ফিচার

সাতক্ষীরায় পানিফল চাষঃ সোনালি সম্ভাবনা

By daily satkhira

December 02, 2016

পানিফল একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। এর ইংরেজি নাম ডধঃবৎ পযবংঃহঁঃ এবং উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ঞৎধঢ়ধ নরংঢ়রহড়ংধ। পানি ফলের আদিনিবাস ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা হলেও এর প্রথম দেখা পাওয়া যায় উত্তর আমেরিকায়। জানা যায় যে, প্রায় তিন হাজার বছর পূর্ব থেকেই চীনদেশে পানিফলের চাষ হয়ে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলায় পানি ফলের বাণিজ্যিক ভাবে চাষ শুরু হয়েছে। পানিফল একটি বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। জলাশয় ও বিল-ঝিলে এ ফলটি জন্মে। এর শেকড় থাকে পানির নিচে মাটিতে এবং পাতা পানির উপর ভাসতে থাকে। এক একটি গাছ প্রায় পাঁচ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পানি ফলের আরেক নাম ‘শিংড়া’। ফলগুলোতে শিংয়ের মতো খাঁজকাটা থাকে বলেই এরকম নামকরণ হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। কোথাও কোথাও একে ‘পানি সিংগাড়া’ নামেও ডাকা হয়। ফলচাষ শুরু হয় ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এবং ফল সংগ্রহ করা হয় অগ্রহায়ন -পৌষ মাসে। পানিফল কচি অবস্থায় লাল, পরে সবুজ এবং পরিপক্ক হলে কালো রং ধারন করে। ফলটির পুরু নরম খোসা ছাড়ালেই পাওয়া যায় হৃৎপিন্ডাকার বা ত্রিভুজাকৃতির নরম সাদা শাসঁ। কাঁচা ফলের নরম শাসঁ খেতে বেশ সুস্বাদু। প্রতি ১০০ গ্রাম পানিফলে ৮৪.৯ গ্রাম পানি, ০.৯ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ২.৫ গ্রাম আমিষ, ০.৯ গ্রাম চর্বি, ১১.৭ গ্রাম শর্করা, ১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮ মিলিগ্রাম লৌহ, ০.১১ মিলি গ্রাম ভিটামিন বি-১, ০.০৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-২ ও ১৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। তাছাড়া এ ফলে ৬৫ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি থাকে। পানিফলে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম রয়েছে। দেহের প্রয়োজনীয় খনিজ লবণগুলোর মধ্যে ক্যালসিয়াম অন্যতম। ফসফরাসের সহযোগিতায় শরীরের হাড় ও দাঁতের গঠন এবং মজবুত করা ক্যালসিয়ামের প্রধান কাজ। লৌহ অত্যন্ত জরুরি একটি খনিজ লবন। লৌহের অভাবে মানবদেহে অপুষ্টিজনিত রক্তশূণ্যতা দেখা দেয়। ছোট ছেলেমেয়েরা এবং গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েরা অতি সহজে রোগের শিকার হয়। পানি ফলে যথেষ্ট পরিমাণে লৌহ পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম পানি ফলে ভিটামিন ‘সি’ এর পরিমান ১৫ মিলিগ্রাম। আর শসাতে আছে ভিটামিন ‘সি’ মাত্র ৫ মিলি গ্রাম। ভিটামিন ‘সি’ শরীরে চামড়া, দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় অপরিহার্য। তাছাড়া ভিটামিন ‘সি’ অস্ত্রে লৌহ শোষণে সাহায্য করে। বাংলাদেশের শতকরা ৯৩ ভাগ পরিবার ভিটামিন ‘সি’ এর অভাবে ভুগছে। খাদ্যে ভিটামিন ‘সি’ এর ঘাটতি বিবেচনা করে এ ফলের প্রতি আমাদের অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পানি ফল কাঁচা খাওয়া হয়, তবে সিদ্ধ করেও খাওয়া যায়। কাঁচা পানিফল বলকারক দুর্বল ও অসুস্থ মানুষের জন্য সহজপাচ্য খাবার। ফলের শুকনো শাঁস রুটি করে খেলে এলার্জি ও হাত-পা ফোলা রোগ উপশম হয়। পিওপ্রদাহ, উদরাময় ও তলপেটের ব্যথ্যা উপশমে পানিফল খাওয়ায় প্রচলন রয়েছে। বিছাঁ পোকা কামড়ের যন্ত্রনায় থেঁতলানো কাঁচা ফলের প্রলেপ দিলে  উপকার পাওয়া যায়। পানিফল খুব লাভজনক একটি ফসল। এর উৎপাদন খরচ খুব কম। সাতক্ষীরা জেলার সদর, কলারোয়া, দেবহাটা, কালিগঞ্জ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় জলাবদ্ধ এলাকার চাষিরা পানিফল চাষ করে অধিক লাভবান হচ্ছেন। ফলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ ফলের চাষ। জানা যায়, এ বছর জেলায় ৭১ হেক্টর জমিতে পানি ফলের চাষ হয়েছে। সুস্বাদু ও পুষ্টিকর এ ফল সবার কাছে পরিচিত না হলেও ক্রমশঃ এ ফলের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়কের দু’ধারে চোখে পড়ে এই পানিফল। এ জেলার হাটবাজারে ও ফুটপাতে ছাড়াও ক্ষেত থেকে তুলে মহাসড়কের ধারে পানিফল বিক্রি করতে দেখা যায় ব্যবসায়ীদের। প্রতি কেজি পানিফল স্থানভেদে ১০-১৫ টাকায় বিক্রি হয়। সাতক্ষীরায় উৎপাদিত ফলটি এখন জেলার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। লাভ বেশি হওয়ায় পানি ফলের চাষ দিন দিন বাড়ছে। এতে জেলায় কৃষকরা আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছে। অপরদিকে বেকারত্ব দূর হচ্ছে। এই সোনালি সম্ভাবনাকে সফল করার জন্য পানিফল চাষাবাদের আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে গবেষনা করা আবশ্যক। সর্বোপরি সাতক্ষীরা জেলার জলাবদ্ধ পতিত জমির সদ্ব্যবহার, জনসাধারনের পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে পানিফল চাষের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ, উপকরণ সরবরাহ, বাজারজাতকরণ ও তত্ত্বাবধায়নের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। মোঃ আবদুর রহমান, লেখক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা উপজেলা কৃষি অফিস, কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা।