অনলাইন ডেস্ক: অাফ্রিকান ভয়ংকর মাদক ‘খাট’ বা এনপিএস এবার বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে ধ্বংস করতে কালো থাবা বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানের নতুন ধরনের আটকের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা কাস্টম হাউস ও জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার যৌথ অভিযানে এবার প্রায় ১৬০ কেজি ‘খাট’ আটক করা হয়। শনিবার বেলা দুইটার দিকে বিমানবন্দরের কার্গো ইউনিটের ফরেন পোস্ট অফিস থেকে খাটের চালানটি জব্দ করা হলেও এর সঙ্গে জড়িত কাউকে আটক করা যায়নি। ঢাকা কাস্টম অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেট এয়ারওয়েজে করে ইথিওপিয়া থেকে ভারত হয়ে কয়েক দিন আগে খাটের চালানটি ঢাকায় আসে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ইউনিটের ফরেন পোস্ট অফিস এলাকা থেকে নয়টি কার্টন জব্দ করা হয়। এসব কার্টনের ভেতর ১৬০ কেজি খাট পাওয়া যায়। পরে এগুলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মাত্র একসপ্তাহ আগে ৩১ আগস্ট দুপুরে শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো এলাকা-সংলগ্ন রানওয়ের পাশে ৪৬৭ কেজি খাটের চালান জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নাজিমউদ্দিন (৪৫) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যার দিকে নাজিমউদ্দিনের শান্তিনগরের কার্যালয়ে ‘নওশিন এন্টারপ্রাইজ’ থেকে আরও ৩৯৪ কেজি খাট জব্দ করা হয়। ৮৬১ কেজি খাটের চালান বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবার জিয়াদ মুহাম্মদ ইউসুফ নামের এক ব্যক্তি। জব্দ হওয়া খাটের চালানটির রপ্তানিকারক জিয়াদ মুহাম্মদ। তবে আমদানিকারক হিসেবে তুরাগ এলাকার এশা এন্টারপ্রাইজ। ধারণা করা হচ্ছে, বেশ কিছু দিন ধরেই বাংলাদেশে বাজার ‘খাট’-এর বাজার বিস্তৃত করতে সুকৌশলে কাজ করছে দেশি-বিদেশি একাধিক চক্র।
পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া থেকে আসা নতুন ধরনের এই মাদকের প্রচলিত নাম ‘খাট’। আর এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘এনপিএস’ (নিউ সাইকোট্রফিক সাবসটেনসেস)। সারা বিশ্বে ইয়াবাকে ছাড়িয়ে গেছে এই ‘এনপিএস’। বিশ্বে মাদক সেবনপ্রবণ ৮০টি দেশ এবং অঞ্চলে জরিপ করে ৭০টিতেই এনপিএসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গত বছর জাতিসংঘ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউনাইটেড নেশন্স অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এনপিএস’ সেবনকারীর শেষ গন্তব্য ধীরে ধীরে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া। ‘এনপিএস’ সেবনের পর তা মানবদেহে ইয়াবার চেয়ে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। নতুন এই মাদকটি ফেনসিডিল-ইয়াবার মতো সীমান্তপথে নয়, আকাশপথে পাচার হয়ে এসেছে। গত শুক্রবার দুপুরে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৮৬১ কেজি ওজনের একটি চালান ধরা পড়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। যার বাজার মূল্য ১ কোটি ২৯ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। এ ঘটনায় পাচারকারীকেও আটক করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। চালানটি পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া থেকে কয়েক দিন আগে গ্রিনটির (সবুজ চা) প্যাকেটের আড়ালে আনা হয়েছিল। যা বাংলাদেশ থেকে খালাস হয়ে ভারতের যাওয়ার কথা ছিল।
এদিকে ডিএনসির রাসায়নিক পরীক্ষক আবু হাসান বলেন, বাংলাদেশে এই ধরনের মাদক নতুন। আফ্রিকার দেশগুলোতে এই ধরনের মাদক সেবন করার কথা শোনা যায়। এখানে ক্যাথিনিন জাতীয় পদার্থ থাকে যা ইয়াবার মিথাইন এমফিটামিনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। এটি সাধারণত যৌন আকাক্সক্ষা বাড়াতে, রাত জেগে থাকতে এই মাদক ব্যবহার হলেও এটি সেবনে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
মাদকবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নালগুলো বলছে, ‘এনপিএস’ বিষয়ে স্পষ্ট করে পরিভাষা বিশ্লেষণ করা কঠিন। তবে এনপিএসকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, অপব্যবহারের পদার্থ, যা ১৯৬১ সালের প্রচলিত মাদক আইন অথবা ১৯৭১ সালের ওষুধ আইনে নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। কিন্তু এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনেক এনপিএস প্রথমবারের মতো সংশ্লেষণ বা সমন্বয় হয় ৪০ বছর আগে। কিন্তু সম্প্রতি এটি বাজারে ক্ষতিকারক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যা আইনের মধ্যে পড়ে না বা যা নিয়ে আইন তৈরিও হয়নি। এতে করে পুলিশ প্রশাসনও হিমশিম খাচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ‘খাট’ অনেকটা চায়ের পাতার গুঁড়োর মতো দেখতে। পানির সঙ্গে মিশিয়ে তরল করে এটি সেবন করা হয়। সেবনের পর মানবদেহে এক ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আসক্তিটা অনেকটা ইয়াবার মতো। এক ধরনের গাছ থেকে এই ‘খাট’ বা এনপিএস তৈরি হয়। এটি ‘খ’ ক্যাটাগরির মাদক। আফ্রিকার দেশ জিবুতি, কেনিয়া, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, ইয়েমেনে খাটের গাছ উৎপাদন করা হয়। খাট সেবক করলে অনিদ্রা, অবসাদ, দৃষ্টিভ্রম, ক্ষুধামান্দ্যসহ মানবদেহে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া ইন্দ্রিয় শক্তি এবং যৌনক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি খাট জীবনীশক্তিও কমিয়ে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ১৯৮০ সালে এনপিএসকে মাদকদ্রব্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।বে এর আসক্তি খুব ভয়ঙ্কর। খাটের কারণে অবসাদ, দৃষ্টিভ্রম, অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দাসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে৷। বেশি রস চিবিয়ে নেশা করলে বিপদও মারাত্মক। বিশেষজ্ঞদের বলছেন, ‘দাঁত এবং মাড়িতে ঘা হতে পারে। এ ছাড়াও, ইন্দ্রিয় শক্তি এবং যৌনক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খাট জীবনী শক্তিও কমিয়ে দেয়।’
১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) একে মাদকদ্রব্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। কানাডা, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে এটি অবৈধ না হলেও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণযোগ্য। ইসরাইলে এই উদ্ভিদের পাতা ওষুধ তৈরিতে ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। তবে মাদক নিয়ন্ত্রক সংস্থা- ডিইএ একে ক্ষতিকারক হিসেবে সতর্ক করেছে।অপরদিকে আফ্রিকার দেশ জিবুতি, কেনিয়া, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া এবং ইয়েমেনে এর উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় এবং অবাধে সেবনের বৈধতা রয়েছে। সোমালিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সোমালিল্যান্ডের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ ‘খাট’ এ আসক্ত। তাদের মতে, ‘খাট মদের চেয়েও ভালো। এই নেশা শক্তি যোগায়। এটা নেয়ার পর স্বাভাবিকভাবে কাজ করা যায়।’ সোমালিল্যান্ডের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং জনজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে এই নেশাদ্রব্য।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেমিকেল এক্সামিনার আবু হাসান বলেন, বাংলাদেশে এই ধরনের নেশাদ্রব্য নতুন। এক সময় আফ্রিকার দেশগুলোতে ব্যবহৃত হলেও ইদানিং এ নেশা ইউরোপ, আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ছে।”শুকনো ওই নেশার পাতা মুখে নিয়ে চিবিয়ে আবার কখনও পানির সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া হয়। ওই পাতায় থাকা ক্যাথিনোন ও ক্যাথিন অ্যালকালয়েড থাকে বলে ইয়াবার মতই নেশা হয় বলে আবু হাসান জানান।তিনি বলেন, “এই নেশাদ্রব্য যৌন উদ্দীপনা বাড়াতে বা দীর্ঘ সময় জেগে থাকতে সাহায্য করে বলে ধারণা করা হয়। তবে এটি সেবনে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।” দেশে গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঘোষণা দিয়ে এক যুদ্ধে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নেশায় বুদ হয়ে থাকা প্রজন্মের মুক্তির প্রতিজ্ঞায় ‘মাদক বিরোধী’ সে যুদ্ধ এখন পর্যন্ত সফল বলে জানাচ্ছেন তারা। যদিও মাদক বিরোধী অভিযানে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা নিহত হয়েছে প্রায় ৩০০। জেলে আটক রয়েছে আরো কয়েক হাজার মাদক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি।তা সত্ত্বেও দেশে মাদক আসার পথ পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার নজির দেখা যাচ্ছে না, যার প্রমাণ মেলে ‘খাট’ এর পর পর দুইটি বড় চালান উদ্ধারের পর।