দেশের খবর: দিয়া খানম মিম ও আব্দুল করিম রাজুরাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দিয়ে হত্যা করা বাসচালক মাসুম বিল্লাহ, মো. এনায়েত হোসেন, মো. সোহাগ আলী, রিপন হোসেন ও মো. জুবায়েরের অপরাধ প্রমাণিত হলে তাদের সর্বোচ্চ তিন বছর সাজা হতে পারে। মর্মন্তুদ এ ঘটনায় দায়ের করা মামলা হত্যা নয়, দুর্ঘটনা হিসেবে দণ্ডবিধি ২৭৯ ও ৩০৪ (খ)-তে রেকর্ড করেছে পুলিশ। এসব ধারায় সর্বোচ্চ এই শাস্তির কথা বলা হয়েছে। আইন অনুযায়ী এর বেশি সাজা হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। গত রবিবার (২৯ জুলাই) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবন্দর সড়কের র্যাডিসন হোটেলের বিপরীতে কালশী থেকে বিমানবন্দরগামী জাবালে নূর পরিবহনের একাধিক বাস প্রতিযোগিতা করে যাত্রী তুলতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের চাপা দেয়। এতে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল করিম রাজু নিহত হন। আহত হন অন্তত ১২-১৩ জন শিক্ষার্থী। ঘটনার দিন থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনে অনেকটা অচল হয়ে পড়েছে রাজধানী। এ ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিহত মিমের বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি দণ্ডবিধি ২৭৯ ও ৩০৪ (খ) ধারায় রেকর্ড করা হয়েছে। এসব ধারা অনুযায়ী শাস্তি হবে সর্বোচ্চ তিন বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড কিংবা সর্বনিম্ন এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। আইন অনুযায়ী দুর্ঘটনার জন্য দণ্ডবিধিতে তিন রকমের বিধান আছে। নরহত্যা হলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের সাজা হবে। খুন না হলে ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটালে ৩০৪ (খ) ধারা অনুযায়ী তিন বছরের কারাদণ্ড হবে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে কাউকে নিহত বা আহত করলে দণ্ডবিধি অনুযায়ী সাজা হবে। কিন্তু এটি হত্যা মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়নি। তবে এই মামলাকে দুর্ঘটনার হিসেবে না নিয়ে হত্যা মামলার ধারা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দাবি জানিয়েছেন মামলার বাদী নিহত শিক্ষার্থী মিমের বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি এমন তথ্য জেনে হতবাক হন। তিনি বলেন, ‘এই মামলা কোনোভাবেই পুলিশ দুর্ঘটনার মামলা হিসেবে রেকর্ড করতে পারে না। এটা হত্যা মামলা হতে হবে। চালকের শাস্তি ফাঁসি হতে হবে। যদি তিন বছর শাস্তি হয় তাহলে আমরা কষ্ট পাবো।’ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আসলে এই ধারা সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে আগামী রবিবার কোর্টে যাবো। সেখানে আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করবো।’ দণ্ডবিধির ৩০৪ (খ) ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি বেপরোয়া যান চালিয়ে বা অবহেলাজনকভাবে জনপথে যান চালিয়ে কারও মৃত্যু ঘটায়, তাহলে দায়ী চালককে তিন বছর পর্যন্ত যেকোনও মেয়াদের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। এ ছাড়া মোটরযান আইনে বলা হয়েছে, বেপরোয়া বা বিপজ্জনক গাড়ি চালানোর শাস্তি হচ্ছে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০০ টাকা জরিমানা। এর সঙ্গে গাড়ি চালনার লাইসেন্সও নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। একই অপরাধ একই চালক তিন বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার করলে ছয় মাস কারাদণ্ড কিংবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে। সঙ্গে গাড়ি চালনার লাইসেন্সও এক মাস পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাপস কুমার পাল বলেন, ‘বর্তমানে দুর্ঘটনায় যত মামলা হচ্ছে সবগুলোই দণ্ডবিধি ৩০৪ (খ) ধারায় হচ্ছে। এই মামলায় দোষ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ তিন বছর সাজা হতে পারে। পাশাপাশি অর্থদণ্ডের বিধানও আছে। এই ধারা জামিন ও আপসযোগ্য। তবে বর্তমানে আমরা জামিন দিই না। পুলিশ চাইলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মামলা রেকর্ড করতে পারে। এই ধারা অনুযায়ী রেকর্ড হয় না বিধায় চালকরা পার পেয়ে যায়। সে কারণেই আজ সড়কের এমন অবস্থা।’ ক্যান্টনমেন্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহান হক বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার দুটি ধারায় মামলাটি রেকর্ড হয়েছে। এরমধ্যে প্রধান ধারা হচ্ছে ২৭৯ ও ৩০৪ (খ)। ওই মামলায় ৩০২ ধারায় রেকর্ড করার কোনও সুযোগ নেই। কারণ, এই ধারায় রেকর্ড করতে হলে অবশ্যই সেটায় অভিযুক্ত ব্যক্তির খুনের উদ্দেশ্য থাকতে হবে। খুনের জন্য পরিকল্পনা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটেনি।’ বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আইন অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনার মামলাগুলো ৩০২ ধারায় রেকর্ড করতে হবে। অতীতেও এমন হয়েছে। এই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু চালকদের সংগঠনগুলোর চাপের কারণে সরকার ৩০৪ ধারায় মামলা রেকর্ড করছে। যে কারণে চালকরা একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটিয়েই যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এভাবে তাজা প্রাণ ঝরছে, কিন্তু চালকরা সাজা পাবে তিন বছর। এখন কেউ যদি কাউকে গাড়িচাপা দিয়ে খুন করে তাহলে তারও সাজা হবে তিন বছর। এতে চালকরা আশকারা পাবে।’ উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের আগস্টের দিকে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দুর্ঘটনার মামলাগুলো ৩০২ ধারার পরিবর্তে ৩০৪ ধারায় করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।