ফিচার

টেক্সট (Text) যখন স ম তুহিনের কবিতা

By Daily Satkhira

May 20, 2018

শুভ্র আহমেদ

টেক্সট (Text) যখন স ম তুহিনের কবিতা

 

রবীন্দ্রনাথ প্রায় সকল কে অভিনন্দিত করতেন। জীবনানন্দ দাশকেও করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ দাশের কবিতার নতুনত্ব প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘তোমার (জীবনানন্দ) কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহ নেই’। রবীন্দ্রনাথের অন্য আর একটি চিঠি থেকে জানা যায় জীবনানন্দ দাশের কবিতার যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিল তার মধ্যে রস, স্বকীয়তা, তাকিয়ে দেখার আনন্দ, চিত্ররূপময়তা ইত্যাদি ছিল প্রধান। দু’য়ে দু’য়ে চার মেলালে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে এই বৈশিষ্ট্যগুলোই জীবনানন্দের কবিত্বশক্তি। অবশ্য একথা অস্বীকার করতে এখন দ্বিধাই জাগে, পরবর্তী প্রজন্ম গত সত্তর/পঁচাত্তর বছর ধরে যে জীবনানন্দকে ছুঁয়ে আছে তার মূলে রয়েছে জীবনানন্দের কবিতার স্বতন্ত্র ভাষাশৈলী এবং গভীরতর, গাঢ়তর জীবনবোধ। যে জীবনবোধের প্রত্যেকটি ব্লকজুড়ে রয়েছে আলো-অন্ধকারের জটিল মনোদৈহিক বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার-স্যাপার। সাম্প্রতিক সময়ের সাহিত্য তাত্ত্বিকরা অবশ্য এই বলে রায় দিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথ কথিত কবিত্বশক্তি পরিমাপের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি হচ্ছে কবির ‘দীর্ঘকবিতা’ অর্থাৎ কবিতার অবয়ব। কবি স ম তুহিনের একটি দীর্ঘ কবিতা তুলে ধরছি। আমি অবশ্য জানি না কবিতাটির দৈর্ঘ্য স ম তুহিনের কবিত্বশক্তির পূর্ণ পরিচয় প্রদান করবে কিনা, অথবা আদৌও কবিতার পংক্তি গুণে গুণে কবিত্বশক্তির সত্যিই পরিমাপ করা যায় কি না?

স্বীকার করছি উপরের কোনোটিই আমার উদ্দীষ্ট নয়। আমি স ম তুহিনের কবিতার শরীর জুড়ে মাখামাখি গল্পগুলোকে আবিষ্কার করতে চাই। আবিষ্কার করতে চাই আমার সমাজ, আমার সময়, আমার পারিপার্শ্বিকতা এবং চিহ্নের স্তরে পাঠ করতে চাই স ম তুহিনের বোধের জায়গা-জমিনগুলোকে। সবার আগে সম্পূর্ণ কবিতাটি : “সেখানে সন্ধ্যায় মঙ্গল শঙ্খেরা বেজে ওঠে আজো মসজিদে কানা মুয়াজ্জিনের আজানের সুরকে অভিবাদন জানায় রাতশেষের শুকতারাÑ এ ভাবেই শুরু হয় দিন আর রাত।

রাতের বেলা দূর শিয়ালের হুককাহুয়া যেন ব্যান্ডের স্প্যানিশ গিটারের কোন গির্জার ঘন্টাধ্বণি হাতছানি দেয়না নেই কোনো প্যাগোডা রঙ-বেরঙের পালতোলা নৌকা মেলে তবে হাঁটতে হয় কিছুটা পথ পথে একটা সাঁকোÑ এখন কংক্রিটের ব্রিজ ঠিক দুপুরেও ছায়া করে রাখে একটা শিরিষের গাছ তার নিচে চায়ের দোকানে রাজনীতির ছড়াছড়ি কখনো হাতাহাতিতে।

দিনের কাগজখানা যখন পৌছে একদিন পর হুমড়ি খেয়ে পড়ে সব প্রথম পাতার পাঠকেরা ঠিক আমার বাড়ির ধারে কুমারদের ঘর ছাপানো বইয়ের পাতায় দেখি লেখা থাকে মৃৎশিল্পী!

রাধা, ওর বরটা মরেছে-সে চার শরৎ আজো বিধবা শুধু আধারেরাই ওর চোখের জল দ্যাখে যেমন রাতশেষেও ঠক্ ঠক্ শব্দ আসে কুমারদের পাড়া থেকে ওদের সব কথা জানায়

ফর্সা চাঁদের রাতে, অসম্ভব অসুন্দরী মেয়ের অভিসার প্রগতি গতিহীন জীবন তবু চলে দোলাচলে রূপ বেচে খায় রূপহীন রূপা

মুক্তিযোদ্ধা ঈমান আজ রিকসাচালক ভোট বেচেছে করিমবক্স কুড়ি টাকায়,

তিমির! গায়ের রং ফর্সা বেশ নাম আছে আবৃত্তিতে, চমৎকার বলতে পারেনÑ লাল মলাটের মার্কস, লেনিনের ছবি ভরা বই কতদিন বলেছে, ‘অক্টোবর’ বিপ্লব, দুনিয়ার মজদুর এক হও, আরো আরো কত… এ দিন দেখি রাস্তায় র‌্যাব-রঙা মার্সিডিস থামিয়েÑ ভাবখানা যেন মে ডে লেনিনগ্রাদে নয়, হয়েছিল শিকাগোতে

বিকশি স্কুল ইউনিফর্মের লম্বা চুল মেয়েটির একদিন সকালেই হলো বিয়ে। হোয়াইট হাউসের মতো সাদা গাড়িতে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে চলল শ্বশুরবাড়ি তাকালো একবার তারপর হয়নি দেখা অনেকদিন। চিঠি লিখেছিল একখানা বলেছিল, বলোনি কেন…

এবার বলব, বলতেই হবেÑ কখনো হেয়ালির ধূমকেতুর মতো কোন নেতা মাইক্রোফোনে পানের পিক ছড়িয়ে …

আমরা জানি, সব শূন্য প্রতিশ্রুতি তবু শুনি আর গুনি Ñ হয়তো … রাস্তা দিয়ে হাঁটতে কিংবা রাতে যখন সবাই ঘুমুতে যায় তখন ভেসে আসে সুর ঐ দূর ছবি পাড়ার সব’চে তাজা ছবির তবু আজো বাঁশি বাজে রক এন্ড রোলের ভিড়ে, কখনো-সখনো।

একটা লাইব্রেরী গুটিকয় সেলফ আর শ’খানেক বই দু’চারজন পাঠক মেঘের আকাশে হঠাৎ দেখা তারার মতো

দাউদ কাকা চমৎকার গল্প বলেন অসাধারণ ঢংয়ে সাধারণ সব গল্প এই যেমন ‘বাসে যেতে যেতে…’ কিংবা ‘বেগুন গুলোর যা চেহারা একেবারে ক্যাম্পাসের সুন্দরীরা যেন…’

হৃদয়া খুব ভালো মেয়ে (ছিল,আজ তার হৃৎপিন্ডে অসম্ভব এক অসুখ) আমার মায়ের মতো উজ্জল নতুন কবিতার জন্য যুদ্ধ করেছিল বাবা আমি যুদ্ধ দেখিনি আমি যুদ্ধ দেখতে চাইও না

আমাদের গাঁয়ে এ্যারাবিয়ন নাইটস্’র সিন্দবাদ নেই তবে সন্জীব আছে সবাই ওকে ভালোবাসে আরো আছে এক ইট-সিমেন্টের স্তম্ভ কোন প্রাণ নেই তার তবু সে কথা কয়, কাঁদে,হাসে প্রেম চায় ভালোবেসে ফুল দিই আমরা

প্রতি বছর বর্ষা আসে আর আসে বিজয়, সবুজ ধানের ক্ষেত অভিবাদন জানায় তাকে

ফেব্রুয়ারি’র প্রথম দিন আমার ছোট ভাইয়ের জন্মদিন আমার বোনটা চিরকাল সবুজ ধানের ক্ষেত

কাগজে আঁকা শহিদ মিনার কোথায় যেন দেখেছিলাম? ও হ্যা সাঈদ কাকার পকেটে। বলেছিল, হৃদয়েও আছেÑ এক সাথেই পড়তাম এক ছেলের বাবা এখন দেশান্তরে

একবার একুশের দিন দুরন্ত ছেলেরা খুলে নিলো জুতো গোপালের ‘চাষা-ভুষোদের বোঝানো মুশকিল, দু’য়ের পিঠে এক একুশ’Ñ কে যেন বলেছিল মনে নেই মনে রবে মনির, মনজুর, রাজেশদের আরো যারা সুহৃদ, ওরা সবাই সুজনÑ ওদের চুল ছাঁটে কাশিনাথ ভালোবাসা বসবাস করে ওদের হৃদয়ে শিশিরের মতো।

প্রাইমারির মাষ্টার মশাই বলেছিলÑ সেই ছেলেবেলায় ‘ভুল বানানটাই ‘ভূল’ লিখেছিস গাঁধা’ সে কথাও ভুলিনি।

কবিতা’র মতো মেয়েরাও কবিতা হয় নাÑ সে গল্প না হয় অন্য আরেকদিন বলব তোমায়

আর সেখানে সন্ধ্যায় মঙ্গল শঙ্খেরা বেজে ওঠে আজো মসজিদে কানা মুয়াজ্জিনের আজানের সুরকে অভিবাদন জানায় রাতশেষের শুকতারা এ ভাবেই শুরু হয় দিন আর রাত।” (প্যাপিরাস, অজানা অর্কেস্ট্রার দেশে)

‘প্যাপিরাস’ শব্দটিকে কবি স ম তুহিন কবিতার শিরোনাম হিসেবে মস্তকশীর্ষে জুড়ে দিয়ে মূলত আমাদেরকে, মানব সভ্যতার প্রাচীনত্বেই শুধু নিক্ষেপ করেন না একইসাথে প্রাচীন ও সাম্প্রতিকের সেতুবন্ধনও করেন একশ কুড়ি লাইনের কবিতার মধ্যে।

কবিতাটি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই স ম তুহিন ‘প্যাপিরাস’ কবিতায় গল্প বলেন কিন্তু কোনো একক কাহিনী নির্মাণ করেন না। একাধিক চরিত্রের কিছু সময়কে তুহিন মূর্ত করেন বিমূতের্র আলো-অন্ধকারের সরাইখানা থেকে। স্পষ্ট হয় উদ্দেশ্য বিশেষ করে, স ম তুহিনের বোধের নির্বান্ধব অঞ্চলটি। স ম তুহিন শুরু করেন একটা জনপদের বিবরণীর মধ্য দিয়ে। যে জনপদের দুই প্রধান ধর্মবিশ্বাসী মানুষরা মিলেমিশে থাকেন, দিন শুরু হয় কানা মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে শুনতে আর দিনের শেষটাতে থাকে মঙ্গলশঙ্খের ধ্বনি। খবরের কাগজখানা পৌছোয় সেখানে একদিন পরে। কিন্তু রাজনীতিমনস্ক মানুষের তাতে কোনো খেদ নেই। রাধা, মুক্তিযোদ্ধা ঈমান, তিমির, বিকশি, দাউদ কাকা, হৃদয়া, সন্জীব, সাঈদ কাকা, গোপাল, মনজুর, রাজেশ প্রভৃতি চরিত্রগুলোর হাত ধরে একে একে ভিড় করে আমাদের মহত্তম অর্জনসমূহের অন্যতম যেমন ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বাম রাজনীতি কথিত ‘মার্কস-লেনিন’-র দর্শনচর্চার ভূত-ভবিষ্যৎ ইত্যাদি। অনেক চরিত্রের ভিড়েও আলাদা করে আলো ফেলেন প্রাইমারির মাস্টারমশাই, কবি যার নাম জানান না কিন্তু এটুকু জানতে পারি কবির ভুল বানান শুধরে দিতে যেয়ে বলেছিলেন এক প্রবাদপ্রতিম বাক্য ‘ভুল বানানটাই ভূল লিখেছিস গাঁধা।’

গায়ের রং ফর্সা, নাম তিমির। সংস্কৃতিকর্মী, প্রগতিশীল রাজনীতির অনুসারী। কবি অবশ্য বুঝেছিলেন অনেক পরে আসলে অন্ধকার গায়ের রঙে নয় অন্ধকার মনে-মননে। বিলাস-ব্যসন পুঁজির কাছে অনেক তরুণইতো আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু যদি তিনি হন ‘মার্কস-লেনিন’ দর্শনে দীক্ষিত বৈপ্লবিক চেতনার সুউজ্জ্বল পুরুষ তখন, কবির উপলব্ধি :

‘র‌্যাব-রঙা মার্সিডিস থামিয়েÑ ভাবখানা যেন মে ডে লেনিনগ্রাদে নয়, হয়েছিল শিকাগোতে’

কবির প্রেম, কবির বিরহ, কবির স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাকে দূরে সরিয়ে কবি শেষ পর্যন্ত রাত শেষের শুকতারার অভিবাদন কে সত্য মেনে নেন, এবং এই জায়গায় এসে চিহ্নের স্তরে আমরা আমাদের সমাজ, রাজনীতি এবং কবি স ম তুহিনের মননবিশ্বের সহজ পাঠ নিতে পারি। কবি নৈরাশ্যের ছবি আঁকেন না, পরিবর্তে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের স্বপ্নসম সৌহার্দবাসের প্রতিচ্ছবিই দেখি। কিন্তু একইসাথে বাকরীতির নিপুণ চতুরতায় আমরা নিক্ষিপ্ত হই ‘দ্বিজাতিতত্ব’ নামক ভুল রাজনৈতিক ব্যাকরণ পাঠের কুফল রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সর্বোপরি এসব থেকে মুক্তির না বলা ইতিহাসের বয়ানে। একইসাথে আমরা পতন দেখি একজন মানুষের, ‘তিমির’। কবি সুকৌশলে এড়িয়ে যান সাম্য-সমাজ গঠনের ব্যর্থতার দায়ভার কাঁধে বহনের। মার্কস যদি হন থিসিস, মার্সিডিসকে এন্টিথিসিস ধরলে সিনথেসিসটিকে কবি সুপ্ত রাখেন এই কারণে যে এর ফলেই নতুন প্রজন্ম জেগে উঠতে পারে নতুন ভাবনায়, নতুন ভাষায়, ভালোবাসায়।

স ম তুহিন এভাবেই অখ- আলোর আশা দিয়ে না হারার কবিতা লেখেন, ‘অজানা অর্কেস্ট্রার দেশে’। বলে রাখি ‘অজানা অর্কেস্ট্রার দেশে’ স ম তুহিনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, যেখানে সংকলিত কবিতার সংখ্যা উনত্রিশটি। ‘পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে’ চল্লিশটি কবিতায় সমৃদ্ধ কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, যেটির প্রকাশকাল ২০১৫, প্রথমটির ঠিক এক বছর পরে।

লিখন পদ্ধতির রূপান্তর স ম তুহিনের কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। চিন্তা ও বিষয়বস্তুর বর্ণনায় স ম তুহিন শব্দগুলোকে সোজাসুজি প্রয়োগ করতে চান। সুপরিকল্পিত সংক্ষিপ্ততা, পরিচ্ছন্ন গতিবেগ আনতে তিনি তাঁর কবিতায় পুরাতন অলঙ্কারগুলো কাটছাঁট করেন না তিনি, এমন সব চিত্রকল্প ব্যবহার করেন যেগুলো খুবই সহজ ও সাধারণ। এই সরল বাকরীতির কারণে তার কণ্ঠস্বরের যে অকৃত্রিমতা, এই অকৃত্রিমতাই তার কবিতাগুলোতে নতুনত্বের আস্বাদ এনে দেয়।

কবি-ঔপন্যাসিক-গল্পকার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার জীবনানন্দ দাশের কবিতার জাদুকরী শক্তির তীব্রতা বোঝাতে ‘পাগল পাগল কথাবার্তা’ এরকম দ্যোতক বাক্য ছুড়ে দিয়েছিলেন কবিতা পাঠকের দিকে। কিন্তু সুনীল স্বয়ং যখন বলেন, ‘নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই দুঃখে থাকবে’ তখন কলকাতার সাথে নীরার সম্পর্কেও চেয়ে আমাদের সামনে যে বিষয়টি ফুটে ওঠে তা হচ্ছে ঐ ‘পাগল পাগল কথাবার্তা’। অবশ্য আমাদের বুঝতে তখন এতটুকু অসুবিধা হয় না সুনীলও একই ‘পাগল পাগল কথাবার্তা’য় আক্রান্ত। স ম তুহিনও মাঝে মধ্যে এরকম পাগল পাগল কথা-বার্তায় আক্রান্ত হন। এমন কিছু পাগল পাগল কথাবার্তার নমুনা তার কবিতা থেকে :

‘কষ্টে সাদা জোছনা কুড়োই করি পকেট ভর্তি।’ (অজানা অর্কেস্ট্রার দেশে : অজানা অর্কেস্ট্রার দেশে)

‘কুমারীর পাড় ঘেষে কেউ কেউ ঘুমায় কারো কারো সাথে জেগে থাকে পাড়া’ (পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে : পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

“ঋতি প্রতীতি কি তুমি জানো ? কবিতায় পড়েছি, ‘পৃথিবীর সব বেশ্যাই সমান রূপসী’” (ঋতি : পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আন্তর্জাতিকতার যে ব্যাপ্তি ছিল তা যেমন একইসাথে বৈশ্বিক অন্যদিকে দেশজও। কিন্তু ত্রিশের লক্ষ্যহীন আধুনিকতায় ছিল না বঙ্গীয় ভাবসম্পদ। ত্রিশের লক্ষহীন আধুনিকতাবাদী সাহিত্য প্রাকআধুনিকদের আক্রমণ করে যাত্রা শুরুর পরিবর্তে সরাসরি ইউরোপীয় সাহিত্যের আমদানি ঘটিয়েছিলেন এদেশে, এদেশের সাহিত্যে। এমনকি জীবনানন্দের কবিতায় প্রবলভাবে এদেশের নিসর্গ উঠে এলেও আধুনিকতার দর্শন ও শৈলী যেমন ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা ও অসহায়ত্ব, অমঙ্গলবোধ, জীবনের কোনো চুড়ান্ত লক্ষ ও সত্য সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ততা, ক্লান্তি ও নির্বেধ জীবনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, সাহিত্যকে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানপ্রাচীরে আবদ্ধ করার প্রবল চেষ্টা ইত্যাদি থেকে মুক্ত নয়।

পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা তিরিশের আধুনিকতাকে প্রতিহত করে দেশজ আধুনিকতার নন্দনতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন তাদের কবিতায়। বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রাসন প্রতিহত করে এ সময় তারা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মিথ্যে মোহ থেকেও বেরিয়ে এসেছেন স্বেচ্ছায়। এই প্রজন্মের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিনিধি সিকান্দার আবু জাফর, শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখরা স্বভূমি, স্বজাতি-স্বভাষার উত্থান তাদের কবিতায় উপজীব্য করলেও দেশজ আধুনিকতার নন্দনতত্ত্বের প্রতিষ্ঠায় তারা শেষ পর্যন্ত তাদের কবিতায় জাতীয় জীবনের রাজনীতিকে একমাত্র অথবা চুড়ান্ত করেননি।

স ম তুহিন স্বদেশী ইতিহাস-ঐতিহ্য আশ্রিত মূল্যবোধে আস্থাশীল। সে কারণে স্বদেশী ইতিহাস-ঐতিহ্য আশ্রিত মূল্যবোধ সৃষ্টির চেষ্টায় উপনিবেশবাহিত নৈতিকতা, আধুনিকতা, রাষ্ট্রধর্মের প্রতিও কখনও কখনও আক্রমণ করেন অসংকোচে। উপনিবেশবাদের সকল মূল্যবোধ এমনকি ঔপনিবেশিক গণতন্ত্রও সরাসরি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয় তার কবিতায় :

‘তোমার খোলা পিঠ দেখে আমার ঈর্ষা জাগে তোমাকে ভুলতে পারিনা আনমনে আঁকি তোমায় মতো দূরন্ত বেশ্যা আর আসেনি এ জগতে।’ (গণতন্ত্র : পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

কবির এই বোধের অঙ্কুরোদগম দেখতে পাই আরো আগে। অজানা অর্কেস্ট্রার দেশে :

‘এলামেলো উভচর ভাবনা যেনো এক স্বেটিং গার্লÑনাম তার আধুনিকতা ছুটছে টান পায়ে গময়ের কত তাড়া যেন এক সংক্ষেপিতা।’ (স্যাম্পেন : অজানা অর্কেস্ট্রার দেশে)

কবি মনে করেন বাংলার মাটি-মানুষ, বাংলার হৃদয়-প্রকৃতির সাথে সম্পর্কহীন আধুনিকতার ট্রাক্টরে চাষকৃত কবিতার কারণে কবিতার পাঠক ক্রমশ কমে যাচ্ছে। সে কারণে রোলার পেটানো রাস্তার কষ্ট অনুভব করলেও কবি সেখানে স্থির থাকেন না বরং আবিষ্কার করেন :

‘প্রতিধ্বণি ফিরে এসে বলে এতদিনে বুঝেছি প্রতীতির আস্তাবলে আজ আর কেউ রাখো কোনো ঘোড়া। আছে কিছু রূপান্তরিত প্রেরণা সেঁধিয়ে সাজানো সেলফে এলোমেলো বই আর ভুল রঙে আঁকা পৃথিবীর ছবি।’ (স্যাম্পেন : অজানা অর্কেস্ট্রার দেশে)

স ম তুহিন সর্বদাই জীবনমুখী। জীবনমুখী বলেই তিনি নারী ও প্রকৃতি থেকে নিতে চান তার চলার ইচ্ছে শক্তি : ‘পাহাড়ের সিঁড়িগুলো আপন ভেবে পৃথিবীকে উপেক্ষা করতে’ শিখলেও তিনি অতীতের সাথে সম্পর্কহীন হতে চান না। একটি (লক্ষনীয় একজন নয়) সবুজ মেয়ে কবির ঘুম কেড়ে নিলে পৃথিবীর সব রঙ নীলখামে ভরে জলে নামার প্রতিশ্রুতি দিতেও কার্পণ্য করেন না তিনি। কিন্তু কবি সর্বদাই থাকতে চান নির্মল, সকল কাজে অংশ নিয়েও দায়হীন :

‘রোদ্দুর পথভুলে চলে আসে কার্ণিসে সাঁওতালী মেঘে উচ্ছাস, হৃদয়ের ছায়া হৃদয়ে হৃদয়ের কী দোষ ?’ (রোদ্দুর পথভুলে চলে আসে কার্নিসে : (পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি অনুষঙ্গ এমনকি প্রেমও সবসময় পরিশীলিত হয় সমসাময়িক ও ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জারণে। শুধু ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভাবনায় নয় তার রাজনৈতিক বোধেও তিনি নিমজ্জিত থাকতে চান, স্থির থাকতে চান সকল বৈরী বসন্তেও। রং খুঁজে পান সেইসব মহত্তম মানুষ ও অর্জনগুলোর মধ্যে যে সমস্তই কবির বোধের একান্ত ফসল এবং অবশ্যই সেগুলো পূর্বপুরুষের অনেক ত্যাগে লাল রক্তের অসংকোচ দানে অর্জিত। শিল্পকলার পাঠ গ্রহণ পূর্বক কবি সাদার মধ্যে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পান পৃথিবীর সমস্ত রূপ-রস-রং। সাদা মানেই কবির কাছে ক্ল্যাসিক সবকিছু এই যেমন, রবীন্দ্রনাথ, পাবলো নেরুদা এবং অবশ্যই শেখ মুজিবুর রহমান। রং মন্ত্রের শক্তি নিয়ে কবিতার চরণ হয় কখনও এরকম :

‘রংয়ের কথা আসলেই আমি এলোমেলো হয়ে যাই কিছুতেই মেলাতে পারি না , কোন রং আমার পছন্দের তবে সাদা রংয়ের কথা আসলে সবার আগে ভাসে রবীন্দ্রনাথের মুখ’

তারপর অনিবার্যভাবে আমার চোখ আঁটকে যায় একটা ফ্রেমে মাথায় হ্যাট, মুখে পাইপ, প্রেমিকার গলা জড়িয়ে প্রেমের কবিতা লিখে কাটিয়েছেন সারাজীবন লোকটার পছন্দ ছিল বিপ্লব আর ভালোবাসা, তাই সিদ্ধান্ত হলো লাল কফিন আর লাল আচ্ছাদনে শেষ হবে তাঁর শেষ বিদায় অথচ মৃত্যুর পূর্বে বানানো কফিনটি ছিল সাদা রংয়ের স্থির বিশ্বাস ছিল নেরুদার Ñ সাদা শূন্যতার প্রতীক

সাদাকালোর একখানা ক্যানভাস আমাদেরও আছে আমাদের প্রিয় ক্ল্যাসিক কবি বলছেন, ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না!’ (রংয়ের কবিতা : পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি আত্মনিমজ্জন ও মানস সম্প্রসারণের আনুভূমিকতায় নিসর্গলোক, দেশি-বিদেশি কাব্যকথার চরিত্র ও ভাবানুষঙ্গ ইত্যাদির অনুসন্ধান স ম তুহিনের কবিতার একটি বিশেষ চিহ্ন। কিন্তু পূর্ববর্তী কাব্যদর্শন, কাব্যমেজাজ ও প্রকরণ থেকে তিনি সহজেই আলাদা হন মূলত তার কবিতার শরীরে জড়িয়ে থাকা গল্পগুলোর জাদুকরী শক্তির কল্যাণে। তার কবিতা যে কখনও কখনও ফরাসি কবি প্রেভের’র কবিতার সাথে নিকট ঋণে আবদ্ধ হয় সেও ঐ কবিতার শরীরে জড়িয়ে থাকা গল্পগুলোর কারণে। আত্মনিমর্জন ও মানস সম্প্রসারণের আনুভূমিকতার কয়েকটি উদাহরণ :

১.নিশ্চিত তুহিনের সাথে শুয়ে কালো সার্ট পরা পুরনো অন্ধকার নিয়ে শেষ ট্রামে বাড়ী ফেরা কলকাতার ছেলের লম্বা চিঠিখানা এখনো তার পকেটে

উল্টোনো ঢোঁড়াই’ য়ের পাতা পড়ে থাকা লোটাকম্বল,লাতিন আমেরিকার কবিতা, আস্ত মিরোশ্লাভ হোলুব, চেশোয়াশ মিউশ আর ভাস্কো পোপার বাংলা (খসড়া : অজানা ার্কেস্ট্রার দেশে)

২. তিরিশের কবিতা, সিমবোরস্কার কুমারী ঠোঁটে কে প্রথম এঁকেছিল, চুমুর নরম… ক্যানভাসে ? রবীন্দ্রনাথের গানেও কি ভরে না মন আজকের মেয়েরা শুধু তারাদের পিছু ছুটতে চায়!

স্যাম্পেন না ঐ আকাশের তারা না এই পৃথিবীর। (স্যাম্পেন : অজানা অর্কেস্ট্রার দেশে)

৩. একদিন বৃষ্টির সন্ধ্যায় আমি বৃষ্টি হতে চেয়েছিলাম অমলকান্তি যেমন রৌদ্দুর হতে চেয়েছিল (আমার বিষন্ন বিষুব রেখা)

৪. সূর্যোদয় দেখব বলে সারারাত জেগে রাত্রির ঝরা আকাশ দেখে মনে হয়েছে আজ রাতে বৃষ্টি হবে না, ভিক্টোরিয়ার পরীটা ভিজবে না (পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে : পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

৫. ঢিলে শার্ট কোঁকড়ানো ভাঁজ পুশ্কিনের গল্প মুখস্ত বুদ্ধের মতো হৃদয়, নির্জনতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে তবু আমার পৃথিবীতে রোদের প্রচ্ছদে রোদ নিজেই মুড়ে দিতে চেয়েছিল তখন (নির্জনতা তবু ছুঁয়ে ছুঁয়ে : পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

স ম তুহিনের অনুভবে কবি আর কবিতা খুব পবিত্র কিছু। কিন্তু কেমন তারা ? কবির উত্তর :

‘কবিদের জাত ছাড়া পৃথিবীর সব জাত সুযোগ পেলেই হাঁটে সোজা পথ ছেড়ে’ (নির্ভুল রেখেছি খুঁজতে হয়নি : পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

‘সাদাসিদে চাঁদনিতে বাঁধা স্বপ্নেরা ছাড়া পেয়ে বুনে দেয় বীজ তুমি বলেছিলে, তুমি কবি নিশ্চিত।’ (পরিসর অপরিসরের চিরকুট : পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

শেষ পর্যন্ত পৌছনোর ক্ষমতা সবার থাকে না ফিকে রংয়ের টিকে থাকা হাসি কখনো কখনো আলোর অপরাধ অমার্জনীয় একমাত্র কবিতাই একচ্ছত্র শাষনকর্তা প্রিয় কবি, আচ্ছা আশা করতে দোষ কি! (মুঠোভরা অভিপ্রায় : পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

পরাবাস্তবতার নান্দীপাঠে কবি একা নন। তার প্রেমিকারাও যেনো লুটোপুটি জোছনা রাতের কুহক একেকজন। কবি বিশদ করেন না, কূলে অকূলে ঘুরে বেড়ানোর পরেও কবি নোঙর ছাড়া হন না শেষ পর্যন্ত। কবির প্রেম রহস্যের জটাজাল পেরিয়ে সহ্য আলোয় এসে দাঁড়ায় না কখনো। শব্দের শক্তি, প্রকৃতির রহস্যময়তা, নারীর লাস্য কোনটিকে কবি বেশি পছন্দ করেন, নাকি এই তিনের বৈরিতায় সৃষ্টি করে কবির কাক্সিক্ষত প্রেমিকা, নারী, নারীশ্বর ? অথবা শেষ পর্যন্ত কবির কাছে সেটি হয়ে ওঠে কবিতা, যেমন মাতৃত্ব, মা-ও :

১. ‘আমার মা ছিল গল্পের সুন্দরী আমি তাঁকে বলি, কবিতার দেশ আর উর্বশী চিরন্তন।’ (উর্বশী : অজানা অর্কেস্ট্রার দেশে)

‘রাতের শরীর যত্রতত্র ছুঁয়েও রাতটাকে চেনোনি, চাঁদ ভেঙেছি আমি

দূর পাহাড়ের চুড়োর পেটে চাঁদের ভ্রুণ ছিল সে চাঁদ ভেঙেছি আমি’ (চাঁদ ভেঙেছি আমি : অজানা অর্কেস্ট্রার দেশে)

২. ‘অনেকদিন পর একটা সুন্দর সকাল কে যেন এঁকে দিয়ে গেল তাকে চিনি না ! চিনলে বড় ভালো হতো ভ্রুভঙ্গীর ঈশারায় কী ইঙ্গিত হাতছানি দেয় বুঝে ওঠার আগেই কোথায় যায় ফিনফিনে বৃষ্টি না কুয়াশা তাকে চিনলে বড় ভালো হতো !’ (কে যেন এঁকে দিয়ে গেল : : পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

৩. ‘হৃদয়ে আমার অনেক লালন, একঝাঁক সন্ন্যাসীও করে বাস একসাথে ছত্রিশ জনকে ভালোবাসি আর চুমু দিই তোমার ঠোঁটে’ (মার্জিনে রেখেছি অনেক বেশি জায়গা : অগ্রন্থিত)

শুরুতে আমি স ম তুহিনের একটি দীর্ঘ ও সমগ্র কবিতার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করেছি। কবির দীর্ঘ কবিতাগুলো সমগ্রতা দিয়ে দেখা সম্ভব হলেও তার অপেক্ষাকৃত স্বল্পদৈর্ঘ্যের কবিতাগুলো ‘বহুরৈখিকতার এক তুমুল মহামারিতে’ আক্রান্ত বলে সমগ্রতা দিয়ে দেখা সম্ভব নয়। স ম তুহিনের কবিতায় কখনো কখনো এমন এক/একাধিক বাক্যের দেখা মেলে যেগুলো পাঠককে সফল ক্লিক করে। বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের পরিবর্তে তুহিন একাধিক জ্ঞানের রশ্মিকে অধিক মূল্য দিতে চান। এভাবে তিনি হতে চান সর্ব ও সত্যদ্রষ্টা। বলে রাখি তুহিনের এই প্রচেষ্টা একদিকে যেমন তার কবিতাকে সাম্প্রতিকের সাথে সংলগ্ন করেছে অন্যদিকে পাঠকও ঠিক ততখানি সম্পূর্ণ কবিতা পাঠের আনন্দ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। তারপরও এই প্রচেষ্টাগুলোকেই স ম তুহিনের একেবারেই নিজস্ব বলতে মন চায় :

১.‘তোমার লেখা কবিতা তুমি পড়লে ভরা জনসভায় তোমাদের প্রেসিডেন্ট তোমাকে চুমু খেয়েছিলো এখন সারা পৃখিবী তোমাকে চুমু খায়’ (আদোনিসের মন : অগ্রন্থিত)

২.‘ দিনের চেহারা রাতের চেহারা এক নয় জীবন মানেই অপূর্ব সম্পাদকীয়।’ (স্থিও নিশ্চিত : পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

৩. ‘খাঁচার টিয়ে নয়, বুকে আমার বুনো টিয়ের রং তবু ছেঁকে ছেঁকে আপন ভেবে জমিয়ে রাখি পলাতক সব পরাজয়’ (পলাতক সব পরাজয় : পাতাপড়া বনে পাখিদের পালক ঝরে)

দুটি কাব্যগ্রন্থে প্রায় দুই দশকের কবিতা সন্নিবেশিত হলেও সম্ভবত ধারাবাহিকতা রক্ষায় কবি এককেন্দ্রিকতার সম্পূর্ণ পরিহার করেননি। এটি হয়তো সম্ভবও ছিল না। তবু বিবিধ ভাবনার ও ভিশনের রূপ-রস-ঘ্রাণ তার কবিতায় সহজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ সর্বত্রগামিতার মহাসড়ক থেকে তিনি কখনই বিচ্যুত হতে চাননি, হননি। স ম তুহিনের কবিতা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি অনুভবের শতসানুদেশ হয়েও কবিতার পুঞ্জিত রস-ঘ্রাণ, কথার কলতান-কূজন, মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কল্পনার অনির্শেষ স্বাক্ষরে সময়নিষ্ঠ ও জীবনমুখী, জীবনঅন্বেষী। বাড়তি কথাকে পরিহার করে অসম্ভব আটসাঁট শব্দ বুননে যে কোনো বিষয়কে কবিতা করে তুলতে পারেন স ম তুহিন। কখনও খুব সাধারণ সপ্রশ্ন সকৌতুক-হালকা ভাষণ তাই অনায়াসে কবিতার অনন্য পংক্তি হয়ে নিজের জায়গা করে নিতে দেখা যায় কবি স ম তুহিনের কবিতায়।

অর্কেস্ট্রার সুর নিজের কাছে না হলেও পাঠকের কাছে কবি রহস্যাবৃত করে রাখতে চান, উদ্ভিদ ও প্রাণির প্রাণে একাত্ম জীবন অন্বেষণ তাকে শাণিত করে, স্বস্তি দেয়। তার পাঠককে ঠেলে দেয় জীবন জিজ্ঞাসার দিকে।