দেশের খবর: সোমবার দুপুর ২টা। রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রাঙ্গণে হাজারো গাড়িচালকের ভিড়। গাড়ির লাইসেন্সের আবেদন করতে কেউ এসেছেন, কেউ বা ভিড় করেছেন গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করাতে, মালিকানার কাগজ নিতে কিংবা কেউ অন্য কোনো সেবা নিতে। তিলধারণের ঠাঁই নেই একেকটি কক্ষের সামনে। ভিড়ের চাপে কোনো শাখায়ই কার্যক্রম চলছিল না ঠিকঠাক। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে দেখা যায় সংস্থার জেনারেটরও চলছে না। ফলে অচল হয়ে পড়ে কম্পিউটার ব্যবস্থা। কার্যালয়ের সামনে কথা হয় অটোরিকশাচালক মো. আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। আনোয়ার জানান, তিনি ১৯৮৮ সাল থেকে গাড়ি চালাচ্ছেন। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত লাইসেন্স ছিল, পরে আর আবেদন করেননি, পুরনো লাইসেন্সও হারিয়ে গেছে। পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া জরিমানার স্লিপ দেখিয়েই তিনি এত বছর সড়কে সক্রিয় ছিলেন। আনোয়ারের স্লিপ পড়ে জানা গেল, সর্বশেষ গত ৩০ জুলাই সন্ধ্যা ৬টায় সায়েদাবাদে লাইসেন্স না থাকায় তাঁকে ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা জমা দিতে হবে ১৯ আগস্টের মধ্যে। তাঁর অটোর নিবন্ধন নম্বর : ঢাকা মেট্রো-থ-১৩৮৭২১। আনোয়ার বলেন, ঘুষ না দিলে লাইসেন্স মেলে না, দিনের পর দিন ঘুরতে হয়—এই ভয়ে বিআরটিতে এত বছর আবেদন করেননি। রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার ইব্রাহীম মহাজনের অটো চালান আনোয়ার। প্রতিবছর গাড়ি পরীক্ষা করিয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট নিতে হয়, কিন্তু তিনি গাড়ি না এনেই দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে ফিটনেস সনদ নিয়ে থাকেন। রাজধানীর বিভিন্ন বাস কম্পানির বাস বিআরটিএতে না এনেই ফিটনেস নেওয়া হয়। সোমবার দুপুরে বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ে বাসচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘দেখেন বাস, ট্রাক কয়ডা আছে? ১০-১২টা আর প্রাইভেট কার ২০০।’ ফিটনেস পরীক্ষা করতে মিরপুর বিআরটিএতে ২০১৬ সালে ডিজিটাল গাড়ি পরিদর্শন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। অন্য কোথাও এই অত্যাধুনিক ব্যবস্থা নেই। ১৯৯৬ সালেই এ ধরনের পরিদর্শন ব্যবস্থা বিআরটিএর বিভিন্ন কার্যালয়ে স্থাপনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। বাধা হয়ে দাঁড়ান বিআরটিএর কর্মকর্তারাই। শেষ পর্যন্ত সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উদ্যোগী হয়ে এই কেন্দ্র স্থাপন করিয়েছেন। সড়কমন্ত্রী বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ে বারবার অভিযান চালিয়েছেন সেবা পরিস্থিতি দেখতে, দালালমুক্ত সেবাকেন্দ্র গড়তে। তবে এসব তৎপরতার ফাঁকেও দালালরা কর্মকর্তাদের ইশারায় ঘুষ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, গতকালও বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয় থেকে চারজন দালালকে আটক করা হয়েছে। বিভিন্ন কম্পানির বাস ও ট্রাক উপস্থিত না করিয়েই ফিটনেস সনদ দিতেন মিরপুর কর্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শক আবদুল জলিল। তাঁকে ১১ মাস আগে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়েছে। জানা গেছে, তাঁকে সহকারী পরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়ার চেষ্টা চলছে। গত জুনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিআরটিএতে নিবন্ধিত গাড়ির বিপরীতে লাইসেন্সহীন গাড়ি চলছে প্রায় ১৬ লাখ। সংস্থার সর্বশেষ তথ্যানুসারে, প্রায় পাঁচ লাখ গাড়ির ফিটনেস নেই। তবে যেসব লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে তার একটি অংশ ঘুষ দিয়ে, যথাযথভাবে পরীক্ষা না দিয়েই নেওয়া হয়েছে। রাজধানীর মিরপুর, ইকুরিয়া, উত্তরাসহ দেশে বিআরটিএর কার্যালয় আছে ৬০টি। এসব কার্যালয়ে ঘুষ ছাড়া ফাইল দ্রুত হাঁটে না। রাজধানীতে অটোরিকশার নিবন্ধন আছে প্রায় ১৩ হাজার। এগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে। এগুলো নিয়ম অনুসারে ধ্বংস করে প্রতিস্থাপন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে গত এপ্রিল থেকে। এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৫৬১টি অটোরিকশা স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক অটোরিকশা ধ্বংস (স্ক্র্যাপ) করতে মালিকদের ঘুষ দিতে হয়েছে। অটোপ্রতি ২০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে বলে ভুক্তভোগী মালিকরা জানিয়েছেন। ঘুষ বা উেকাচ না দিলে মালিকদের হয়রানি ও লাঞ্ছিতও করা হচ্ছে। গত ১৮ জুলাই মকবুল হোসেন নামের এক অটোচালককে বিআরটিএ ইকুরিয়া কার্যালয়ের একটি কক্ষে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন ওই কার্যালয়ের কর্মরত সহকারী পরিচালক (প্রকৌশল) গোলাম হায়দার। মকবুলের ২৫টি অটোরিকশা আছে। গোলাম হায়দার সেদিন মকবুলের ওপর ক্রোধান্বিত হয়ে বলেছিলেন, দালালের কাছে গেছেন কেন? আমাকে দেখেন না? পরে মকবুলকে তিনি টেনেহিঁচড়ে একটি কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখেন। অটোরিকশার মালিক শফিকুল ইসলাম লিটন বলেন, ‘অটোরিকশাপ্রতি ২০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে স্ক্র্যাপ করাতে গিয়ে। আমার দুটি অটোরিকশার মধ্যে একটি স্ক্র্যাপ হয়েছে। একটি (ঢাকা মেট্রো-থ-১২৭৩৬৪ ) স্ক্র্যাপ করা হয়নি ঘুষ দিতে পারিনি বলে। আমি মিরপুর বিআরটিএ অফিসে মাসুদ আলমের কাছে বারবার গিয়েছি, বলেছি আমার ছেলে প্রতিবন্ধী, আমার ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্য নেই। বিআরটিএ ইকুরিয়ার সহকারী পরিচালক গোলাম হায়দার বলেছেন, একটির স্ক্র্যাপ হয়েছে, আর হবে না।’ অটোরিকশা মালিক লিটন জানান, স্ক্র্যাপ করার আগে দালালরা মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে ঘুষ নেওয়া হয়েছে এমন অটোরিকশার নিবন্ধন নম্বরগুলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। স্ক্র্যাপ করার দিন কর্মকর্তার হাতে থাকা তালিকায় টিক চিহ্ন দেওয়া থাকে ঘুষ নেওয়া হয়েছে এমন অটোরিকশার নম্বরের পাশে। ঘুষ দেওয়া হলে কোনো মালিকের দুটি বা তিনটি গাড়িও স্ক্র্যাপ করা হয়, ঘুষ না দিলে ঘুরতেই হয়। বিআরটিএ ইকুরিয়া কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (প্রকৌশল) গোলাম হায়দার বলেন, ‘আমরা স্ক্র্যাপের ক্ষেত্রে ঘুষ বা অন্য কোনো অনিয়ম করিনি। একটি গাড়ির চেসিসে ১১টি ডিজিট থাকে। কোনোটি মুছে গেছে—এ ধরনের ত্রুটি পেলে অধিকতর তদন্তের জন্য বিশেষজ্ঞ কামিটির কাছে পাঠানো হয়ে থাকে অটোরিকশা। আমি ইকুরিয়ার অফিসে আমার শাখায় আটটি সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছি। দেয়ালে বিজ্ঞপ্তি লেখা রয়েছে : অর্থনৈতিক লেনদেন ব্যাংকে করবেন, সকলের গতিবিধি সিসি ক্যামেরা দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রতিদিন আমরা ১৫০টি অটো ভাঙছি, সবগুলোই কি ত্রুটিমুক্ত? যারা অভিযোগ করছে তারা সংক্ষুব্ধ হয়েই করছে, তবে এ অভিযোগ করা হচ্ছে ঢালাওভাবে। আমাদের অফিসের বাইরে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় দালাল আছে। তবে ভেতরে নেই।’ পাঁচ সদস্যের অটোরিকশা স্ক্র্যাপ কমিটির সভাপতি, বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক মাসুদ আলম বলেন, ‘আমরা এবার শান্তিপূর্ণভাবে অটোরিকশা স্ক্র্যাপ করেছি। চেসিস ও ইঞ্জিনে ত্রুটি পাওয়া গেলে অধিকতর তদন্তের জন্য হয়তো কিছু অটো স্ক্র্যাপ করা হয়নি। এ ছাড়া কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে কোনো অনিয়মের অভিযোগ করতে পারেন, তবে অভিযোগ সত্য নয়।’ লাইসেন্স নিতে কিভাবে কোন কোন পর্যায়ে এই ঘুষ দিতে হয় এর খোঁজ নিতে গেলে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে জানা যায়, একটি লাইসেন্স নিতে গেলে কমপক্ষে অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। দালালের মাধ্যমে নেওয়া ঘুষ ভাগবাটোয়ারা হয় সংশ্লিষ্ট শাখার কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে। বিশেষ তদবির ছাড়া সাধারণ মানুষকে প্রথমে শিক্ষানবিশ লাইসেন্স বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাত দিনেও দেওয়া হয় না। তবে দালাল ধরলে এক দিনেই এই লাইসেন্স পাওয়া যায়। শিক্ষানবিশ লাইসেন্স পাওয়ার আট-নয় মাস পর মৌখিক, লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষার তারিখ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে দালাল ধরে ঘুষ দিলে দুই মাসের মধ্যেই পরীক্ষার তারিখ পাওয়া সম্ভব। দ্রুত পরীক্ষার তারিখ ও পরীক্ষায় পাস নিশ্চিত করতে দালালকে লাইসেন্সপ্রতি দিতে হয় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে বিআরটিএ থেকে অস্থায়ীভাবে গাড়ি চালানোর অনুমতিপত্র নিতেও ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়, না হলে এই অনুমতিপত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে পুনঃপরীক্ষার জন্য দিতে হয় কমবেশি তিন হাজার টাকা। পেশাদার লাইসেন্সের পুলিশ তদন্ত শেষে প্রতিবেদন পেতেও ঘুষ লাগে। পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে সংশ্লিষ্ট পুলিশ স্টেশনে তদন্তের জন্য গেলে তা তদন্ত শেষে পুলিশের বিশেষ শাখায় ও পরে বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এই তদন্ত প্রতিবেদন মাসের পর মাস খুঁজে পাওয়া যায় না। ঘুষ না দিলে এ ক্ষেত্রে দুই হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। এ বিষয়ে গাড়িচালক ইব্রাহীম আলী বলেন, টাকা দিলেই হয়, পরীক্ষাও লাগে না। এই লাইসেন্স পেয়ে সড়কে চালকরা সঠিকভাবে গাড়ি চালাবে কিভাবে? সড়কের বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন কী নির্দেশ করে তার জন্য সব চালকের প্রশিক্ষণ দরকার। এ প্রশিক্ষণও কম। বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক মাসুদ আলম বলেন, ‘আমরা মিরপুর কার্যালয়কে ঘুষমুক্ত করেছি। আজও চারজন দালালকে ধরা হয়েছে। সোমবার ছয়জন দালালকে ধরে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সপ্তাহের শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত আমাদের কার্যালয় খোলা থাকবে। আমাদের কাজের চাপ বেড়েছে। অন্যান্য সময়ের চেয়ে শিক্ষানবিশ লাইসেন্সের জন্য আবেদনপত্র দ্বিগুণ পড়ছে, ফিটনেস সনদ ও লাইসেন্স নিতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ সেবাগ্রহীতা আসছেন। আমরাও সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছি, যাতে দুর্নীতি না হয়।’ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ খোকন বলেন, সিসি ক্যামেরা ফাঁকি দিয়ে বিআরটিএতে গোপানে উেকাচ নেওয়া হয়। না দিলে সেবা মেলে না। এ কারণে চালকরা বিআরটিএতে যেতে চান না। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বিআরটিএতে সুশাসন নেই। কুশাসনের বড় কারণ তদারকির অভাব ও তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা গড়ে না তোলা। সারা দেশেই বিঅরটিএ কার্যালয়ে নজর দিতে হবে, যাতে দুর্নীতি বন্ধ হয়। বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান বলেন, বিআরটিএতে লাইসেন্স ও ফিটনেসসহ বিভিন্ন সেবায় যে ঘুষ দিতে হয় তা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে তদারকি বাড়াতে হবে, দালাল তাড়াতে হবে, কাউন্টার বাড়াতে হবে, চোখের দেখায় ফিটনেস দেওয়া বন্ধ করতে হবে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, মোটরযান চলাচলের উপযুক্ততা পরীক্ষা করার পর বিআরটিএর স্থানীয় কার্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শকরা ফিটনেস সনদ সর্বপ্রথম তিন বছরের জন্য ইস্যু করেন। এরপর প্রতিবছর নির্ধারিত ফি দিয়ে একই কার্যালয় থেকে মোটরযানের ফিটনেস সনদ নবায়ন করতে হয়।