অনলাইন ডেস্ক: বিগত শতাব্দীগুলোতে নিজ দেশে গণতন্ত্র চর্চার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রসারে উৎসাহিত করে এসেছে আমেরিকানরা। বিদেশে গণতন্ত্র প্রসারে তাদের সেই চেষ্টা এখনো আছে। কিন্তু তাদের নিজ দেশের গণতন্ত্রই এখন হুমকিতে পড়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গত সপ্তাহে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেছেন, ট্রাম্প আজ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি। কেবল বারাক ওবামার মুখেই নয়, ট্রাম্পের সমালোচনা এখন বিশ্বজুড়ে। সুশৃঙ্খল বিশ্বব্যবস্থা এবং বিশ্ব নেতৃত্বের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত তিনি মুহূর্তেই ছুড়ে ফেলছেন। গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সংবাদ মাধ্যমকেও তিনি প্রকাশ্য শত্রু বানিয়ে ফেলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের দেড় শ বছরের বেশি পুরনো ম্যাগাজিন দি আটলান্টিক তার অক্টোবর সংস্করণ সাজিয়েছে দেশটির সংকটাপন্ন পরিস্থিতি নিয়ে। ‘দি আমেরিকান ক্রাইসিস’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে সাময়িকীটি লিখেছে, ‘গণমাধ্যমের ওপর আঘাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মধ্যে গণতন্ত্র সংকটে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কি তার চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে?’ গণতন্ত্র ও এর মূল্যবোধ সংকটে পড়েছে সারা বিশ্বেই। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ শনিবার আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, ‘গণতন্ত্র চাপে পড়েছে। গণতন্ত্রই পরিবর্তনশীল বিশ্বের জন্য সমাধান।’ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গতকাল শুক্রবার এক বাণীতে বলেছেন, ‘বিগত শতাব্দীগুলোর যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন গণতন্ত্র অপেক্ষাকৃত বেশি চাপের মধ্যে আছে। এ কারণে এই আন্তর্জাতিক দিবসে আমাদের উচিত গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার সম্ভাব্য উপায় এবং যে পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জগুলো গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে সেগুলোর সমাধান খোঁজা।’ জাতিসংঘ মহাসচিব গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য মোকাবেলার তাগিদ দিয়েছেন। বিশেষ করে, তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গণতন্ত্রকে আরো উদ্ভাবনী ও ইতিবাচকভাবে ক্রিয়াশীল করে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বিশ্ববাসীকে তিনি বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসে, আসুন, আমরা গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য যৌথভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করি।’ জাতিসংঘ বলছে, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৭০তম বার্ষিকীর এই বছরে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরার সুযোগ এনে দিয়েছে। গণতন্ত্রের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান হলো মানবাধিকার। টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ এজেন্ডায়ও ষোড়শ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য হিসেবে গণতন্ত্রকে রাখা হয়েছে। সেখানে শান্তিপূর্ণ সমাজ এবং কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সংযোগের কথা বলা হয়েছে। সারাবিশ্বে গত বছরের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এ বছরের শুরুর দিকে ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) যে বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, বিশ্বের মাত্র ১৯টি দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে। ‘ত্রুটিপূণর্’ গণতন্ত্র আছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ৫৭টি দেশে। ৩৯টি দেশে ‘হাইব্রিড’ গণতন্ত্র এবং ৫২টি দেশে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনব্যবস্থা আছে। ইআইইউ তার প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বের এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানে গণতান্ত্রিক মান আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে। ইআইইউয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের অবস্থান ১০ ধাপ পিছিয়ে ৭৩-এ নেমেছে। যুক্তরাজ্য, কানাডায় ‘পূর্ণ’ গণতন্ত্র আর যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে ‘ত্রুটিপূণর্’ বলেছে ইআইইউ। ভারতও আছে ‘ত্রুটিপূণর্’ গণতন্ত্রের তালিকায়। ইআইইউয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের তুলনায় গত বছর বাংলাদেশ গণতন্ত্র সূচকে আট ধাপ পিছিয়েছে। ১৬৫টি দেশ ও দুটি ভূখণ্ড নিয়ে গড়া তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৯২তম। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ছিল ৮৪তম স্থানে। ইআইইউ বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ‘হাইব্রিড’ নামে অভিহিত করেছে। ‘হাইব্রিড’ বলতে এমন ব্যবস্থা বোঝায় যেখানে নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনব্যবস্থা প্রায়ই ব্যাহত হয়। এ ছাড়া বিরোধীদের ওপর রাজনৈতিক চাপ, দুর্নীতি, আইনের শাসন ও নাগরিক সমাজব্যবস্থা দুর্বল। গণতন্ত্রবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার বিচারে বাংলাদেশ আংশিক স্বাধীন। স্কোর ১০০ নম্বর হলে যেখানে পুরোপুরি স্বাধীনতা আছে বোঝায় সেখানে বাংলাদেশের স্কোর ৪০। এদিকে গত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্বাচনের প্রাক্কালে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা কমছে।