নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরার মাদক ব্যবসায়ীরা দেশ ছেড়েছে কিন্তু মাদক ছাড়েনি। মাদকপাচার কিংবা মাদক ব্যবহার কোনোটাই ছাড়েনি তারা। সরকারের মাদকবিরোধী কঠোর অবস্থানের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছে সীমান্তের ওপারে। কেউ বৈধভাবে। আবার কেউ অবৈধপথে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে। আর সেখানে বসেই তারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযানের খোঁজ-খবর নিচ্ছে।
এদিকে মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদক কারবারিদের তালিকা অনুযায়ী তাদের বাড়িতে ও আড্ডাখানায় প্রায়ই হানা দিচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, মাদক কারবারিরা এখন গ্রেপ্তার এড়াতে বাড়ি ছেড়েছে। রাতদিন অভিযান চালিয়েও তাদের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। তবে অভিযানের মুখে মাদক চোরাচালান দৃশ্যত হ্রাস পেয়েছে।
সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মে মাসে সাতক্ষীরা জেলায় বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে এক হাজার ২৯৩ জন। এর মধ্যে মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত আসামি আছে ১৫২ জন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১২৯টি। এসব অভিযানে বিভিন্ন ধরনের বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার হয়েছে।
পুলিশের দাবি, মাদকবিরোধী অভিযানে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধ এবং মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। গত ২৩ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সাতক্ষীরায় এসব ঘটনায় পাঁচজন ‘মাদক ব্যবসায়ী’ নিহত হয়েছেন।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন কলারোয়া উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের ইয়াবা সম্রাট হিসেবে পরিচিত আনিসুর রহমান, কলারোয়ার দক্ষিণ ভাদিয়ালি গ্রামের ইউনুস আলী, সদর উপজেলার পরানদহা গ্রামের আবদুল আজিজ, ভোমরার খলিলুর রহমান পুটে ও শহরের মধু মোল্লার ডাঙ্গির এমদাদুল হক কারিগর।
এদিকে সাতক্ষীরায় মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তার এবং ক্রসফায়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা গা ঢাকা দিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে তারা পাসপোর্টে অথবা বিনা পাসপোর্টে দেশ ছেড়েছে। সীমান্ত এলাকার অধিবাসী হওয়ায় চোরাইপথে ভারতে যাওয়া তাদের জন্য অনেকটাই সহজ।
সূত্র বলছে, মাদক পাচার মামলায় ১৪ বছর জেল ভোগের পর বাড়ি ফিরে ফের মাদকে জড়িয়ে পড়া সদর উপজেলার বাঁশদহা ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের মিজানুর রহমান মাদক চক্রের ১০০ সদস্যের ‘গডফাদার’ এখন শতবিঘা জমির মালিক। ১১৮ টুকরা স্বর্ণসহ গ্রেপ্তার হওয়া সদর উপজেলার তলুইগাছা গ্রামের হাসান আলী, কলারোয়া উপজেলার কেড়াগাছি গ্রামের মাদক পাচারকারী ডন ইয়ার আলী, তাঁর ছেলে বহু ঘটনার নায়ক জাহাঙ্গীর, একই উপজেলার পাঁচপোতা গ্রামের মাদক চক্রের প্রধান মোটরসাইকেলচালক থেকে ধনাঢ্য হয়ে ওঠা হাসান, ফেনসিডিল পাচারের বহু মামলার আসামি সদর উপজেলার নারানঝোল গ্রামের মুজিবর রহমান, সদর উপজেলার কুশখালির রিপন, বহুবার মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কুশখালির আশরাফ হোসেন, তালতলার ঘাঘু চোরাচালানি জাহাঙ্গীর, সোনা ও মাদক পাচারের গডফাদার অগাধ ধনসম্পদের মালিক মনি ও তলুইগাছা গ্রামের রবিউল ইসলাম গা ঢাকা দিয়েছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার কুশখালি গ্রামের আবদার রহমান বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।
অপরদিকে কলারোয়া উপজেলার কেড়াগাছি ইউনিয়নের চারাবাড়ির আবুল কালাম ও লাল্টু গোয়েন্দা পুলিশের তাড়া খেয়ে সীমান্তের সোনাই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছে। বাড়ি ও আড্ডা ছেড়ে পালিয়েছে কলারোয়ার গাড়াখালির শীর্ষ চোরাচালানি আজহারুল ইসলাম, কেড়াগাছির আলিম ও বোয়ালিয়া গ্রামের পন্টু। তারা ভারতে চলে গেছে বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র বলছে, আলোচিত এসব মাদক কারবারি এত দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে নানাভাবে সমঝোতার মাধ্যমে বাড়িতে থেকে চোরাচালান চক্র পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান এবং বিশেষ করে ক্রসফায়ার এবং চোরাচালানিদের দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ কারণে অনেকেই ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নিয়েছে। তারা ভারতীয় এলাকায় থেকে তাদের মাদকচক্র পরিচালনা করছে বলে জানা গেছে।
সূত্র বলছে, মাদকসহ সব ধরনের চোরাচালান ও হুন্ডির সঙ্গে জড়িত কলারোয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী দুটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এখন পর্যন্ত নিজ নিজ এলাকায় হেসে খেলে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা কোনো না কোনোভাবে সমঝোতা করে রয়েছেন।
একইভাবে সদর উপজেলার ঘোনার আনিস এবং সীমান্তের অপর একটি ইউপির চেয়ারম্যান এখন পর্যন্ত টাকার জোরে নিজ বাড়িঘরে রয়েছেন।
এদিকে ক্রসফায়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় নিজ থেকে পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে জেলে গেছেন কলারোয়ার কেড়াগাছির আনারুল ইসলাম, তলুইগাছার সাজ্জাদ হোসেন কালুসহ বেশ কয়েকজন। তাঁরা বর্তমান পরিস্থিতিতে জামিন না নিয়ে জেলে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। আটকের পর তাঁরা কোনো জামিনের আবেদন করেননি।
সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মারুফ আহমেদ বলেন, ‘মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার হওয়ায় চোরাচালানিরা গা-ঢাকা দিয়েছে। তাদের এখন আর নিজ বাড়িঘর কিংবা চোরাচালানের ডেরায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
ওসি বলেন, ‘অভিযান অব্যাহত থাকায় চোরাচালান পণ্য আটকের পরিমাণও কমে গেছে। বিশেষ করে ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’