নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘যে রাজা আগে পুরো বাড়িতে রাজত্ব করে বেড়াতো, বাড়ি জুড়ে যে চঞ্চল পায়ে ঘুরে বেড়াতো সেই রাজা এখন একেবারেই চুপ। এক কথা কয়েকবার জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয়, আর কাটা হাত, কাটা পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলের এ তাকানো আমাদের অন্তর খালি করি দেয়!’ – বলছিলেন সাতক্ষীরার নলতা উপজেলার মাছ ব্যবসায়ী মো. মোকাররম হোসেন। তিনি জানান, আসল পা হারালেও কৃত্রিম পা নিয়ে ছেলে বাড়ি যেতে পারছে, এতেই খুশী রাজার পরিবার। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চারতলায় দাঁড়িয়ে মোকাররম হোসেন আরও বলেন, ‘১১ হাজার ভোল্টেজের তারে জড়াইয়া আমার ছেলেটা আজ হাত-পা হারা।’ বার্ন ইউনিটের চার তলায় প্রকল্প পরিচালক ডা. সামন্ত লাল সেনের কক্ষে ঢুকতেই দেখা গেল, ডান হাত আর বাম পা হারানো শিশু রাজা বসে আছে চেয়ারে। আর বাবা মোকাররম হোসেন ছেলে রাজার বাম পায়ে কৃত্রিম পা পরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। আর তাকে সাহায্য করছেন আরেক ছেলে বাদশা। একসময় রাজার বাম পায়ে কৃত্রিম পা পরিয়ে ছেলেকে হাঁটানোর চেষ্টাও করেন তিনি। গুটি গুটি পায়ে কৃত্রিম পা নিয়ে রাজা হেঁটে চলে, তবে তার মুখে নেই হাসি আর মায়ের চোখ তখন জলে ভরা। কৃত্রিম পা নিয়ে ভাইয়ের হাঁটার দৃশ্য মোবাইলে ক্যামেরাবন্দি করছিল রাজার বড় ভাই, ১০ বছরের বাদশা। রাজার হাত এবং পা কি করে দুর্ঘটনায় পড়লো, জানতে চাইলে বাবা মোকাররম হোসেন বলেন, ‘গত কুরবানির ঈদের দুইদিন আগে ছেলেটা সবার অগোচরে নানা বাড়ির ছাদে ওঠে, সেখানেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। হঠাৎ এক ভ্যানওয়ালার চিৎকার শুনি, কার ছেলে তারে আটকাইয়া আছে। দৌড়াইয়া ছাদে গিয়া দেখি, আমারই ছেলে- আমার রাজা তারে জড়াইয়া আছে। তক্তা (কাঠ) দিয়ে পিটায়ে ছেলেকে ছাড়াইলাম, তখন ছেলের দম ছিল কী ছিল না। তারপর নলতা হাসপাতাল, সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে অ্যাম্বুলেন্সে করে সাতক্ষীরা গেলাম। কিন্তু সেখানেও ডাক্তাররা বললো, তারা কিছু করতে পারবে না। সেখান থেকে খুলনা হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানো হলো। কিন্তু সেখানেও তার চিকিৎসা করানো গেল না। সেদিনই ঢাকায় চলে এলাম ছেলেকে নিয়ে।’ ‘কিন্তু ডান হাত এবং বাম পায়ের অবস্থা খারাপ হওয়াতে এখানে তার অপারেশন করে সেগুলো কেটে ফেলতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা। এখানে আসার পর ডাক্তাররা খুব গুরুত্ব দিয়ে আমার ছেলের চিকিৎসা করছেন।’ বলেই কেঁদে ফেলেন পাঁচ সন্তানের জনক মোকাররম হোসেন। তিনি আরও বলেন, ‘এখানকার ডাক্তাররা আমার ছেলের জন্য যা করছে, তাতে আমি তাদের কাছে সারাজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম, তাদের ঋণ আমি কোনওদিন শোধ করতে পারবো না। অনেক ওষুধ আমরা ফ্রি পাইছি, আর শেষে একটা পা (কৃত্রিম পা) দিয়েও সাহায্য করছেন স্যার (ডা. সামন্ত লাল সেন)। মোকাররম হোসেন যখন কাঁদছেন, তখন পাশেই তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগমও চোখ মুছছিলেন। মোকাররম হোসেন বলেন, ‘আমি খুবই গরীব মানুষ। গত তিন মাস এখানে ছিলাম,একদিনের জন্যও ছেলেকে রেখে দেশে যাইনি, ব্যবসাপাতি সব গেছে। এখন ভিক্ষা করা ছাড়া আমার কোনও গতি নাই। কী করে বউ-বাচ্চা নিয়ে দিনাতিপাত করবো সেটাই চিন্তা।’ রবিবার রাজাকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কৃত্রিম পা দিয়ে সে এখন হাঁটতে পারবে, সমাজে ছেলেটাকে ‘খোড়া’ বলে পরিচিত হতে হবে না।” কৃত্রিম পায়ের মতো ডান হাতও লাগানো যাবে, কিন্তু সেজন্য অনেক টাকা প্রয়োজন, যা রাজার পরিবারের নেই। মোকাররম হোসেন বলেন, ‘একটা হাত লাগাতে অন্তত ২ লাখ টাকা প্রয়োজন। দেশের এতো এতো ধনী, কেউ যদি আমার ছেলেকে একটা হাত লাগানোর টাকা দিতো, তাহলে ছেলেটা কিছু করে খেতে পারতো। নয়তো এক হাত দিয়া এই ছেলে কীভাবে জীবন কাটাবে আর আমরাই বাবা-মা হিসেবে সেটা কেমনে দেখমু।’ ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে দেশের অনেক মানুষ এভাবে অঙ্গহারা হচ্ছে। গত ২০ বছর ধরে সমাজের অনেকেই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করেছে এসব মানুষদের জন্য কৃত্রিম অঙ্গ দিয়ে। আমি কেবল এখানে একটি সেতুবন্ধনের কাজ করেছি রাজাকে কৃত্রিম পা দিয়ে। তবে আরও মানুষেরা যদি এসব মানুষের সহায়তায় বার্ন ইউনিটে কৃত্রিম হাত-পা কিনে দিয়ে সহযোগিতা করতো, তাহলে এসব মানুষেরা সামাজিকভাবে একটু হলেও ভালো থাকতো, ভালো থাকতো নিজেদের জীবনেও।’