে দাঁড়ানো হয়ে পড়েছিল কঠিন। যেমন নির্বাচনের সাত দিন আগে মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর প্রচারের তদন্ত শুরু হয়। এর আগে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মাহাথিরের দলের নির্বাচনী প্রচারণা ৩০ দিনের জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়। পরে অবশ্য আদালত এই নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করে দেয়।
এখন মালয়েশিয়ার সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে রাজার তরফে মাহাথিরকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে সরকার গঠনের জন্য। পরাজিত প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজার সমর্থনে ক্ষমতা ছাড়ায় গড়িমসি করেন কি না, সেটা দেখার জন্য আরও কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। যদি সব ঠিকঠাক থাকে, তাহলে মাহাথিরই হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ৯২ বছর বয়সে তিনি দেশ চালাতে পারবেন? এর উত্তর হচ্ছে, সম্ভবত না। তাঁর দায়িত্ব ছিল এ বছরের জানুয়ারিতে গঠিত জোটকে নির্বাচনের নদী পার করিয়ে দেওয়া। তাতে তিনি বিস্ময়করভাবে সফল। পরের চমক হলো, বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের জেল থেকে মুক্তি। স্বাভাবিকভাবেই ৫ বছরের শাস্তির মেয়াদ শেষে আগামী জুন মাসের শুরুতেই তিনি মুক্তি পেতেন। এখন বিজয়ী সরকার তাঁর মামলার পুনঃ তদন্ত করে অথবা রাজকীয় দায়মুক্তির মাধ্যমে তাঁকে আইনগতভাবে পরিষ্কার করে আনতে পারে। তারপর কোনো একটি উপনির্বাচনে তাঁকে জয়ী করিয়ে আনা। আর তারপরই তিনিই হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে একটানা ২২ বছরের শাসনে তিনি মালয়েশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে সবল এবং জাতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলেন। এবারে তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছে গণতন্ত্রের পক্ষে। রাজনীতিতে এটা বিরাট আত্মত্যাগ। তিনি শুধু তাঁর আজীবনের দলের বিরুদ্ধেই দাঁড়াননি, তাঁর প্রধান রাজনৈতিক শত্রু আনোয়ার ইব্রাহিমকে মুক্ত করে প্রধানমন্ত্রীর পদ পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়ার কাজ করেছেন। ইব্রাহিমকে একবার শাস্তি দিয়ে তিনি যদি ভুল করে থাকেন, এভাবেই তার প্রায়শ্চিত্ত করলেন।
রাজনীতিতে কদাচিত বিজলি চমকের মতো দেশপ্রেমের ঝলক দেখা যায়। মাহাথির মোহাম্মদ ৯২ বছর বয়সে নিজের দলের বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক শত্রুকে জয়ী করায় যে লড়লেন, এটা প্রমাণ করে, পাহাড় বৃদ্ধ হলেও পাহাড়ই থাকে, মাটির ঢিলা হয়ে যায় না। মাহাথির মোহাম্মদ বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পিজমের পাগলানাচ আর পুতিনবাদের দম্ভের সামনে একটি গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্তই রাখলেন। কোনো এশীয় মুসলিম দেশের নেতা হিসেবে এটা এক বিরাট অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে সব দেশের গণতন্ত্রীদের জন্য।
লেখক: ফারুক ওয়াসিফ।