ফিচার

বঙ্গবন্ধুর গোসল-দাফনে অংশ নিয়েছিলাম- স্মৃতিচারণে সাতক্ষীরার রজব আলী

By Daily Satkhira

August 29, 2018

আসাদুজ্জামান : রাতে পড়তে পড়তে ঘুম আসতো। পরীক্ষার সময় ঘুম ঠেকাতে পাশে থাকা রেডিওটি অন করতাম। আর এই রেডিওতেই সে রাতে শুনেছিলাম ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’। বারবার এই বুলেটিন প্রচারে সেদিন আমার ঘুম আর হয়নি। আতংকে কেটেছে রাত। পরদিন সকালে ঢাকায় কী ঘটেছে সে খবর চারিদিকে ভেসে বেড়ায়। আমি তখন মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্র। সবকিছু বুঝে ওঠার ক্ষমতাও আমার হয়নি।শুধু জানলাম বঙ্গবন্ধু আর নেই। দুদিন পর সেই টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে দাফনের আগে বঙ্গবন্ধুকে গোসল দেওয়ার কাজে আমি সাহায্য করেছিলাম। মনে আছে তিব্বত ৫৭০ ব্র্যান্ডের কাপড় কাচা সাবান এনে পাশের একটি পুকুর থেকে পানি নিয়ে গোসল করানো হয়েছিল তাকে। আমি বঙ্গবন্ধুর গায়ে জমাট বাধা রক্ত ভেজা গেঞ্জি দেখেছিলাম। গুলিতে ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল তার বুক। সে এক দুঃসহ স্মৃতি। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এই কথাগুলি বলেন, সাতক্ষীরার মওলানা রজব আলি মোল্লা। স্মৃতির অতল তলে হাতড়ে তিনি এখনও আপন মনে সেকথা ভাবেন। ঘাতকদের গুলিতে বঙ্গবন্ধুর মত এক বিশাল হৃদয়ের নরশার্দুলের ঝাঁঝরা হওয়া বুকের দুঃসহ দৃশ্যের স্মৃতি ভুলতেই পারেন না তিনি। কথা গুলো বলতে বলতে তিনি বারবার আবেক আপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন। অঝোরে কাঁদাছিলেন তিনি। সাতক্ষীরা শহরতলির মেহেদীবাগের টিনে ছাওয়া মাটির বাড়ির বারান্দায় বসে এই প্রতিনিধির সাথে শোকাবহ সেই স্মৃতির কথা বলছিলেন তিনি। তিনি বলেন, আগস্ট যায়, আগস্ট আসে, আসুক আগস্ট, কিন্তু ১৫ই আগস্ট যেন আর দেখতে না হয় এই জাতিকে। রজব আলী মোল্লা শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়লিনী ইউনিয়নের ৯নং দাতনেখালি গ্রামের মৃত কলিম উদ্দিনের ছেলে। বর্তমানে তিনি স্ত্রী সন্তান নিয়ে শহরের মেহেদীবাগে বসবাস করেন। রজব আলি মোল্লা ১৯৭৫ সালে গোপালগঞ্জের গোবরা কওমী মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। কিছুদিন বাদে তিনি গোবরা ছেড়ে একই এলাকার গওহরডাঙা মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার একদিন পর টুঙ্গিপাড়ায় একজন দফাদার এসে সবাইকে খবর দিল গোপালগঞ্জ শহর আর্মিতে ভরে গেছে। আপনারা কেউ কোন কথা বলবেন না। আর্মি যা বলে তাই শুনবেন। স্মৃতিচারন করতে গিয়ে তিনি বলেন গোসল শেষে আর্মিতে ঘেরা ময়দানে বঙ্গবন্ধুর নামাজে জানাযায় ২৫ থেকে ৩০ জন মুসল্লি উপস্থিত ছিলেন। তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গওহরডাঙা মাদ্রাসার কলাখালি হুজুর। এরপর তার কবর খোড়া হয়। সেখানেই শায়িত হলেন মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন মনে হয়েছিল বাংলার এক বিশাল মহীরুহকে হারালো বাঙ্গালি। যেনো একটি ইতিহাসের যবনিকা পড়লো। রজব আলি মোল্লা জানান, বঙ্গবন্ধুকে গোসলের কাজে অনেকের মধ্যে আরও যারা সহায়তা করেছিলেন তারা হলেন, গোপালগঞ্জের দিঘলিয়ার মোঃ জালাল উদ্দিন এবং পাটগাতি গ্রামের বেলায়েত হোসেন। এই জালাল উদ্দিন সাতক্ষীরার কামালনগর মসজিদের ইমাম ছিলেন। আর বেলায়েত হোসেন ছিলেন সাতক্ষীরা আনসার ক্যাম্প মসজিদের ইমাম। দুজনেই আজ প্রয়াত। তাদের স্মরন করে তিনি বলেন, আমরা সবাই একসাথে থাকতাম। একসাথে বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও তার মায়ের কুলখানিতে অংশ নিয়েছিলাম ১৯৭৩ সালে। আমরা ছাত্র হিসাবে সেখানে পৌঁছানোর পর বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে শুনেছিলাম ‘কি রে তোরা খেয়েছিস ? খেয়ে নে’। মনে আছে তিনি আমাদের একসাথে বসিয়ে খাবার হুকুম দিয়েছিলেন। আমি তখন গোপালগঞ্জের সিঙ্গিপাড়ায় একটি বাড়িতে লজিং থাকতাম। বাড়ির মালিকের ছেলের নাম ছিল আতাউল গনি বাদশা। তিনি একসময় সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও পরে খুলনার পুলিশ সুপার ছিলেন। সেদিনের বর্ননা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে মাঠে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী হেলিকপ্টার নামলো। সেখানে এলেন গোপালগঞ্জের এসডিও। গোসল এবং জানাযার সময় সেনাবাহিনীর ভয়ে সামনে আসতে সাহস করেননি অনেকে। সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ৩০ জন আমরা অংশ নিয়ে তাকে শায়িত করেছিলাম। তখন আমার ছেলেবেলা। অনুভবে আসেনি‘ এতোবড় ঘটনার সাক্ষী হলাম আমিও’। স্মৃতিচারন করতে যেয়ে রজব আলি আরও বলেন, ১৯৮০ সালে তিনি দাওরায়ে হাদিস শেষ করে কুষ্টিয়ায় দুই বছর শিক্ষকতা করেন। এরপর চলে আসেন সাতক্ষীরায়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আতাউল গনি বাদশার সহযোগিতায় পুলিশ লাইনস মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব পান তিনি। টানা ৩২ বছর ইমামতির পর তিনি অবসরে গেছেন। এখন তার বড় ছেলে মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাতক্ষীরার সদর থান মসজিদের ইমাম ও ছোট ছেলে মাওলানা শরিফুজ্জামান পুলিশ লাইন মসজিদে ইমামতি করেন। তার একমাত্র মেয়ে মুসলিমা খাতুনকে বিয়ে দিয়েছেন শহরের মধ্যেই। রজব আলির একটাই প্রত্যাশা, ‘আমি শুধু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সামনে যেতে চাই, তার সঙ্গে দেখা করতে চাই, বলতে চাই আমার হাতে বঙ্গবন্ধুর বুকের ছোঁয়া, আমার কানে এখনও বঙ্গবন্ধুর কথা বাজে, ‘কিরে তোরা আসছিস না কেন?’।