ফিচার

বিএনপি প্রার্থীদের ভোটে চিন্তায় ক্ষমতাসীনরা

By Daily Satkhira

May 23, 2018

ন্যাশনাল ডেস্ক: আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার টানা দুই মেয়াদে গত প্রায় সাড়ে ৯ বছরে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। অন্যদিকে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাজা ভোগ করছেন বিএনপির চেয়ারপারসন। আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগও আছে দলটির বিরুদ্ধে। তবু স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা বিপুলসংখ্যক ভোট পাচ্ছেন। এ নিয়ে চিন্তিত ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা। সর্বশেষ খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর লক্ষাধিক ভোট প্রাপ্তি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৬ মে গণভবনে ১৪ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের এক বৈঠকে তিনি তাঁর মনোভাব প্রকাশ করেন। বৈঠকে ১৪ দলের নেতারা বিএনপির বিপুল ভোটপ্রাপ্তির কারণ মূল্যায়নের পরামর্শ দেন। ১৪ দলের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

ক্ষমতাসীন জোটের ওই নেতাদের মতে, তৃণমূলে আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ড সরকারের প্রতি মানুষের অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলছে। বিএনপির আমলে শুরু হওয়া দুর্নীতি, লুটপাটের ধারা বন্ধ করতে সরকার তেমন সাফল্য দেখাতে পারেনি। প্রশাসনের সেবার মান নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়াতে হলে এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে।

১৪ দলের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মূলত বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে গত ১৬ মে সন্ধ্যায় গণভবনে ওই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। রাত সাড়ে ১০টার কিছু পর পর্যন্ত বৈঠক চলে। সমসাময়িক নানা বিষয়েও আলোচনা হয় সেখানে। একপর্যায়ে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সবাইকে একসঙ্গে নির্বাচন করতে হবে সেখানে। স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীকে পরাজিত করতে হবে। এই দেখেন, দেশের এত উন্নয়ন হলো, এর পরও মানুষ বিএনপিকে ভোট দিয়েছে। ওদের প্রার্থী এক লাখের ওপরে ভোট পেয়েছে। আপনারা শুধু প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে না থেকে যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচার করেন। আমাদের দলের নেতাকর্মীদের কোনো নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থাকলে সেগুলো লিখে রাখেন, আমাদের জানান।’

সূত্র মতে, বৈঠকে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, উন্নয়ন যথেষ্ট হয়েছে। এর পরও কেন বিএনপি এত ভোট পাচ্ছে সেটা মূল্যায়ন করা দরকার। সম্মিলিতভাবে আগামী নির্বাচনে লড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি ১৪ দলের শরিকদের মূল্যায়ন করার তাগিদ দেন। ন্যাপের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। প্রশাসনের সেবার মান বাড়াতে হবে। প্রশাসনের সেবার মান নিয়ে সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টি আছে।

১৪ দলের একাধিক নেতা গতকাল সোমবার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপির বিপুল ভোট পাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একধরনের দুশ্চিন্তা রয়েছে। বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্যেও বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু কিভাবে উত্তরণ করা যায় সে বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বৈঠকে।

জানা যায়, বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন ১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান ও পানিসম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, তরীকত ফেডারেশনের মহাসচিব নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, বাসদের আহ্বায়ক রেজাউর রশীদ খান, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের যুগ্ম আহ্বায়ক অসিত বরণ রায় প্রমুখ।

বিএনপির প্রার্থীরা কেন বিপুল ভোট পাচ্ছেন এবং ভোট বাড়াতে সরকারের করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বিএনপির বিপুল ভোট পাওয়ার বড় দুটি কারণ হলো—সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তৃণমূলে তেমনভাবে প্রচার হয় না। আর আওয়ামী লীগের নিচের স্তরের কর্মীদের নানা নেতিবাচক কাজ মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে রেখেছে।’

শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু উন্নয়ন দিয়ে মানুষের চাহিদা পূরণ হয় না। সাধারণ মানুষ কমপক্ষে তিনটি জিনিস চায়। প্রথমত, সুশাসন ও জবাবদিহি। শুধু কেন্দ্রে নয়, যেখান থেকে মানুষ সরকারি সেবা পায় সেখানে একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহি থাকা জরুরি। সরকার বিভিন্ন সেবা অনলাইনকেন্দ্রিক করে পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা করছে। তবে তা এখনো যথেষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি দূর করা। বিভিন্ন অফিস-আদালতে দুর্নীতিবাজদের দাপট রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে। তৃতীয়ত, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। ফলে জনমনে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে।’

বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পক্ষের সব ভোট বিএনপির ঘরে যাচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপির আমলে শুরু হওয়া লুণ্ঠন এখনো উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেনি। ন্যায়বিচার ও সুশাসনের অভাব আছে। মানুষের মন জয় করার জন্য যে ধরনের কর্মকাণ্ড দরকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তা পারেনি। ফলে জনগণের সন্তুষ্টি সেভাবে আসেনি। আর তৃণমূলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল একটা বড় সমস্যা।’

শিরীন আখতার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকার থাকবে নাকি স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায় থাকবে সেই ফয়সালা করার দিকে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ ছাড়া মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া, শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ রাখা, মানুষের জন্য অসহনীয় হয় এমন পরিস্থিতি তৈরি করা থেকে বিরত থাকতে হবে।’

দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘টানা ক্ষমতায় থাকলে সরকারের প্রতি মানুষের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠে। এ কারণে অনেকে বিরোধী পক্ষকে ভোট দেয়। আর বর্তমানে দেশে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী একটি বড় অবস্থান নিয়ে আছে। এদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য শাসক দলের জনগণের সঙ্গে যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার তারা তা পারছে না। তৃণমূল পর্যায়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দখলদারি এখনো চলছে। বিভিন্ন অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। ফলে তারা সরকারের উন্নয়ন ও ইতিবাচক কর্মকাণ্ডকে প্রাধান্য দিচ্ছে না।’

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্রে জানা যায়, ১৪ দলের শরিক দলগুলোর নেতারা আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির বিষয়ে শেখ হাসিনাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরামর্শ দেন।