জাতীয়

‘ন্যায় বিচার চাই’

By daily satkhira

August 03, 2018

দেশের খবর: ‘ন্যায় বিচার চাই’‘নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘উই আর স্টুডেন্ট, নট টেরোরিস্ট’— এরকম বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড আর কাগজ নিয়ে বৃহস্পতিবার দিনভর রাজপথে ছিল হাজারো শিক্ষার্থী। আগেই সারাদেশের স্কুল ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। তারপরও কোন শিক্ষার্থীকেই ঘরে আটকে রাখা যায়নি। স্বত:স্ফুর্তভাবে শিক্ষার্থীরা রাজধানীর প্রতিটি রাস্তায় নেমে আসে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী বৃষ্টির মধ্যে রাজপথে বসে মিছিল শ্লোগান দিতে থাকে। পাশাপাশি রাস্তায় চলাচল করা প্রতিটি গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করে তবেই ছেড়েছে। যেসব গাড়ি বা চালকের বৈধ কাগজপত্র ছিল না তাদের পুলিশ সার্জেন্টের কাছে নিয়ে মামলা দিতে বাধ্য করেছে এই শিক্ষার্থীরা। তারা সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। তবে বৃহস্পতিবার কোন সহিংসতা ছিল না। শুধুমাত্র সায়েন্স ল্যাবটেররি মোড়ে ছাত্রদের সঙ্গে এক সার্জেন্টের তর্কাতর্কির জেরে তার মটরসাইকেলটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিল ঘুষিতে আহত হয়েছেন ওই সার্জেন্ট। অপরদিকে মিরপুরে পুলিশের সঙ্গে লাঠি হাতে কিছু যুবক ছাত্রদের নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে। স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছেন সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্পীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। অনেক এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও স্কুল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাজপথে বসে ছিলেন। ছিলেন বহু অভিভাবকও। তারা কোমলমতি এসব শিক্ষার্থীকে খাবার-পানি কিনে দিয়েছেন। সাধারণ মানুষও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে বলেছেন, এদের দাবি যৌক্তিক। গত কয়েকদিনের বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে সরকার দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গতকাল বৃহস্পতিবার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। স্কুল বন্ধ থাকলেও গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর অন্তত ২৫টি পয়েন্টে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে বিক্ষোভ করছে। ফলে গত তিন দিনের মতই গতকাল ঢাকার বিভিন্ন সড়কে পাবলিক পরিবহন রাস্তায় নামাননি মালিকরা। বিআরটিসির কিছু বাস চলাচল করেছে। প্রাইভেট যানবাহন স্বাভাবিকভাবে চলাচল করলেও পরিমানে ছিল কিছুটা কম। পায়ে হেঁটে চলা মানুষও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে গেছেন। অনেকেই রাজপথে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটান, সমর্থন দেন। জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় গত ২৯ জুলাই কুর্মিটোলায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর থেকেই শিক্ষার্থীদের এ বিক্ষোভ চলছে। গত দুই দিনে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে অনান্য শহরেও। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাইরে বহু এলাকায় সড়কে নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। বেশিরভাগ জায়গায় দুর পাল্লার বাসও চলাচল করেনি। বিক্ষোভে গেলে টিসি দিয়ে দেওয়া হবে- স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এমন এসএমএস পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন কয়েকজন অভিভাবক। এসব হুমকি আমলে না নিয়েই সকাল ১০টার পর থেকে বিভিন্ন এলাকার ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নামতে থাকে। রাজধানীর উত্তরা, মহাখালী, মগবাজার, শাহবাগ, রামপুরা, ফার্মগেইট, মানিক মিয়া এভিনিউ, আসাদগেইট, ধানমন্ডি, মিরপুর রোড, খিলগাঁও, মালিবাগ, শান্তিনগর, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা আগের দিনের মতই মিছিল করেছে এবং গাড়ি থামিয়ে চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করছে। পুলিশের ভূমিকায় তাদের এই পরীক্ষা থেকে পুলিশের গাড়িও ছাড় পায়নি। সরকারের উর্ধ্বতন ব্যক্তিদের গাড়ির কাগজও তারা পরীক্ষা করেন। সাত রাস্তার দিক থেকে সচিবালয়ে যাওয়ার সময় মগবাজারে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে পড়ে সরকারি একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার গাড়ি। তিনি বেরিয়ে এসে বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়গুলো তিনি মন্ত্রিসভায় তুলবেন। তখন হাততালি দিয়ে তাকে যেতে দেয় শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভকারীদের অধিকাংশের পরনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইউনিফর্ম দেখা গেছে। তবে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় অনেকে সাধারণ পোশাকেও এসেছিল। পুলিশের গাড়ি আটকানোর চেষ্টার সময় কারও কারও মুখে কাপড় পেঁচিয়ে রাখতেও দেখা গেছে। বিক্ষোভকারীদের হাতে দেখা গেছে- ‘নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘উই আর স্টুডেন্ট, নট টেরোরিস্ট’— এরকম বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড ও টুকরো কাগজ। রাস্তায় গোল হয়ে বসে সুরে সুরে স্লোগান দিতেও দেখা যায় কাউকে কাউকে। তাদের অনেকে পোশাক ঘামে-বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। এদিকে ভ্রুপক্ষেপ নেই, মুুখে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকার প্রত্যয়। সকালে টঙ্গী কলেজগেট এলাকায় ময়মনসিংহ রুটের দু’টি বাস ভাঙচুরের শিকার হয়। মাইলস্টোন কলেজ, উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রমিজউদ্দিন কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম পড়া শিক্ষার্থীরা অল্প সময়ের মধ্যে উত্তরা এলাকার রাস্তার দখল নেয়। উত্তরার জসিমউদ্দিন মোড়ে একটি পিক-আপ ভ্যান ভাংচুরের শিকার হলে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেলা ১১টার দিকে খিলক্ষেত আর ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের সামনের রাস্তাও ছিল শিক্ষার্থীদের দখলে। পুরো এলাকা চলে যায় শিক্ষার্থীদের দখলে। কুড়িল বিশ্বরোড, খিলক্ষেত দিয়ে বহু মানুষ তখন হালকা বৃষ্টির মধ্যে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যের দিকে যাচ্ছিলেন। শাহবাগে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে শুরু করে সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকেই। হাতে হাত বেঁধে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শাহবাগ মোড়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ধীরে ধীরে ছাতা হাতে জমায়েত বাড়তে থাকে। চলতে থাকে স্লোগান। মুন্সী আবদুর রউফ রাইফেলস কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ, নটরডেম কলেজ, ক্যামব্রিয়ান কলেজের পোশাক পরা শিক্ষার্থীদের দেখা যায় শাগবাগে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মাইক নিয়ে আসে আন্দোলনকারীরা। সেখানে ঘোষণা দেওয়া হয়— ‘আমরা সিঙ্গেল লাইনে গাড়িগুলো ছাড়ব। গাড়ির লাইসেন্স থাকলে তারপর যেতে দেব।’ ওই সময় শাহাবাগ দিয়ে যাওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স যারা দেয় তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ঢাকা শহরের সকল যানবাহন হবে পাবলিক। সরকার পরিচালনা করবে সেগুলো। এই আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে।’ ইমপেরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা বেলা সাড়ে ১০টার দিকে রামপুরায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে বিভিন্ন যানবাহন থামিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করতে শুরু করলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মেরুল বাড্ডা থেকেই যানবাহন ঘুরিয়ে দেয় পুলিশ। খিলগাঁও রেলগেইট থেকে মালিবাগ রেলগেইট পর্যন্ত বাস আটকাতে দেখা যায় খিলগাঁও ন্যাশনাল আইডিয়াল, খিলগাঁও গভার্মমেন্ট বয়েজ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের মালিবাগ মোড় থেকে শান্তিনগর মোড় পর্যন্ত জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে দেখা যায় বেলা ১১টার দিকে। ফলে কাকরাইল থেকে শান্তিনগর হয়ে মালিবাগ পর্যন্ত পুরো রাস্তা অচল হয়ে যায়। ফ্লাইওভারের ওপরে গাড়ি আটকে থাকতে দেখা যায়। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে বেলা ১২টার দিকে। রহিমা খাতুন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা কোনো কথা বলব না। আমাদের কোনো নেতা নাই। আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমরা ন্যায় বিচার চাই।’ মহাখালীর রেলগেইট এলাকায় বিএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। তারা রেল লাইনের দুইপাশে এবং সাতরাস্তা থেকে আমতলী যাওয়ার দুই দিকের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে গাড়ি আটকে চালক ও গাড়ির লাইসেন্স দেখছিলেন। কাগজ দেখাতে না পারলে গাড়ি পাঠাচ্ছিলেন পুলিশের কাছে। অনেক গাড়ির বনেটে বা গায়ে মার্কার কলম দিয়ে তাদের ‘উই ওয়ান্ট জার্স্টিস’ লিখে দিতে দেখা গেছে।