অনলাইন ডেস্ক: পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শিশুদেরকে নৃশংসভাবে হত্যার মর্মস্পর্শী ছবি যেমন পাষাণ হৃদয়েও রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের একটি দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত একটি শিশুর জন্য ডিবি পুলিশের কান্না পানি ঝরিয়েছে সবার চোখে।
মানবতা ও মহানুভবতার দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শের আলী নামে এ পুলিশ সদস্য চট্টগ্রাম ডিবি পুলিশে কর্মরত ও কক্সবাজার রামু এলাকার পানিরছড়ার নিবাসী। গতকাল রোববার বেলা দেড়টার দিকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রামু এলাকার রশিদনগরে এই শের আলীর চোখের সামনে ঘটে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা।
প্রচণ্ড গতিবেগের ইউনিক নামে দূরপাল্লার বাসটি একটু সামনে গিয়ে উল্টে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে গগণবিদারী আওয়াজ আর কান্না। তবে দুর্ঘটনা কবলিত বাসের যাত্রী নন শের আলী। দুর্ঘটনা দেখে তিনি আর বসে থাকতে পারেননি। সঙ্গে সঙ্গে যোগ দেন দুঘর্টনায় আহতদের উদ্ধার কাজে।
তিনি জানিয়েছেন, প্রথমে তিনি গাড়িটির ভেতরে ঢুকার চেষ্টা করেন। কান্নার আওয়াজ আর বিকট শব্দ সহ্য করা কঠিন। এরপরও সাহস নিয়ে ঢুকে পড়েন। মুমূর্ষু যাত্রী বের করার বিভৎস অবস্থা দেখে নিজেকে সামলাতে পারেননি। তার সামনে এক একজন করে চারজনের মৃত্যু হয়। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখে খুব কষ্ট হয় তার। এরপরও ধৈর্যহারা হননি।
ওই বাসের নিচে চাপা পড়ে একটি ছোট্ট শিশু। তিন ঘণ্টা চেষ্টার পর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় রক্তাক্ত শিশুটিকে উদ্ধার করে আনেন স্থানীয় বাসিন্দা শের আলী। উদ্ধার করা মাত্রই কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই রক্তাক্ত শিশুটিকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে দৌঁড়ানো শুরু করেন শের আলী। হাসপাতালের নেয়ার পথে দৌঁড়ানোর সময় অপরিচিত এই শিশুটির কষ্ট ও যন্ত্রণা দেখে চিৎকার করে অঝোরে কেঁদেছেন শের আলী। শের আলীর কান্না দেখে কেঁদেছেন উপস্থিত জনতাও।
উল্লেখ্য, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রামুর রশিদনগর গ্যারেজ এলাকায় সুপারভাইজারকে ড্রাইভিং শেখাতে গিয়ে ইউনিক পরিবহনের যাত্রীবাহী বাস (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-০১০৫) উল্টে নারীসহ চার যাত্রী নিহত হয়েছে।
নিহতরা হলেন, ভৈরব জেলার বাসিন্দা মো. কাশেম (৪২), চকরিয়া উপজেলার পূর্বভেওলার মৃত কবির আহামদের স্ত্রী নূরুন্নাহার (৪০), পেকুয়া উপজেলার টৈটং ইউনিয়নের মো. শফিকের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা (২২) ও কুতুবদিয়ার উপজেলার লেমশিখালী ইউনিয়নের মৃত এবাদুল্লাহর ছেলে মো. ফারুক (২০)।
আহত ৫ মাসের শিশুসহ অন্তত ৪০ জন। জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত কয়েকজনের নাম ও পরিচয় পাওয়া গেছে। আহতদের হাসপাতালে দেখতে যান সিভিল সার্জন ডা. পুচনুর নেতৃত্বে একটি টিম। তিনি আহতদের স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নেন। আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসক-নার্সদের আন্তরিক হওয়ার নির্দেশ দেন।
আহত যাত্রী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সুমন বলেন, গাড়ি চলন্ত অবস্থায় ড্রাইভিং শেখানোর জন্য সুপারভাইজারকে চালকের আসনে বসানোর সাথে সাথে বিকট শব্দে গাড়িটি উল্টে যায়। আমি গাড়ির ৩ নং সিটে বসা ছিলাম। চালককে বলতে না বলতেই এই দুর্ঘটনাটি ঘটে যায়। সুমন নিজেকে মানবাধিকারকর্মী পরিচয় দিয়ে বলেন, দুর্ঘটনার জন্য চালকই সম্পূর্ণ দায়ী। এ জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আইনী ব্যবস্থা নেব।
আহত যাত্রী আবুল হোসেন চট্টগ্রামে একটি মাদরাসায় চাকরি করেন। মেয়ে উম্মে কুলসুম ও উম্মে হাবিবাকে নিয়ে টেকনাফে বাড়িতে আসছিলেন। পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আর বাড়ী যাওয়া হলো না। হাসপাতালের বিছানায় দুই মেয়েকে বুকে নিয়ে কাতরাচ্ছেন তিনি। একইভাবে অন্যান্যদের আর্তচিৎকারে পুরো হাসপাতাল অঙ্গন ভারী হয়ে ওঠেছে।
আবুল খায়ের নামে স্থানীয় এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ঘটনার সাথে সাথে স্থানীয়রা জেনারেটর বসিয়ে লোহা কাটার মেশিনের সাহায্যে গাড়ির ভেতর থেকে লোকজনকে বের করে আনেন। এলাকাবাসী না হলো হতাহতের ঘটনা আরো বাড়ত। পরে উদ্ধারকর্মীরা তাদের সাথে যোগ দেয়।
রামু তুলাতলী হাইওয়ে পুলিশের পরিদর্শক আবদুল আওয়াল জানান, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দিকে আসা ইউনিক পরিবহনের একটি বাস সড়ক দেবে গিয়ে খাদে পড়ে যায়। এতে বাসে থাকা থাকা যাত্রীদের মধ্যে চারজন নিহত হয়েছে। দুর্ঘটনার পরপরই উদ্ধার অভিযানে নামেন ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স টিম পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। তারা যৌথভাবে চালানো দীর্ঘ ৫ ঘন্টা উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে যাত্রীদের উদ্ধার সক্ষম হয়। এদের মধ্যে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
রশিদনগর ইউপি চেয়ারম্যান এমডি শাহ আলম ও দুর্ঘটনা স্থলের বাসিন্দা এবং সৌদিয়া পরিবহনের লিংকরোড কাউন্টার ম্যানেজার মো. রুহুল আমিন প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জানান, চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ইউনিক পরিবহণের একটি বাস (ঢাকা মেট্টো-ব-১৪-০১০৫) দ্রুত গতিতে কক্সবাজার যাচ্ছিল। বেলা দেড়টার দিকে মহাসড়কের রামুর রশিদনগর গ্যারেজ এলাকায় পৌঁছামাত্র অকস্মাৎ চলন্ত গাড়িটি সড়কের উপর উল্টে যায়। এতে গাড়ির ভেতর চাপাপড়ে যাত্রীরা। ভেতর থেকে কান্না ও গুমরানির শব্দ আসছিল। এ সময় পুরো রাস্তা ব্লক হয়ে সড়কের দু’পাশে শত শত বিভিন্ন ধরনের গাড়ি আটকা পড়ে।
খবর পেয়ে কক্সবাজার দমকল বাহিনী, রামু থানা ও হাইওয়ে পুলিশ, রামু ৫০ বিজিবি ও ১০ পদাতিক ডিভিশনের সেনা সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নেন।
ঘটনাস্থলে থাকা রামু উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজুল আলম বলেন, খোঁজ নিয়ে জেনেছি রামু হাসপাতালে আনা আহতদের মাঝে দু’জন মারা গেছেন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় অনেককে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করেছে রামু উপজেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালে জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনায় আহত প্রায় ৩০ জনকে কক্সবাজার হাসপাতালে আনা হয়। এদের মাঝে দুজন হাসপাতালে পৌঁছার পূর্বেই মারা গেছেন।
ঈদগাঁও পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ দেবাশিষ সরকার জানান, অকল্পনীয়ভাবে চলন্ত বাস উল্টে গিয়ে সব যাত্রী ভেতরে আটকা পড়ার খবর পেয়ে ঈদগাঁও থেকে উপ-পরির্দশক (এএসআই) পিয়ারু ইসলামের নেতৃত্বে দ্রুত ফোর্স পাঠানো হয়। বেশ কয়েকজন আহত নারী-পুরুষকে ঈদগাঁও ও চকরিয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
দমকল বাহিনী কক্সবাজার স্টেশন ইনচার্জ মো: আবদুল মজিদ জানান, বিজিবি-সেনাবাহিনী ও অন্যদের সহযোগিতায় অনেক চেষ্টার পর বেলা ৫টার দিকে দুর্ঘটনা কবলিত বাসটি সরানো সম্ভব হয়। বাসের বড়ি কেটে উদ্ধারকারীরা যাত্রীদের যে যেভাবে পেরেছে, হাসপাতালে নিয়ে গেছেন।