দেশের খবর: ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার ঘটনায় বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ ৪৯ আসামির সাজা হবে কি না- সেই সিদ্ধান্ত জানা যাবে ১০ অক্টোবর।
হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা আলোচিত দুই মামলায় যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে মঙ্গলবার ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন রায়ের এই দিন ঠিক করে দেন।
আসামিদের মধ্যে কারাগারে থাকা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীসহ ২৩ জনকে যুক্তিতর্কের শুনানির শেষ দিনে ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিশেষ এজলাসে হাজির করা হয়।
শুনানি শেষে রায়ের দিন ঠিক করে দিয়ে সাবেক তিন আইজিপি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদাবক্স, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউকসহ জামিনে থাকা আট আসামিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার কাজ চলে।১৪ বছর আগে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দেওয়া ওই ঘটনার বিচার শুরুর আট বছর একমাস পর মামলা দুটি রায়ের পর্যায়ে এল। দণ্ডবিধি এবং বিস্ফোরক উপাদানাবলী আইনের এ দুই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে মৃত্যুদণ্ড।
রাষ্ট্রপক্ষ বলে আসছে, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে দলকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এই হামলা হয়েছিল এবং তাতে প্রত্যক্ষ মদদ ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের শীর্ষ নেতাদের।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের অভিযোগ, অধিকতর তদন্তে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেককে মামলাটিতে জড়ানো হয়েছে।
শেষ দিনের শুনানিতে আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান যুক্তি উপস্থাপন বরেন। পরে সমাপনী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলী সৈয়দ রেজাউর রহমান।
আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুর রেজাক খান এবং রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলী মোশাররফ হোসেন কাজলও এদিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
এসএম শাজাহান ভারতীয় পুরানের সীতা হরণ পর্ব থেকে উদ্ধৃত করে সেই রূপকের আশ্রয়ে বলেন, প্রসিকিউশনের হাতে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে ওই ঘটনায় এ আসামিরাই জড়িত ছিল। এর ভিত্তিতে তিনি আসামিদের খালাস দেওয়ার আর্জি জানান।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, হামলার ঘটনায় আসামিদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সাক্ষীদের বক্তব্যেই উঠে এসেছে। এর ভিত্তিতে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে দাবি করে তিনি আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান আদালতের কাছে।
রায়ের তারিখ ঠিক করে দেওয়ার আগে বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন দুই পক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা দুই পক্ষের সবাই বলেছেন। আমি একা একজন তা শুনেছি। এ দীর্ঘসময়ে এই এজলাসের সবকিছুই আমার আপন হয়ে গিয়েছিল। মামলার বিচারেও আমি কোনো ফাঁক রাখিনি।”
মামলার বিচারে সহযোগিতা করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবী, উপস্থিত সাংবাদিক, আদালতকর্মী , আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানান বিচারক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে বিচারক উদ্ধৃত করেন- ‘দণ্ডিতের সাথে. দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমানে আঘাতে. সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার’। এরপর বলেন, “রায়ের দিন এলেই বোঝা যাবে, রায় কী হবে।”
মামলা বৃত্তান্ত:
হামলার পরদিন মতিঝিল থানার তৎকালীন এসআই ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। থানা পুলিশ, ডিবির হাত ঘুরে সিআইডি এই মামলার তদন্তভার পায়।
ঘটনার চার বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির।
জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে সেখানে আসামি করা হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচারও শুরু হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে।
সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় আরও ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন। সেখানে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ চার দলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নাম আসে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে এ মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল বলে অধিকতর তদন্তে উঠে আসে। জানা যায়, হামলার বিষয়ে নোয়াখালীর জজ মিয়ার ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দেওয়ার বিষয়টি ছিল নাটক।
২০১২ সালের ১৮ মার্চ সম্পূরক অভিযোগপত্রের আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। নতুন করে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।
রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলার শুনানিতে বলা হয়, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি) সেদিন শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালায়। আর তার পেছনে ছিল তখনকার চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’।
রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল যুক্তিতর্ক শুনানিতে বলেন, অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে এ মামলায় মূল রহস্য উদঘাটন হয়েছে। ঘটনার পরিকল্পনাকারীদেরও ওই অভিযোগপত্রে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
“দেশ তখন পরিচালিত হচ্ছিল হাওয়া ভবন থেকে। হাওয়া ভবনের নেতৃত্বে ছিলেন তারেক রহমান। তিনি যেভাবে চালাতেন, সেভাবে কাজ হত। তারেক রহমান পাওয়ারে থাকায় ওই কুটিল চক্র তার কাছে যায়। আর ওসব ব্যক্তির (জঙ্গি) সঙ্গে তারেক রহমানের সুসম্পর্ক থাকায় তারা সম্মিলিতভাবে ক্ষমতার থাকার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় সুবিধা দিয়ে ওই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।”
রাষ্ট্রপক্ষের ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে মোট ২২৫ জন এ মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন ২০ জন। মোট ১২০ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে মামলা দুটি রায়ের পর্যায়ে আসে।
মঙ্গলবার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তার সৈয়দ রেজাউর রহমান আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা- আইনের বিধান অনুযায়ী আসামিদেরকে যেন সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক আনিত অভিযোগ ২২৫ জন সাক্ষীর মাধ্যমে সম্মানিত আদালতে সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকে আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি।”
‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ তারেকসহ অন্যদের নাম এ মামলার অধিকতর তদন্তে যোগ করার যে অভিযোগ আসামিপক্ষ করে আসছে- তা অস্বীকার করেন রেজাউর রহমান।
তিনি বলেন, “আসামি পক্ষের ওই বক্তব্য আমরা শুরু থেকেই বিরোধিতা করে এসেছি। দুটি মামলায় একজন আসামিও নেই যাদেরকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আসামি পক্ষের এই বক্তব্য অসার, যুক্তিহীন।”
আসামি যারা:
এ মামলায় মোট ৫২ জনের বিচার শুরু করেছিল আদালত। অন্য মামলায় তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় ২১ অগাস্টের মামলায় মোট ৪৯ জনের রায় ঘোষণা করবে আদালত।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া তিনজনের মধ্যে সাবেক জোট সরকাররের মন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
এছাড়া অন্য মামলায় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল রাতে।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ‘প্রশাসনিকভাবে ওই হামলার পরিকল্পনা’ এবং আসামিদের ‘পালাতে সহযোগিতা’ করেন।
মুদ্রা পাচারের এক মামলায় সাত বছর এবং জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজার রায় মাথায় নিয়ে তারেক রহমান দেশের বাইরে পালিয়ে আছেন গত দশ বছর ধরে। তিনিসহ ২১ অগাস্ট মামলার ১৮ আসামি এখনও পলাতক।
পলাতক আসামিদের মধ্যে আরও আছেন- বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক এটিএম আমিন আহমদ, সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ, পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান।
এছাড়া জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মুরসালিন ওরফে মুরসালিন, মোহাম্মদ খলিল, জাহাঙ্গির আলম বদর, ইকবাল, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা লিটন ওরফে দেলোয়ার হোসেন ওরফে জোবায়ের, মুফতি শফিকুর রহমান, রাতুল আহমেদ বাবু ওরফে রাতুল বাবু পলাতক রয়েছেন। পলাতকদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশে আটক হয়েছেন বলে মনে করা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ছাড়া কারাবন্দি আসামিরা হলেন- এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, আবদুর রহিম, শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল, শেখ আবদুস সালাম, আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউছুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু ওমর ওরফে আবু হুমাইয়া ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা সাব্বির আহমেদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মহিব উল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সায়ীদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গির আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামীম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে খাজা ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, আরিফ হাসান সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামীম ওরফে রাশেদ, মো. উজ্জল ওরফে রতন ও হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া।
এছাড়া খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক আইজিপি শহুদুল হক, সাবেক আইজিপি খোদাবক্স, সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ ও ঢাকার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ এতদিন জামিনে থাকলেও মঙ্গলবার তা বাতিল করে তাদের কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
এদের মধ্যে রুহুল আমিন, মুন্সি আতিক এবং আব্দুর রশীদ জোট সরকার আমলে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন।