অনলাইন ডেস্ক: কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে বেড়াতে এসেছিলেন যাদবপুরের বাপুজিনগরের বাসিন্দা ভারতী পাল। কিন্তু অন্যদের কাছে নবনির্মিত বাংলাদেশ ভবনের নাম শুনেই আর ধৈর্য্য ধরতে পারলেন তিনি। প্রবল আগ্রহ নিয়েই শনিবার বাংলাদেশ ভবন পরিদর্শন করতে এসেছিলেন ষাটোর্দ্ধ ওই নারী। আর জাদুঘরে প্রবেশের পরই পুরনো স্মৃতি উসকে দিল ভারতী দেবীকে। তবে বাংলাদেশে জন্ম হলেও বয়স কম থাকার কারণে সেভাবে বাংলাদেশকে মনে নেই তার। ফলে কিছুটা দুঃখও আছে তার মনে। এদিন দুপুরের দিকে জাদুঘরে ঢুকেই দেয়ালে টাঙানো বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন ভারতী দেবী। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পেপার কাটিং। তিনি বললেন, আমার জন্ম বাংলাদেশে, কিন্তু তখন বোঝার মতো বয়স না থাকার কারণে বাংলাদেশকে সেভাবে মনে নেই। এটাই আমার দুঃখ যে আমি বাংলাদেশকে সেখাবে দেখে আসতে পারিনি। আর এখন বোঝার বয়স হয়েছে কিন্তু যাওয়ার কোন সুযোগ-সময় নেই। আজ সেই বাংলাদেশকে সামনে দেখে মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। ভারতী দেবীর সাথেই এসেছেন তার মা যাদবপুরের সুলেখার বাসিন্দা আশি বছর বয়সী নারী অন্নপূর্ণা কুণ্ডু। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ১৯৬২ সালে পরিবারের সাথে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। তিনি জানান, আমাদের প্রত্যেকেরই শিকড় রয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে। বাংলাদেশ ভবনে এসে আগের কথা সব মনে পড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ভবন যে দেখতে পারবো এটাই কখনও ভাবিনি। তবে কেবল অন্নপূর্ণ বা ভারতী দেবীরাই নয় পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত এই ভবনটি এখন পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্প্রীতির ক্ষেত্রে এক অভিনব নিদর্শন হল এই বাংলাদেশ ভবন। গত ২৫ মে ভারত ও বাংলাদেশ-উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এই ভবনটি উদ্বোধন করা হয়। এই ভবনের দুইটি প্রধান আকর্ষণ বিন্দু হল গ্রন্থাগার এবং সংগ্রহশালা বা জাদুঘর। গ্রন্থাগারটি সকলের জন্য আগেই খুলে দেওয়া হলেও গত ১৮ সেপ্টেম্বর জাদুঘরের দরজাও সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। শান্তিনিকতেন গড়ে ওঠা বাংলাদেশ ভবনটিতে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে থাকাকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত কবিতা, গান ও বিভিন্ন মুহূর্তের ছবিসহ বাংলাদেশের ইতিহাস রাখা হয়েছে। ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ডাকটিকিট, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারের একাধিক নির্দেশন রয়েছে এখানে। এছাড়াও সুলতান যুগের বিভিন্ন মুদ্রা, ব্রিটিশ আমলের মুদ্রা, পনেরো-ষোল শতকের মাটি খনন করে প্রাপ্ত টেরাকোটার মূর্তিসহ একাধিক মূল্যবান প্রত্মতাত্মিক নির্দশন রয়েছে এখানে। ভবনটির মাধ্যমে বাংলাদেশকে নতুন করে চেনার দরজা খুলে গেছে বলে মনে করেন এখানে ঘুরতে আসা কলকাতার বাসিন্দা ঝিলাম গুপ্ত। তিনি জানান, এই ভবন এক কথায় অসাধারণ। ভারতের সংস্কৃতির সাথে বাংলাদেশের সংস্কৃতির খুব একটা পার্থক্য নেই। প্রায় একই ধরনের। তবুও সেটাকেই আবার নতুন করে দেখাটা সত্যিই খুব সুন্দর। তবে পুরোনো দিনের শিল্প প্রদর্শনের সমাহার আরও বেশি হলে ভালো হয় বলে অভিমত তার। বাংলাদেশ ভবন নিয়ে গর্ব করেছেন অভিনেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়া ব্যক্তিত্ব চৈতালি দাশগুপ্ত। ভবন পরিদর্শনের পর তিনি জানান, খুলনায় আমার মামার বাড়ি, টাঙ্গাইলে শ্বশুর বাড়ি। বাংলাদেশে আমি বহুবার ঘুরে এসেছি। কিন্তু এই ভবন দেখে আমার মনে হচ্ছে এক খণ্ড বাংলাদেশই আমি দেখছি। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজরিত জায়গা, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যেভাবে এখানে স্থান পেয়েছে তা সত্যিই সুন্দর। সবমিলিয়ে তথ্যবহুল একটা জায়গা বলা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশকে জানতে বা চিনতে এই ভবনের কোন বিকল্প নেই। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সবুজকলি সেন জানান, ‘বাংলাদেশকে জানতে হলে বা গবেষণা করতে গেলে বাঙালিকে শান্তিনিকতনের বাংলাদেশ ভবনে আসতেই হবে।’ তার অভিমত বাংলাদেশ সম্পর্কিত এ রকম গ্রন্থাগার ভারতে আর নেই। জাদুঘর নিয়েও আগ্রহের শেষ নেই দর্শকদের মধ্যে। উপাচার্য জানান, এক সপ্তাহ আগে যেদিন জাদুঘরের দরজা সকলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল ওই দিনই প্রায় ২৫০ এর বেশি দর্শক সেটি দেখতে আসেন। এ থেকেই পরিস্কার যে মানুষের মধ্যে ভালো সাড়া পড়েছে। তিনি আরও জানান, জাদুঘরটিতে অবিভক্ত বাংলার প্রায় তিন হাজার বছরের পুরানো ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। সেই থেকে শুরু করে ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহের ইতিহাস স্থান পেয়েছে এখানে। সব মিলিয়ে মানুষ খুবই আনন্দ পাচ্ছেন এবং গবেষকরাও যদিও এতে উপকৃত হন, তবে সেখানেই এই ভবন নির্মাণের সার্থকতা। বাংলাদেশ ভবনকে সার্থক করে তুলতে দুই দেশের শিল্পী, গুণীজনদের নিয়ে মত বিনিময়, আলোচনা সভা, বাংলাদেশ উৎসবের আয়োজন করা উচিত বলেও মনে করেন উপাচার্য। তবে জাদুঘরটিতে প্রতিটি জিনিসই যে স্থান পেয়েছে তা নয়, এটিকে আরও ভালো করে সাজিয়ে তুলতে বা সমৃদ্ধ করতে আরও দুষ্প্রাপ্য জিনিস বাংলাদেশ নেওয়া হলে বলে জানা গেছে। জাদুঘরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুদর্শনা সেন জানান, ‘এখানে যারা আসছেন, প্রত্যেকেই একটা শ্রদ্ধা নিয়ে আসছেন। তারা প্রত্যেকে ভালোবেসে আসছেন।’ তার অভিমত বাংলাদেশ যেভাবে ভাষাকে সম্মান দিয়ে বা শ্রদ্ধার সাথে রেখেছে কিংবা বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে যেভাবে সকলের সামনে প্রদর্শন করছে-সেটা একটা গর্বের বিষয়। বাংলাদেশ ভবন নিয়ে খুব ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এই ভবনের চিফ কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিনই (১৮ সেপ্টেম্বর) থেকে শিক্ষামূলক ভ্রমণে এসেছিল স্থানীয় চাঁদপাড়া স্কুলের শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী ও বাংলাদেশ থেকে প্রথমদিন ২৫০ জনের মতো দর্শক পেয়েছি এবং প্রত্যেকেই আপ্লুত।’ মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় আরও জানান, এই ভবনের গ্রন্থাগার ও জাদুঘর-দুইটিই অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আপাতত সচিত্র পরিচয় পত্র দেখিয়েই প্রবেশ করা যাবে এই ভবনে। গ্রন্থাগারে বসেই বই পড়ারও সুযোগ থাকছে যদিও এখনই কোন বই বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইস্যু করা হবে না। এই মুহূর্তে গ্রন্থাগারটিতে ৩০৭৪টি বই থাকলেও বাংলাদেশ সরকার আরও অতিরিক্ত তিন হাজার বই দেবে বলে জানিয়েছেন মানবেন্দ্র। তার অভিমত বাংলাদেশ বিষয়ক এতগুলো বই পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতে খুবই দুর্লভ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কেউ যদি অবহিত করতে চান-তাদের কাছে এই গ্রন্থাগারটি অত্যন্ত বড় জায়গা। যদিও ভবনের ক্যাফেটারিয়া এখনই সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে না। আগামী দিনে টেন্ডারের মাধ্যমে এই ক্যাফেটারিয়ার দায়িত্ব কোন সংস্থাকে খুলে দেওয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। তবে বাংলাদেশ ভবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে এখনই কোন প্রবেশমূল্য না থাকলেও ভবনটির রক্ষণাবেক্ষণে দুর্গোৎসবের পরই প্রবেশমূল্য ধার্য করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। যদিও ভবনটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এককালীন আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে পাশাপাশি অর্থ বরাদ্দের জন্য ভারত সরকারের কাছেও আর্জি জানানো হতে পারে জানিয়েছে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। বুধ ও বৃহস্পতিবার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির দিন এবং সরকারি ছুটির দিন বাদে অন্য দিনগুলোতে খোলা থাকবে এই ভবন।