দেশের খবর: ১০ বছরের শিশু রোকসানা। নড়াইল সদর হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে নিস্তেজ। ওইটুকু মেয়ের সারা শরীরে আঘাতের কালশিটে দাগ। দীর্ঘদিনের লাগাতার নির্যাতনের চিহ্ন, দগদগে ক্ষতও রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়।
কঙ্কালসার দেহটি হাসপাতালের বিছানার সঙ্গে লেপ্টে আছে। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় বাতাস, খাদ্যগ্রহণের শক্তিটুকু নিঃশেষ প্রায়। কৃত্তিম উপায়ে চলছে শ্বাসপ্রশ্বাস। ঢাকায় বাসাবাড়িতে কাজে নিয়ে রোকসানা নামের নড়াইলের ১০ বছরের এই শিশুটির ওপর মধ্যযুগীয় নির্যাতন চালানো হয়েছে। যৌন নিপীড়ন থেকে শুরু করে দীর্ঘ আট মাস ধরে এমন কোনও নির্যাতন নেই যা হয়নি শিশুটির ওপর।
মৃত্যু পথযাত্রী শিশুটি এখন নড়াইল সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছেন শিশুটির স্বজনরা।
স্বজনরা জানান, আট মাস আগে ঢাকার ওয়ারী এলাকার এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে শিশু রোকসানাকে গৃহপরিচারিকার কাজে নিয়োগ করেন লোহাগড়া উপজেলার বাহিরপাড়া গ্রামের সালেহা বেগম। রোকসানার পরিবারের দূরাবস্থার কথা ভেবে সালেহা তাকে পূর্ব পরিচিত ওয়ারী এলাকার টিপু সুলতান রোডের আসাদুল্লাহর বাড়িতে রেখে আসেন।
পরিবারের সদস্যরা জানতেন না কার বাড়িতে থাকে রোকসানা। মাঝে মধ্যে মোবাইল ফোনে মেয়ের সঙ্গে কথা হতো তাদের। আট মাস ওই বাসায় অবস্থানকালে রোকসানার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলে। নির্যাতন ছাড়াও প্রায়ই অনাহারে রাখা হতো তাকে।
একপর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে রোকসানা। অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করে পরিবারটি। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে স্বজনদের খবর দিয়ে ঢাকায় আনা হয়। গত ১৭ আগস্ট রাতে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় রোকসানাকে। মরণাপন্ন অবস্থায় তাকে গত ১৯ আগস্ট নড়াইল সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বজনরা।
শিশু রোকসানার ওপর এই নির্মমতা দেখে কষ্টে বুক ফেটে যায় মায়ের। হাসপাতালে যে-ই শিশুটিকে দেখতে যাচ্ছে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছেন মা রত্না বেগম। বলেন, ‘একটু ভালো থাকার জন্য আমার মেয়েরে কোন জল্লাদের কাছে দিয়েছিলাম, আল্লাহ যেন জল্লাদদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়।’
শিশু রোকসানাকে সরবরাহকারী সালেহার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে ঢাকাস্থ নড়াইলের আমিনুল ইসলামসহ কয়েকজনকে পাষণ্ড পরিবারটি সম্পর্কে সালেহা তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন আমিনুল।
আমিনুলের কাছে সালেহার দেওয়া তথ্যমতে, আসাদুল্লাহর বাড়ি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার খোলাপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম হাফেজ মোল্লা। বর্তমানে তিনি হজ্ব পালনের উদ্যেশ্যে মক্কায় অবস্থান করছেন। তার স্ত্রী সোনিয়ার গ্রামের বাড়ি সিরাজদিখান এলাকার জৈনসার গ্রামে। বাবার নাম খোরশেদ মোল্লা। ওয়ারীর বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন সোনিয়ার ভাই ইব্রাহিম। মূলত এই তিনজনই নির্যাতন করেছে শিশু রোকসানাকে।
আসাদুল্লাহর স্ত্রী সোনিয়ার মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
নড়াইল সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. মুশিউর রহমান বাবু জানান, রোকসানার ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতন হয়েছে তার সব আলামতই রয়েছে শিশুটির শরীরে। সে এখনও শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন সদর হাসপাতালের এই চিকিৎসক।
এদিকে, এই ঘটনায় অভিযুক্ত আসাদল্লাহ, তার স্ত্রী সোনিয়া, সোনিয়ার ভাই ইব্রাহিম ও সরবরাহকারী সালেহা বেগমের নাম উল্লেখ করে গত ২২ আগস্ট লোহাগড়া থানায় মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী শিশুটির বাবা রাসেল শেখ।
লোহাগড়া থানার ওসি প্রবীর বিশ্বাস বলেন, ‘ইতিমধ্যে মামলার আসামিদের ঠিকানা ঢাকার ওয়ারী, মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এবং সিরাজদীখান থানায় অনুসন্ধান স্লিপ পাঠানো হয়েছে। তারবার্তা ছাড়াও জরুরিভাবে মেইলে তথ্য জানানো হয়েছে।’
নড়াইলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন (পিপিএম) বলেন, ‘শিশুটিকে যে ধরনের নির্যাতনের চিত্র পাওয়া গেছে তাতে এই ঘটনা যারাই ঘটাক তাদের কোনও মাফ হবে না। পুলিশ যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’