দেশের খবর: মাদকবিরোধী অভিযানের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ার চেষ্টা করবে সরকার। মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের প্রতি মানুষের সমর্থন দেখে সরকার উৎসাহবোধ করছে। তাই শিগগির দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান শুরু করার প্রস্তুতি চলছে। এ লক্ষ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি সংস্কারের। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করতে অনুমোদন করা হয়েছে নতুন ১০৬৮টি পদ। অনুসন্ধান ও তদন্ত ছাড়াও ঘুষ লেনদেনের সুনির্দিষ্ট সংবাদের ভিত্তিতে ফাঁদ পাতার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দুদকে থাকছে গোয়েন্দা ইউনিট ও রিজার্ভ শাখা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র মতে, প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটি গত ৪ জুলাই দুদকের জন্য নতুন পদ অনুমোদন দিয়েছে। এর আগে অনুমোদন দেয় জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়। বর্তমানে দুদকের জনবল এক হাজার ২৬৪ জন।
সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্রে জানা যায়, অনেকটা মাদকবিরোধী চলমান অভিযানের আদলেই দুর্নীতির বিরুদ্ধেও অভিযান চলবে। এর মাধ্যমে আর্থিক খাতের পাশাপাশি পুলিশসহ সরকারি প্রশাসনে লাগামহীন দুর্নীতির রশি টেনে ধরার চেষ্টা করবে সরকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ অভিযান শিগগির শুরু করা হবে। অভিযান চালাতে প্রয়োজনে সংস্কার করা হবে দুদকের বিদ্যমান আইন ও বিধি। কোন পদ্ধতিতে অভিযান চালানো হবে সে বিষয়টি নিয়ে এখন কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাসী। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছি। এরই মধ্যে অনেক আইন সংস্কার করে যুগোপযোগী করা হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে অভিযান চলছে। আগামীতে এ অভিযান আরো শক্তিশালী করা হবে। এ জন্য আইন সংস্কার প্রয়োজন হলে তাও করা হবে।’
দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, দুর্নীতি দমন সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। মাদক ও জঙ্গি দমনে সরকার যতটা কঠোর, দুর্নীতি দমনেও একই রকম কঠোর। এ কারণেই নতুন করে আরো কিছু পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
বিদ্যমান আইনে দুর্নীতি দমন সম্ভব কি না জানতে চাওয়া হলে দুদকের আইন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে আইন কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা প্রয়োগ ও মানুষের। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির ক্ষেত্রে সাজার জন্য বিভিন্ন আইন রয়েছে। দুর্নীতি প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধানও রয়েছে। তিনি দাবি করেন, গত বছর পুলিশের চেয়ে বেশি দুদকের মামলায় অপরাধীর সাজা হয়েছে। এ হার ৭০ শতাংশ।
জানা গেছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান কঠোর করার লক্ষ্যে দুদকের কয়েকটি বিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মামলা দায়ের, জরিমানা ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা সংক্রান্ত বিধিগুলো সংশোধনীর জন্য বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রয়েছে। যেকোনো সময় তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠবে। এ ছাড়া দুদকের যে কয়েকটি আইন ছড়ানো ছিটানো রয়েছে, সেগুলো একত্র করার উদ্যোগ চলছে। সম্প্রতি ভারতে দুর্নীতি দমনসংক্রান্ত কয়েকটি ছড়ানো ছিটানো আইন একত্র করে একটি আইনে পরিণত করা হয়েছে। সে আলোকেই বাংলাদেশেও তেমনটি করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
দুদকের নতুন পদ সৃষ্টির যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি। দেশের প্রকৃত আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য একটি সুশাসনভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা সরকারের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার, যা সরকারের ভিশন-২০২১-এ ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সচিব কমিটির সভায় আরো বলা হয়েছে, সরকার সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে ২০১২ সালে ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ প্রণয়ন করে। এ ছাড়া ‘প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১’-এ দুর্নীতিকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য দুদকের সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে।
দুদক কয়েকটি জেলা সমন্বয়ে ‘সমন্বিত জেলা কার্যালয়’ গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। নতুন জনবল নেওয়ার পর দুদক প্রায় সব জেলায় সতন্ত্রভাবে কাজ করবে। কমিশনের বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোতে রয়েছে এক হাজার ৭৩টি পদ। সুপারনিউমারিসহ মোট পদের সংখ্যা এক হাজার ২৬৪। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরো এক হাজার ৬৮টি পদ। এ অতিরিক্ত জনবলের জন্য বছরে ২১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। বর্তমানে কমিশনে ছয়জন মহাপরিচালক আছেন। আরো দুজন মহাপরিচালক যুক্ত হবেন। বর্তমানে পরিচালক রয়েছেন ১৯ জন, তাঁদের সঙ্গে আরো যোগ দেবেন ১৮ জন। ৮১ জন উপপরিচালকের সঙ্গে আরো ১১০ জন নিয়োগ পাবেন। নতুন পদ সৃষ্টির পর ১২৪ জন উপসহকারী পরিচালকের সঙ্গে যোগ দেবেন আরো ২৩৩ জন। এ ছাড়া পরিদর্শক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, প্রধান সহকারী, হিসাবরক্ষক, উচ্চমান সহকারী, ড্রাইভার, কনস্টেবলসহ মোট ৩৬টি পদে নতুন করে জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে।
সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট : আদালতে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হলেও তাদের সম্পদের কিছু হয় না। দুর্নীতিবাজদের সম্পদ যেন তার বংশধরদের কেউ ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট গঠন করা হচ্ছে। এই ব্যবস্থাপনা ইউনিট দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের তত্ত্বাবধানকারী হবে এবং রাষ্ট্রীয় খাতে জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া গ্রহণ করবে। এ ইউনিট কাজ করবে দুদক সচিবের তত্ত্বাবধানে। একজন পরিচালক, দুইজন উপপরিচালক, চার সহকারী পরিচালকসহ মোট ১১ জন এ ইউনিটে থাকবেন। বর্তমান কাঠামোতে এ ধরনের কোনো ইউনিট নেই।
রিজার্ভ শাখা : কমিশনের হঠাৎ জনবলের প্রয়োজন হয়। সেই জনবল সরবরাহ করতে পারে না কমিশন। বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনো বিষয়ের অনুসন্ধান, তদন্ত ও ঘুষ লেনদেনের সুনির্দিষ্ট সংবাদের ভিত্তিতে ফাঁদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কমিশন জনবল সরবরাহ করতে পারে না। এই সমস্যা দূর করার জন্য রিজার্ভ শাখা অনুমোদন করা হয়েছে। দুদক সচিবের তত্ত্বাবধানে কাজ করবে এ রিজার্ভ শাখা। ১৫ জন উপপরিচালক, ১৪ জন সহকারী পরিচালক, ২৭ জন উপসহকারী পরিচালকসহ মোট ৮৩ জন থাকবেন এ রিজার্ভ শাখায়।
গোয়েন্দা ইউনিট : দুর্নীতিবাজদের খুঁজে বের করার জন্য বর্তমানে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই, অভিযোগ অনুসন্ধান ও মামলা তদন্ত করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে সময় লাগে অনেক বেশি। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে নির্ভুল অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজের জন্য নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট গঠনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামোতে সচিবের অধীন একজন পরিচালক, তিনজন উপপরিচালকসহ মোট ১০টি নতুন পদ থাকছে।
আসামি গ্রেপ্তারকালে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখার জন্য দুদক সচিবের তত্ত্বাবধানে এনফোর্সমেন্ট শাখাও থাকবে। এ জন্য একজন উপপরিচালক, দুই সহকারী পরিচালকসহ মোট ২৬টি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
দুদকের চলমান মামলা বেড়েই চলেছে। এসব মামলা পরিচালনার জন্য ‘লিগ্যাল ও প্রসিকিউশন’ নামে একটি অনুবিভাগ রয়েছে। অনুমোদিত কাঠামোতে এ বিভাগ পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোতে সিস্টেম এনালিস্টের অধীন তথ্য-প্রযুক্তি সেল থাকলেও তা কাজ করছে অন্য অনুবিভাগের অধীন। দুর্নীতি অনুসন্ধানে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি সেলকে তথ্য-প্রযুক্তি শাখা হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে প্রশিক্ষণ শাখাকে যুক্ত করে একজন মহাপরিচালকের অধীনে থাকবে প্রশিক্ষণ ও তথ্য-প্রযুক্তি শাখা।
জনসংযোগ শাখাকে আপগ্রেড করা হচ্ছে। বর্তমানে এ কাজটি করছেন একজন উপপরিচালক। সংবাদপত্রে প্রকাশিত দুর্নীতিবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণের পর অনুসন্ধানে নামবে কমিশন। তথ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক কলাকৌশল অবলম্বন করে প্রেস ও মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য উপস্থাপন করার কাজটি করার জন্য একজন পরিচালকের অধীন দুজন উপপরিচালকসহ সাতটি নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে।