দেশের খবর: শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ঘটনার সূত্রপাত বিজিবি গেটের কাছে এক আওয়ামী লীগ নেতার গাড়ি আটককে কেন্দ্র করে। শিক্ষার্থীরা কাগজপত্র দেখতে চাইলে পেছন থেকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী এসে তাদের মারধর করে। আর মেয়েদের গায়ে রং ছিটিয়ে দেয়। তখন মার খাওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পাশের পপুলার হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এমন ঘটনা খুব অল্প সময়ে অনলাইনে প্রচার পায় ভিন্নভাবে। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে কয়েকজনকে ধর্ষণ এবং নিহতের কথা বলতে শোনা যায়। সাংবাদিকরা তাদের আইডি কার্ড দেখতে চাইলে তা না দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায় তারা। তারা বলে, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটকে রাখা হয়েছে। ছাত্রলীগের গুলিতে একজন নিহত হয়েছে। চার শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। এদের একজনকে গলা কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে ধানমণ্ডি লেকে। আজিমপুরে ১০ জন শিক্ষার্থীকে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ, সায়েন্স ল্যাব মোড়ে ছাত্রলীগ হামলা করেছে।
ছড়িয়ে পড়া খবর বিশ্বাস করে দুপুর ২টার পর প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থী জিগাতলায় আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসের দিকে এগোতে থাকে। এ সময় আওয়ামী লীগের ধানমণ্ডি ৩/এ নম্বর সড়কের পার্টি অফিসের সামনে জড়ো হওয়া নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। ঘটনাস্থলে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল ছোড়ে। উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ বিজিবির গেটে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। এ সময় বিজিবির সদস্যরা বাইরে বেরিয়ে এসে দুই পক্ষকে দুই দিকে পাঠিয়ে দেন।
সংঘর্ষের একপর্যায়ে নেতাকর্মীদের সরিয়ে নিতে রাস্তায় এসে দাঁড়ান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি। তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের কার্যালয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যান। পরে দলীয় নেতাকর্মীরা জড়ো হয়। এরপর বেশ কয়েক দফা লাঠিচার্জসহ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ।
দফায় দফায় সংঘর্ষ : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দ্বিতীয় দফায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই কার্যালয় লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। দেড় ঘণ্টা ধাওয়াধাওয়ি চলতে থাকে। তখন কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলির শব্দ পায় স্থানীয় লোকজন। এ সময় কিছু যুবকের মাথায় হেলমেট দেখা যায়। তাদের একজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। সেখানে ইট-পাথর ছোড়াছুড়ি চলে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিকেল ৩টার দিকে শিক্ষার্থীরা ধানমণ্ডি-২ নম্বর সড়কের স্টার রেস্তোরাঁর দিকে সরে যায়। পরে সেখানেও ধাওয়াধাওয়ি হয়। সেখানে সড়কে দুটি মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বিকেল ৫টার দিকে আম্বালা হোটেলের সামনে থেকে স্টার কাবাবের দিকে থাকা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ইট ছুড়তে দেখা যায় হেলমেট পরা ওই যুবকদের। এ সময় শিক্ষার্থীরা পাল্টা ঢিল ছুড়ছিল, তাদের কারো কারো হাতে লাঠিও দেখা গেছে। ধাওয়াধাওয়ির একপর্যায়ে সন্ধ্যা ৬টার দিকে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে বিজিবি ফটকের কাছে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনেও নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয়। সেখানে বিপুল পরিমাণ পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সংঘর্ষের সময় কালের কণ্ঠ’র ফটো সাংবাদিক তারেক আজিজ নিশোকসহ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর ওপর হামলা হয়। নিশোক হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
সন্ধ্যার আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে কয়েকজন এসে পুলিশের সঙ্গে পুরো কার্যালয় ঘুরে দেখে। এরপর আওয়ামী লীগের কার্যালয়েই সংবাদ সম্মেলন করে ওই শিক্ষার্থীরা। ঢাকা আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী কাজী আশিকুর রহমান তূর্য বলেছে, ‘দুপুরে নামাজের পর হঠাৎ কিছু লোক এসে বলে, আমাদের চারজন বোনকে আর কয়েকজন ছেলেকে আওয়ামী লীগ অফিসে আটকে রাখা হয়েছে। পরে আমাদের একটি অংশ আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে চলে আসে। কিন্তু আমরা আওয়ামী লীগ অফিসে এসে দেখলাম, এমন কিছু ঘটেনি।’
ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী বলেন, ছাত্রদল আর শিবির আজকের এই ঘটনার মূল হোতা। এ সময় তিনি নীলক্ষেতে ১০ জনকে ভুয়া আইডি কার্ড বানানোর সময় পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন বলে দাবি করেন।
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ফেসবুক পেজে গতকাল বিকেলে আয়াতুল্লাহ বেহেশতি নামের একজন ভিত্তিহীন গুজব ছড়িয়ে একটি পোস্ট দেয়। তার ওই পোস্টে বলা হয়েছে, ‘জিগাতলায় চারজন নিহত, চারজন ধর্ষিত’। এদিকে অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদকেও ফেসবুক লাইভের ভিডিওতে বলতে শোনা যায়—‘আমি কাজী নওশাবা আহমেদ আপনাদের জানাতে চাই, একটু আগে জিগাতলায় আমাদেরই ছোট ভাইদের একজনের চোখ তুলে ফেলা হয়েছে এবং দুজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। আপনারা সবাই একসাথে হোন। প্লিজ, ওদেরকে প্রটেকশন দেন। বাচ্চাগুলো আনসেভ অবস্থায় আছে। প্লিজ, আপনারা রাস্তায় নামেন এবং ওদের প্রটেকশন দেন। যদি সরকার প্রটেকশন দিতে না পারে তাহলে আপনারা মা-বাবা হয়ে, ভাই-বোন হয়ে বাচ্চাগুলোকে প্রটেকশন দেন। এটা আমার রিকুয়েস্ট। আমি একজন এ দেশের মানুষ, এ দেশের নাগরিক হিসেবে আপনাদের কাছে রিকুয়েস্ট করছি।…প্লিজ-প্লিজ ওদেরকে বাঁচান।’ এই স্ট্যাটাসের ব্যাপারে জানতে চাইলে কাজী নওশাবা আহমেদ সন্ধ্যায় বলেন, ‘আমার তথ্য যদি ভুল হয়, আমি যার কাছে শুনেছি তার কাছে জানতে হবে!’ এরপর রাতে র্যাবে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। একইভাবে এ আর রিমন, আসিফ অর্কসহ আরো অনেকের আইডি থেকেও এমন গুজব ছড়াতে দেখা যায়।
গুজব শুনে গতকাল সন্ধ্যায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রগতি সরণির যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে অবস্থান নেয়। ধানমণ্ডি থানার সামনে এবং বনানীতেও সন্ধ্যার পর শিক্ষার্থীদের জড়ো হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে স্বার্থান্বেষী মহল ফয়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা শিশু-কিশোরদের মধ্যে ঢুকে পুলিশের ওপর, রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলা চালাচ্ছে। তাদের আমরা শনাক্ত করছি।’
সূত্র: কালেরকণ্ঠ অনলাইন।