খেলার খবর: বিশ্বকাপ শুরুর আগেই দুই ফেভারিট বাদ। ইতালি ও নেদারল্যান্ডস। বাছাইপর্বের গেরোই যে পেরোতে পারেনি এ দুই ফুটবল পরাশক্তি! নিজেদের প্রথম ম্যাচ শেষে আরো চার ফেভারিটের অবস্থাও তথৈবচ। জার্মানি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও স্পেন। বর্তমান চ্যাম্পিয়নররা হেরেছে; শিরোপাপ্রত্যাশী বাকি তিন দলের শুরু ড্রয়ের হোঁচটে। এবারের আসর কি তবে হবে অঘটনের বিশ্বকাপ? নতুন কোনো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কি দেখা যাবে ২০১৮ সালে? এক যুগ পরই শতবর্ষের উৎসবে রঙিন হবে বিশ্বকাপ। এখন পর্যন্ত হয়েছে ২০টি আসর। তাতে চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুট আট দেশের। সর্বোচ্চ পাঁচবার ব্রাজিল। জার্মানি-ইতালি চারবার করে; দু’বার করে আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ে। আর ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-স্পেন শিরোপা জিতেছে একবার করে। প্রথম ১৫ আসরে শিরোপা জিতেছিল ছয় দেশ; শেষ পাঁচ আসরে যোগ হয়েছে নতুন দুটি। নতুনের আবাহন তাই সামপ্রতিক সময়েই প্রবল। পর্তুগাল বা বেলজিয়ামের মতো দলের স্বপ্নের প্রজাপতি কি তাহলে ডানা মেলার সুযোগ পাবে এবার?
কিন্তু ইতিহাসের পিঠেও তো ইতিহাস থাকে। যে কারণে আর্জেন্টিনা নিজেদের প্রথম ম্যাচ আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করার পরও আতলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আসা লোরেনসো সোলের উৎসাহে ভাটা পড়ে না, ‘১৯৯০ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে তো আমরা হেরেই গিয়েছিলাম ক্যামেরুনের কাছে। তারপরও ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছি। এবারও যদি ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারি, তাহলে যে কোনো কিছুই সম্ভব। ২৮ বছর আগে ম্যারাডোনা পারেননি বলে এবার যে মেসি পারবেন না, এমন তো কথা নেই।’ স্পার্তাক স্টেডিয়ামের বাইরের এই আর্জেন্টাইন সমর্থকের কথার প্রতিধ্বনি লুজনিঝিকে উলভার রাইখের উচ্চারণে। ইতিহাস স্মরণে রেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরও শরণ ইতিহাসে, ‘২০১০ আসরের প্রথম ম্যাচে যে স্পেন হেরেছিল, মনে আছে? জার্মানির পক্ষেও এবার শিরোপা জেতা তাই অসম্ভব মনে করি না।’
অঘটনের শুরু স্পেনকে দিয়ে, অবশ্য পর্তুগালের বিপক্ষে ড্রকে যদি অঘটন বলেন। টুর্নামেন্ট শুরুর কয়েকদিন আগে নানা ঘটনাপ্রবাহে বরখাস্ত করা হয় কোচ হুলেন লোপেতেগিকে। ‘আমাদের দলের অবস্থা অনেকটা আন্তেষ্টিক্রিয়ার মতো।’ নতুন কোচ ফের্নান্দো হিয়েরোর অধীনে পর্তুগালের বিপক্ষে শুরুতেই পিছিয়ে পড়ে তারা। কিন্তু দারুণ মানসিক জোর দেখিয়ে ম্যাচে দু’দুবার কেবল ফেরেননি স্পেন, এগিয়েও গিয়েছিল ৩-২ গোলে। শেষ মুহূর্তে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর অসাধারণ ফ্রি-কিকেই কেবল সোচিতে জয়বঞ্চিত হয় তাঁরা।
সত্যিকার অর্থে প্রথম বড় অঘটন পর দিন। স্পার্তাক স্টেডিয়ামে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ড্রতে। সেখানে আবার পেনাল্টি মিস করেন লিওনেল মেসি। আগের দিন নাচে-গানে-উল্লাসে মস্কোর রেড স্কয়ার দখল করে রেখেছিলেন যে আর্জেন্টাইন সমর্থকরা, পর দিন তাঁরা যেন হাওয়া ভোজবাজির মতো। কিন্তু এ যে অঘটনেরই বিশ্বকাপ! পরের ২৪ ঘন্টায় তা পের পাওয়া যায় আরো ভালোভাবে। লুজনিকিতে মেক্সিকোর কাছে হেরে যায় বর্তমান চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। এ নিয়ে টানা তৃতীয় বিশ্বকাপে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা পরের আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচ জিততে পারল না। ২০১০ সালে ইতালি ১-১ গোলে ড্র করে প্যারাগুয়ের সঙ্গে। আর ২০১৪ সালে নেদারল্যান্ডসের কাছে ১-৫ গোলে হেরে যায় নেদারল্যান্ডস। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ একবারই হেরেছিল জার্মানি; ১৯৮২ সালে আলজেরিয়ার বিপক্ষে। সেবার ফাইনাল পর্যন্ত ঠিকই ওঠে তারা। ওই ইতিহাস থেকে প্রেরণা নিতে পারে তাঁরা।
ওই দিনই কয়েক ঘন্টা বাদে নিজের প্রথম ম্যাচে জিততে পারেনি ব্রাজিলও। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে এগিয়ে গিয়েও ১-১ ড্রতে শেষ করে ম্যাচ। এ তিন দলের সমস্যা একই নয়। জার্মানির বিপক্ষে মেক্সিকো যেমন সমানে সমান লড়াই করে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। ব্রাজিলের বিপক্ষে সুইজারল্যান্ডও গুটিয়ে থাকেননি। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে আজের্হন্টিনা নেতিবাচকত ফুটবলের দায় দিতে পারে। কিন্তু অমন রক্ষণবাগ ভাঙতে না পারলে বিশ্বকাপ কিভাবে জিতবে তাঁরা!
তবে প্রথম ম্যাচ হারেই যে ফেভারিটরা সব পরিকল্পনা উল্টে ফেলবে, এমন নয়। বিশ্বকাপ তো আর ১০০ মিটার সিপ্রন্ট নয়, ম্যারাথন। প্রথম ল্যাপে পিছিয়ে পড়লেও শেষ হাসি হাসতেই পারে। লুজনিকির সংবাদ সম্মেলনে নিজের ট্রেডমার্কা কালো পোশাকে আসা জার্মানির কোচ ইওয়াখিম লোভ যেমনটা বলে গেলেন, ‘আমরা আমাদের পরিকল্পনা বদলাব না। যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলতে পারি, তাহলে আমাদের জয় এনে দেবার মতো ফুটবলার রয়েছে দলে। একটি ম্যাচ হেরেছি বলে আমরা ভেঙেচুরে যাব না। মাথা নষ্ট করে একেবারে উল্টাপাল্টা কিছু করব না। প্যানিক হওয়ার মতো কিছু হয়নি মোটেই।’
ড্রেসিংরুমে শিষ্যদের একই কথা নিশ্চয়ই বলেছেন লিওনার্দো বাক্কি তিতে ও হোর্হে সাম্পাওলিও। মেসি-নেইমার-ওজিল-কুতিনহো-দি মারিয়া-মুলারদের বিশ্বাসের ঘরেও নিশ্চয়ই ঘুণপোকা ধরেনি প্রথম ম্যাচে শেষেই।
তবু ভয় সমর্থকদের। তবু আশঙ্কা ফুটবল পিপাসুদের। এমন শুরুর পর কী চমক নিয়ে না জানি অপেক্ষায় আছে রাশিয়া বিশ্বকাপ! রাশিয়ার আকাশের মতো এখানেই যে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা। মস্কো থেকে কাল দুপুরে সেন্ট পিটার্সবার্গ নামার সময় তপ্ত রোদের অভ্যর্থনা যেমন বিকেলে ভিজে যায় বৃষ্টিতে। রাতের হিম হিমে।
বিশ্বকাপের আকাশে তো রোদ্দুরের অনেক রঙ থাকে। কত জাদুকরী মুভ, কত কত স্মরণীয় গোল, মহাকালে খোদাই হয়ে থাকা কতো রোমাঞ্চকর দ্বৈরথ! আবার রোদের মতো মেঘেরও তো অনেক রঙ। ট্রাজেজির কাব্যগাঁথাও তো কম লেখা হয়নি এ মঞ্চে। শুরুটা যেমন হলো, তাতে এবারের টুর্নামেন্ট না মেঘরঙা বিশ্বকাপই হয়ে যায়!