খেলার খবর: ৩২…১৬…৮…৪…২। কাউন্টডাউন চলছে এক মাস ধরে। চলবে আজ শেষ দিনের মতো। ৯০ মিনিট…১২০ মিনিট…বড়জোর টাইব্রেকার। ব্যস! ৩২ দল নিয়ে শুরু ফুটবল মহাযজ্ঞের পর্দা নামবে এরপর। চার বছরের জন্য এই সাম্রাজ্যের নতুন সম্রাট পেয়ে যাবে বিশ্ব। এখন সবার প্রতীক্ষা সেই মহারাজের অধিষ্ঠানের জন্য।
হয় ফ্রান্স। নয় ক্রোয়েশিয়া।
এমন এক ফাইনাল যে হবে, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে কেউ ভাবতে পারেননি। অন্যতম ফেভারিট হিসেবে ফ্রান্সের শেষ দ্বৈরথ পর্যন্ত টিকে থাকায় চমক নেই তেমন। কিন্তু তাদের প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া! কেউ ভাবেননি। কিন্তু ভাবনার করিডর দিয়েই যদি এগোবে বিশ্বকাপ, তাহলে আর তা অমন রোমাঞ্চ ছড়াবে কী করে! তাইতো জার্মানি বাদ পড়ে যায় প্রথম রাউন্ডে, আর্জেন্টিনা শেষ ষোলোতে, ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনালে। আর ক্রোয়েশিয়া ঠিকই উঠে আসে ফাইনালে। এবার রূপকথার পূর্ণতায় শিরোপা জয়ের উপলক্ষ লুকা মডরিচ-ইভান রাকিটিচ-মারিও মান্দজুকিচদের দলের সামনে।
কিন্তু ফ্রান্স কি আর ছেড়ে কথা বলবে! গৌরবের বিভা ছড়িয়ে ২০ বছর আগের বিশ্বকাপজয়ী বীরদের পাশে বসার সুযোগ তাদের সামনে। জিনেদিন জিদান, ফাবিয়ান বার্থেজ, লঁরা ব্লদের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দি হওয়ার হাতছানি পল পগবা, আন্তোয়ান গ্রিয়েজমান, কিলিয়ান এমবাপ্পেদের। তা কিভাবে হেলায় হারান তাঁরা!
ফ্রান্সের জন্য এই ফাইনালের আবহে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে ২০১৬ ইউরো। সেবারের ফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে সংশয়াতীত ফেভারিট ছিল দিদিয়ের দেশমের দল। কিন্তু বিস্ময়করভাবে নিজ দেশে হেরে যায় তারা। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে আজকের বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্সকে সবাই ফেভারিটের মুকুট পরিয়ে দিলেও তাতে প্রবল প্রত্যাখ্যান। ‘দুই বছর আগে ইউরোর ফাইনালে খেলা ৯ জন আছে। ওরা জানে, সেদিন কী হয়েছিল! কী দুঃখজনক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ওদের যেতে হয়েছিল’—কাল মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনে বলার সময়ও কোচ দেশমের মুখে বেদনার ছায়া। অধিনায়ক উগো লরি একটু আগে এসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন, ‘দুই বছর আগে ফাইনালের প্রতিপক্ষকে যেমন হালকাভাবে নিয়েছিলাম, এবার সে ভুল আর করব না।’
ক্রোয়েশিয়ার জন্য আজ হারানোর কিছু নেই। পুরোটাই প্রাপ্তির হাতছানি। নক আউট পর্বের তিনটি ম্যাচে ১২০ মিনিট লড়াই করে ফাইনালে এসেছে। দেশটির ৪০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে পারলে সবাই চলে আসে আজকের মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হতে। ঘটনার গুরুত্ব ফুটে ওঠে কাল সকালে বলা ক্রোয়েশিয়ার কোচ জ্লাতকো দালিচের কথায়, ‘গ্যালারিভরা স্টেডিয়ামে পুরো বিশ্বের সামনে খেলব আমরা। এখানে গুটিয়ে থাকার কিছু নেই বরং সময়টা উপভোগ করার। এটি আমাদের সবার জন্যই জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত। আমাদের দলের অনেকের চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জয়ের অভিজ্ঞতা আছে। তবে এ বিশ্বকাপ ফাইনাল সব ক্রোয়াটের জন্য। সেখানে নিজেদের সর্বোচ্চ দিতে আমরা প্রস্তুত।’ হেরে যাওয়া নিয়েও ভীত নন তিনি, ‘হারলেও তা মর্যাদার সঙ্গেই মেনে নেব। তার আগে চাই আমাদের দেশকে সবচেয়ে গৌরবময় অবস্থায় প্রতিনিধিত্ব করতে। বিশ্বকাপ জিতলে এত ছোট্ট দেশ থেকে আসা আমাদের চেয়ে গর্বিত কেউ হবে না। তা না পারলে প্রতিপক্ষকে অভিনন্দন জানাব। কারণ এটাই জীবন। এটাই ফুটবল।’
মাত্র ৯ মাস আগে দায়িত্ব নিয়ে ক্রোয়েশিয়াকে বদলে দিয়েছেন দালিচ। বাছাই পর্বে ধুঁকতে থাকা দলটিকে তুলে এনেছেন বিশ্বকাপ ফাইনালে। অধিনায়ক লুকা মডরিচ মাঠের অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টর হতে পারেন, তবে ওই সুর-তাল-লয়ের তো হয় সব কোচের মাথা থেকেই। মডরিচও তাই দালিচকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত, ‘কোচের প্র্রভাব তো দেখতেই পাচ্ছেন, আমরা এখন বিশ্বকাপ ফাইনালে। খুব কঠিন সময়ে তিনি দলের দায়িত্ব নেন। আমাদের বিশ্বকাপ খেলা ছিল ঝুঁকির মধ্যে। তিনি আমাদের সবার সঙ্গে কথা বলে সবার ভেতরে আত্মবিশ্বাস গুঁজে দেন। তাঁর অধীনে ইউক্রেনের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে আমরা জিতি। পরে বিশ্বকাপে খেলারও যোগ্যতা অর্জন করি। এটাই দলে দালিচের প্রভাব। দলে তিনি স্থিরতা এনেছেন। তাঁর মনোযোগ, কাজের ধরন, প্রত্যেক খেলোয়াড়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি—সব আমার পছন্দ। শুধু কোচ নয়, মানুষ হিসেবেও তিনি দারুণ।’
দালিচ এরই মধ্যে রূপকথার নায়ক। দিদিয়ের দেশমের সামনেও অমরত্বের হাতছানি। ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারলে মারিও জাগালো ও ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পর তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে অধিনায়ক ও কোচের ভূমিকায় জিতবেন বিশ্বকাপ।
প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে এখন পর্যন্ত পাঁচবার মুখোমুখি হয়েছে এই দুই দল। সেখানে ফ্রান্সের তিন জয়; বাকি দুই ম্যাচ ড্র। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে পিছিয়ে থেকেও ক্রোয়েশিয়াকে হারায় ফরাসিরা। এই পিছিয়ে থাকার ব্যাপারটায় এই বিশ্বকাপে বড্ড অভ্যস্ত ক্রোয়াটরা। নক আউট পর্বের তিনটি ম্যাচই পিছিয়ে থেকেও শেষ হাসি তাদের। অন্যদিকে পুরো টুর্নামেন্ট মিলে ফ্রান্সের মোট পিছিয়ে থাকা ১০ মিনিটও নয়। অবশ্য আজকের রেফারির শেষ বাঁশির পর কোন দল এগিয়ে থাকে, কোন দল পিছিয়ে—সেটিই এখন মুখ্য।
বিশ্বকাপ রংধনুর কত রং খসে পড়েছে এরই মধ্যে! আজ ঝরবে সর্বশেষটি। টিকে থাকবে কেবল ফ্রান্সের নীল অথবা ক্রোয়েশিয়ার লাল-সাদা। হয় ফরাসি সৌরভে মাতোয়ারা হবে ফুটবলবিশ্ব, অথবা ক্রোয়াট ফুটবল রূপকথা পাবে পূর্ণতা। কী যে হবে, ফুটবল দেবতা ছাড়া তা আর জানেন কে!