জাতীয়

নেপাল ট্র্যাজেডিতেও ইউএস-বাংলার টনক নড়েনি

By daily satkhira

October 01, 2018

অনলাইন ডেস্ক: ‘ফ্লাই ফাস্ট-ফ্লাই সেফ’ স্লোগানে যাত্রা শুরু করলেও যাত্রীদের নিরাপত্তায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস। যান্ত্রিক ত্রুটি, অব্যবস্থাপনা, অসম প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অনেকবার দুর্ঘটনায় পড়ছে দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি এয়ারলাইনসটি। নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশের এভিয়েশনশিল্পের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনায় পাইলট, ক্রুসহ ৫১ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তারা সতর্ক হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ নোজ গিয়ার অচল হয়ে সামনের চাকা না খোলায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে সংস্থাটির একটি উড়োজাহাজ। এতে বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় ১৬৪ যাত্রী। ওই একই উড়োজাহাজ এর সপ্তাহখানেক আগে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে অচল হয়ে পড়েছিল। ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই যাত্রা শুরুর পর চার বছরে প্রায় ৪৫ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করে দেশের বিমান চলাচলের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে ইউএস-বাংলা। ক্রমাগত ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ালেও নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি সংস্থাটি। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, ফ্লাইট বাড়ানোর পাশাপাশি যাত্রীদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

এভিয়েশন বিশ্লেষকরা জানান, নির্দিষ্ট সময় পর পর একটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ও ল্যান্ডিং গিয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। এ রক্ষণাবেক্ষণের কোনো একটি পর্যায়ে কমতি থাকলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ক্যাপ্টেন নাসিমুল হক রবিবার বলেন, ‘পুওর ইন্সপেকশন, পুওর মেইনটেন্যান্স, মেকানিক্যাল ফেইলিউর, মিস ম্যানেজমেন্টের কারণে উড়োজাহাজের দুর্ঘটনা ঘটছে। যাদের যে কাজ করার কথা তারা যদি তা না করে তাহলে সমস্যা হতেই পারে। ’ দেশের সাম্প্রতিক বিমান দুর্ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে উড্ডয়নের আগে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা না পড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তারা আগে ত্রুটি ডিটেক্ট করতে পারছে না। ফ্লাইট সেফটির যে নিয়ম আছে তা কঠোরভাবে সিভিল এভিয়েশন, বিমান সংস্থা, ইঞ্জিনিয়ারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুসরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো স্বজনপ্রীতি কিংবা কোনো ছাড় দিলেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ’

শাহ আমানতে জরুরি অবতরণের ঘটনায় ইউএস-বাংলার যাত্রী আফসানা রহমান বলেন, ‘নেপালের মতো বড় দুর্ঘটনার পরও ইউএস-বাংলার নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। শুনেছি গত সপ্তাহেও ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পর ল্যান্ডিং গিয়ার না খোলার ঘটনা ঘটেছিল তাদের উড়োজাহাজের। আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই, যাতে বারবার ঘটনা না ঘটে। ’

গত বুধবার ঢাকা থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হলেও ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজের নোজ গিয়ার (চাকা) না খোলায় পাইলটের দক্ষতায় এ যাত্রায় প্রাণে রক্ষা পেয়ে যায় আরোহীরা। ওই ঘটনার পর ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ গত ছয় মাসে একই এয়ারলাইনসের একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে দুর্ঘটনার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ ত্রুটি নয়, ভাগ্যকে দুষছে এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ।

ইউএস-বাংলার যত সমস্যা: শাহ আমানত বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করা ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটি (বিএস-১৪১ ফ্লাইট) ছিল বোয়িং ৭৩৭। এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ে সংস্থাটির এই একই উড়োজাহাজ। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী সকাল সাড়ে ১০টার বিএস ১২৩ ফ্লাইটে এ ঘটনা ঘটে। ১১টার দিকে ওড়ার জন্য রানওয়েতে গিয়ে হঠাৎ নোজ গিয়ার অচল হয়ে যায়। এ সময় অন্যান্য এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়। অবতরণের অপেক্ষায় থাকা বেশ কয়েকটি বিদেশি উড়োজাহাজ ঢাকার আকাশে চক্কর দিতে থাকে। দীর্ঘ সময় পর রানওয়ে থেকে সরিয়ে এক পাশে নেওয়া হয় উড়োজাহাজটি।

চলতি বছর ১২ মার্চ নেপালে ইউএস-বাংলার একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ২৬ বাংলাদেশিসহ ৫১ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালে সংস্থাটির একটি উড়োজাহাজ নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে অবতরণের পর রানওয়ে থেকে ছিটতে পাশের জমিতে চলে যায়। এতে উড়োজাহাজের পেছনের চাকা দেবে যায়।

এ ছাড়া সংস্থাটির মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরগামী একটি উড়োজাহাজ ত্রুটির কারণে ২০ মিনিট পর্যন্ত ওড়ার পর জরুরি অবতরণ করে। গত ১৫ এপ্রিল কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী একটি ফ্লাইট চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে। সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে আসা ৬৭ যাত্রী নিয়ে গত ১২ জানুয়ারি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে এয়ারলাইনসের আরেকটি ফ্লাইট। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, যাত্রী নিয়ে ওই উড়োজাহাজটি দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে সৈয়দপুর ছাড়ে। ওড়ার পর উড়োজাহাজটির একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। অন্য ইঞ্জিন কাজে লাগিয়ে উড়োজাহাজটি শাহজালালে জরুরি অবতরণ করে। এ রকম ঘটতে থাকায় ইউএস-বাংলাকে দুর্ঘটনা হ্রাসে নজর দিতে তাগিদ দিয়েছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা।

শাহ আমানতে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার বিষয়টি জানানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কম্পানিকেও। একই সঙ্গে ঘটনা খতিয়ে দেখছে ইউএস-বাংলার প্রকৌশল বিভাগ। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি। এর নেতৃত্বে আছেন এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন গ্রুপ অব বাংলাদেশের (এএআইজি-বিডি) প্রধান ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ। গতকাল তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রাথমিক প্রতিবেদন দেব। ’

তবে ফ্লাইট পরিচালনা করতে গিয়ে বারবার দুর্ঘটনায় পড়ার পেছনে ইউএস-বাংলার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পরিচালন ত্রুটিকেও দায়ী করছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, নিরাপদ ফ্লাইটের জন্য সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে উড়োজাহাজের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণে। কেবল বাণিজ্যিক বিষয় নয়, বিবেচনায় রাখতে হবে টেকনিক্যাল দিকটিও। পাইলটসহ ত্রুদ্ধদের ডিউটি টাইম যেন অতিরিক্ত না হয় এটি দেখভালের দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের।

ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজের একের পর এক দুর্ঘটনার বিষয়ে নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (আইকাও) নিষেধাজ্ঞা আছে।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) কামরুল ইসলাম বলেন, ‘এই ঘটনা যে কারো ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। এটা এমন নয় যে শুধু ইউএস-বাংলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একটা ঘটনার পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে যখন আরেকটি ঘটনা আসে তখন অনেকে এয়ারলাইনসকে দোষারোপ করে বসে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—সব শেষ ঘটনায় যাওয়ার সময় নোজ গিয়ার ঠিকমতো অপারেট করেছে, কিন্তু নামার সময় পেছনেরগুলো করেছে, কিন্তু সামনেরটা করেনি। প্রতিটি ফ্লাইট পরিচালনার আগে প্রকৌশল বিভাগ রুটিন চেক করে। সিভিল এভিয়েশনের এয়ার অর্ডিনেন্স সার্টিফিকেট ‘রেডি টু ফ্লাই’ ছাড়া কোনো উড়োজাহাজ উড়তে পারে না। মেইনটেন্যান্স আপস করার সুযোগ নেই। ’

২০১৪ সালে বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা হিসেবে যাত্রা শুরু করা ইউএস-বাংলা দুই বছরের মাথায় ঢাকা-কাঠমাণ্ডু রুটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আকাশে প্রবেশ করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি সাতটি আন্তর্জাতিক রুটের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও সাতটি গন্তব্যে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এবং বিমান বোর্ডের সাবেক পরিচালক ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘ফ্লাইট সেফটির ব্যাপারে সিভিল এভিয়েশন অথরিটির কর্তৃত্ব সব এয়ারলাইনসের ওপর। আমরা এয়ারক্রাফটে অর্থ বাঁচানোর জন্য যদি গাফিলতিও করি তা দেখার দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশনের। তারা যদি আরো কঠোরভাবে চেক করে, মেইনটেন্যান্সের সময় যদি তারা থাকে তাহলেই এয়ারলাইনসগুলো সতর্ক হয়। এখানে যা কিছু হয়, তার জন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আবার প্রাইভেট এয়ারলাইনসের ক্ষেত্রে বৈষম্যগুলো দুর করতে হবে। না হলে তাদের টিকে থাকা জটিল হয়ে পড়বে। ’