আন্তর্জাতিক

আজ বিশ্বের সবচেয়ে জটিল নির্বাচনের দেশে ভোট

By daily satkhira

October 07, 2018

অনলাইন ডেস্ক: আপনার দেশের এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন কে? এ প্রশ্নের উত্তর চট করে দিয়ে ফেলবেন। কিন্তু আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বসনিয়ার নেতৃত্বে কে? প্রশ্নটি নিমেষে মাথায় চক্কর দেওয়ার মতো ধাঁধা হয়ে যেতে পারে। গুগলে খুঁজে এর উত্তর পাবেন বটে, তবে হ্যাপা কম যাবে না। জাতিগত বিভক্তি, রাজনৈতিক বিভেদ, জটিল প্রশাসনিক কাঠামো ও ক্ষমতাকে ঘিরে পৃথক সরকারব্যবস্থার লড়াই—এমন সব জটিল হিসাব-নিকাশের মধ্য দিয়ে নেতা নির্বাচনের জন্য বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় আজ রোববার ভোট শুরু হচ্ছে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতিহাসের দেশটি বসনিয়া নামেই বেশি পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, বসনিয়া হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে জটিল নির্বাচনের দেশ। বসনিয়া যুদ্ধের পর ইউরোপের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের দেশটিতে এটি অষ্টম সাধারণ নির্বাচন। কেন্দ্র, দুই স্বতন্ত্র সরকার, ক্যানটন ও ডিস্ট্রিক্ট অব ব্রিচকোতে এই নির্বাচন হবে। কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট (তিনজন), কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট, দুই অংশের অ্যাসেম্বলি, ব্রিচকো ও সার্ব স্বতন্ত্র অংশ রিপাবলিকা স্রেপ্সকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন মনোনীত ৫৩টি দল, ৩৬টি জোট ও ৩৪ স্বতন্ত্র প্রার্থী এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। দেশের বেশির ভাগ মানুষই ভোটার। ভোট দেবেন ৩৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৩৩ জন ভোটার। তিন সদস্যের কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্সি পর্ষদের জন্য প্রার্থী হয়েছেন ১৫ জন। এর মধ্যে বসনীয় আসনের জন্য ছয়জন, ক্রোয়েট আসনের জন্য পাঁচজন এবং সার্বীয় আসনের জন্য চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এই নির্বাচনের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ লাখ ইউরো (৪০ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বেশি)। ১৯৯৫ সালে ডেটন শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে দেশটিতে সাড়ে তিন বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটে। যে যুদ্ধে লাখো লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। স্থানচ্যুত হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। সমালোচকদের দৃষ্টিতে নড়বড়ে চুক্তিটির মাধ্যমে দেশটিকে দুটো আধা স্বতন্ত্র শাসনে বিভক্ত করা হয়েছে, যা একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যুক্ত। এই সরকার বিভক্তিগুলোকে আরও প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং বসনিয়াকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।

একাধিক প্রেসিডেন্টের দেশ বলকান উপদ্বীপে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ত্রিভুজ আকৃতির। বসনিয়া অঞ্চলটি উত্তরে পাহাড় ও গভীর বনবেষ্টিত। বিশাল এলাকাজুড়ে অমসৃণ ও সমতল কৃষিভূমির হার্জেগোভিনা অঞ্চলটি দক্ষিণে। এর সংকীর্ণ উপকূল। দেশটির আয়তন ৫১ হাজার ১২৯ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা ৩৫ লাখ ২৬৩৬ জন। রাজধানীর সারায়েভো। দেশটির মুদ্রার নাম মার্কা।

অন্য দেশের মতো বসনিয়ায় একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন না। বসনীয়, সার্ব ও ক্রোয়েট—এই তিন জাতির সমন্বিত প্রেসিডেন্সি পর্ষদ রয়েছে সেখানে। প্রেসিডেন্সি পর্ষদের নেতৃত্বে বা চেয়ারম্যান পদে আট মাস পরপর পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন আসে।

প্রেসিডেন্সি পর্ষদে এখন রয়েছেন এসডিএ দলের বাকির ইজেৎবেগোচ (বসনীয়), পিডিপি দলের ম্লাদেন ইভানিচ (সার্ব) ও এইচডিজেড বিহ দলের দ্রাগন চোভিচ (ক্রোয়েট)। ১৭ মার্চ থেকে এ পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন বাকির ইজেৎবেগোচ। এর বাইরে রিপাবলিকা স্রেপ্সকার জন্য পৃথক প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। এই অংশের বর্তমান প্রেসিডেন্টের নাম মিলোরাদ দোদিক। দেশটিতে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় ১৯৯৬ সালে। সরকারের মেয়াদ চার বছর।

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় দুটি স্বতন্ত্র পক্ষ রয়েছে। একটি দ্য ফেডারেশন অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, যেটিতে মুসলিম বসনিয়াক ও ক্রোয়েটদের আধিপত্য বেশি। অপরটি হচ্ছে সার্বদের পরিচালিত রিপাবলিকা স্রেপ্সকা। দেশটির পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট। দ্য হাউস অব পিপলস এবং দ্য হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ। হাউস অব পিপলসে ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। এর দুই–তৃতীয়াংশ ফেডারেশন অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার এবং এক-তৃতীয়াংশ স্রেপ্সকার। অর্থাৎ বসনিয়াক (বসনিয়ার মুসলিম), ক্রোয়েট ও সার্বদের পাঁচজন করে সদস্য রয়েছেন এতে। হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে রয়েছেন ৪২ জন সদস্য। এর দুই-তৃতীয়াংশ ফেডারেশন থেকে এবং এক-তৃতীয়াংশ স্রেপ্সকা থেকে ভোটারদের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এর বাইরে দুই অংশের আলাদা প্রেসিডেন্ট, সরকার, সংসদ, পুলিশ ও পৃথক কর্তৃপক্ষ রয়েছে।

সব মিলিয়ে দেশটিতে চারজন প্রেসিডেন্ট, পাঁচটি পার্লামেন্টারি হাউস এবং ১০টি ক্যানটন অ্যাসেম্বলি (শাসনতান্ত্রিক বিভাগ) রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য ভোটাররা তিন সদস্যের প্রেসিডেন্সি পর্ষদ ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত করে। ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কথিত দুই স্বতন্ত্র পক্ষের এই সরকার গঠন হয়।

সার্বদের পরিচালিত রিপাবলিকা স্রেপ্সকার (আরএস) ভোটাররা তাদের একজন প্রেসিডেন্ট ও দুজন ভাইস প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি এমপিদের নির্বাচিত করে। এই অংশের রাজধানীর নাম বানজা লুকা।

আর মুসলিম-ক্রোয়েট ফেডারেশন তাদের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের জন্য দুজন প্রেসিডেন্ট ও দুজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। মুসলিম-ক্রোয়েট ফেডারেশনের ১০টি ক্যানটনের জন্যও ভোটাররা ভোট দিয়ে থাকে।প্রেসিডেন্সি পর্ষদের তিন সদস্য দ্রাগন চোভিচ (ক্রোয়েট), ম্লাদেন ইভানিচ (সার্ব) ও বাকির ইজেৎবেগোচ (বসনিয়াক)। ছবি: বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা প্রেসিডেন্সি কার্যালয়প্রেসিডেন্সি পর্ষদের তিন সদস্য দ্রাগন চোভিচ (ক্রোয়েট), ম্লাদেন ইভানিচ (সার্ব) ও বাকির ইজেৎবেগোচ (বসনিয়াক)। ছবি: বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা প্রেসিডেন্সি কার্যালয়এত জটিল হিসাব–নিকাশের পর যে–কারও মাথায় একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে তাহলে বসনিয়ার নেতৃত্ব কে দেন? এর উত্তরও এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। জাতীয় বা কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ, রাজস্ববিষয়ক নীতি প্রণয়ন, বৈদেশিক বাণিজ্য ও কূটনীতির বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত। এর চেয়ে দুটি স্বতন্ত্র অংশই তুলনামূলক বেশি কেন্দ্রীভূত। তাদের আলাদা পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে।

দুই স্বতন্ত্র অংশের বিভেদ দেশটির শাসনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় বারবার। বসনিয়াক বা মুসলিমরা চায় কেন্দ্র শক্তিশালী হোক। অন্যদিকে, সার্বরা কোনো অবস্থায় স্বতন্ত্র শাসন সমর্পণ করতে রাজি নয়।

আর ক্রোয়েটদের মধ্যে বিভক্তি আরও বেশি। তাঁদের অনেকে আশা করেন, ক্রোয়েটদেরও স্বতন্ত্র শাসন তৈরি হবে।

মেদবহুল আমলাতন্ত্র দেশটিকে আরও অকার্যকর করে তুলছে। দেশটিতে ১৮০ জন মন্ত্রী আছেন। অর্থাৎ ২০ হাজার লোকের জন্য মন্ত্রী একজন। দেশটির আয়তনের সঙ্গে যদি জার্মানির তুলনা করা যায়, তাহলে এ সংখ্যা অনুসারে জার্মানির মন্ত্রী থাকা উচিত চার হাজার। দেশটিতে সরকারি কর্মচারী রয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুসারে, দেশটির রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ চলে যায় সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন দিতে গিয়ে।

বিশ্লেষকদের মতে, ডেটন শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বসনিয়ায় রক্তগঙ্গা বন্ধ হয়েছে ঠিকই, তবে দেশটির একেবারে হাত পা বেঁধে ফেলা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে বসনিয়ার। সে ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দাবি, নানা সরকারের দেশটিকে ‘একটি কণ্ঠে কথা বলতে পারার’ উপায় খুঁজে বের করতে হবে। যদিও বিষয়টি প্রায় দুঃসাধ্য।

স্বতন্ত্র সরকার রিপাবলিকা স্রেপ্সকার প্রেসিডেন্ট মিলোরাদ দোদিক বরাবরই বসনিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে আসছেন। যুদ্ধ–পরবর্তী বসনিয়া তাঁর মতে একটি ‘ব্যর্থ ধারণা’।

১৯৯৫ সাল থেকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল একজন শীর্ষ প্রতিনিধির মাধ্যমে ডেটন শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি দেখছে। এখন এই দায়িত্বে রয়েছেন অস্ট্রিয়ার ভ্যালেনটিন ইঞ্জকো। বসনিয়ায় আইন পাস ও রদ করার ক্ষমতা রয়েছে এই প্রতিনিধির। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটিতে প্রতিনিধির মাধ্যমে জাতিসংঘের নজরদারির বিষয়টি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ২০০৭ সালে এই পদ বিলুপ্ত করার কথা ছিল। তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সংস্কার কর্মকাণ্ডের ব্যর্থতার কারণে পদটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, বসনিয়ার অতীত ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, সেখানে শান্তি বজায় রাখা কঠিন ব্যাপার।২০১৭ সালের ৯ জানুয়ারি দেশটির স্বতন্ত্র সরকার রিপাবলিকা স্রেপ্সকার বিশেষ পুলিশ বাহিনীর প্যারেড।

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা বারবার রক্তাক্ত হয়েছে প্রাচীনকালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে বলা হতো ইলিরিকাম। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই অঞ্চল রোমানরা জয় করে নিজেদের প্রদেশ ডালমেশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে। চতুর্থ ও পঞ্চম খ্রিষ্টাব্দে বেজেনটাইন সাম্রাজ্য ওই অঞ্চল দাবি করলে জার্মানির গোথেরা রোমান সাম্রাজ্যকে অস্বীকৃতি জানিয়ে ওই অংশ দখল করে। ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত সেটি তাদের দখলে ছিল। পূর্ব ইউরোপের জাতি স্লাবরা সপ্তম শতাব্দীতে ওই অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বসনিয়া হাঙ্গেরির কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় এবং এর পরের ২৬০ বছরের মধ্যে এটি স্বাধীন খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

বলকানে অটোমান সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের ফলে ওই অঞ্চলে ভিন্ন সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ধর্মীয় অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ১৩৮৯ সালে কসোভোতে আলোচিত সেই যুদ্ধে তুর্কিরা সার্বদের পরাজিত করে। তারা ১৪৬৩ সালে বসনিয়া জয় করে। আনুমানিক সাড়ে চার শ বছর বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় অটোমান সাম্রাজ্যের শাসন ছিল। ওই সময় অনেক খ্রিষ্টান স্লাব মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে। বসনিয়ার মুসলিম সম্প্রদায় ধীরে ধীরে প্রভাবশালী হতে থাকে এবং তুর্কি প্রভুদের পক্ষে তারা দেশ শাসন করতে থাকে। অটোমান সাম্রাজ্যে সংকুচিত হতে থাকলে উনিশ শতকে বলকানের অন্য মুসলিমরা বসনিয়ায় চলে যেতে থাকে। একই সময়ে বসনিয়ায় ইহুদি জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৪৯২ সালে স্পেন থেকে বিতাড়িত হয়ে অনেক ইহুদি সারায়েভোতে আশ্রয় নিয়েছিল। ওই শতকে সব ধর্মবিশ্বাসের মানুষকে বরণ করে নেয় বসনিয়া। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিয়ে ওই সময় খুব অস্বাভাবিক ছিল না।

১৮৭৬ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রো তাদের মিত্র স্লাবদের নিয়ে রাশিয়ার সহায়তায় যুদ্ধ করে। ১৮৭৮ সালে বার্লিন কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত মেনে রুশ-তুর্কি যুদ্ধের (১৮৭৭-১৭৮) অবসান হয়। ওই সিদ্ধান্ত অনুসারে অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি ওই স্থান দখলে নেয় এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা শাসন শুরু করে। রাশিয়া যেন বলকান শাসন করতে না পারে, সে নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য ইউরোপের সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯০৮ সালের ৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে ওই প্রদেশ অটোমান সাম্রাজ্যেরই অংশ হিসেবে থেকে গেলেও তা অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। এর ফলে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার দাবিদার সার্বিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নেয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৯১৪ সালের ২৮ জুন সারায়েভোতে অস্ট্রিয়ার আর্চ ডিউক ফ্রানজ ফার্দিনান্দকে সার্বিয়ার ছাত্র গ্যাভরিলো প্রিনসিপ হত্যা করে। এই ঘটনা থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯১৮ সালের ২৬ অক্টোবর সার্ব, ক্রোয়েট ও স্লোভেনদের নিয়ে সার্বিয়ায় নতুন রাজ্য গঠিত হয়। এতে যুক্ত করা হয় বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে। ১৯২৯ সালে এই রাজ্যের নামকরণ হয় যুগোস্লাভিয়া।

১৯৪১ সালে জার্মানি যুগোস্লাভিয়ায় হামলা চালালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা নাৎসি–নিয়ন্ত্রিত ক্রোয়েশিয়ার অংশ হয়ে যায়। জার্মান ও ইতালীয়দের দখলে থাকার সময় বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার বাসিন্দারা ক্রোয়েশিয়ার ফ্যাসিবাদী বাহিনী উসতাচির বিরুদ্ধে তুমুল গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে, যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট নেতা মার্শাল টিটো অধীনে একক রাষ্ট্র হিসেবে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা আরও ছয়টি প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে একীভূত হয়। জোড়াতালি দেওয়া জাতির মধ্যে জাতিগত শত্রুতা নিয়ন্ত্রণে রাখে তাঁর কর্তৃপক্ষ। টিটো ১৯৮০ সালে মারা যান। কঠিন আবরণ খসে যাওয়ায় এবং ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক অসন্তোষের মুখে যুগোস্লাভিয়া ভাঙতে শুরু করে।

স্বাধীন হলেও নতুন যুদ্ধ শুরু ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) স্বীকৃতি চাওয়া হয়। ১৯৯২ সালের মার্চে এক গণভোটে বসনিয়ার ভোটাররা স্বাধীনতা বেছে নেয়। প্রেসিডেন্ট আলিজা ইজেৎবেগোচ এটিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। বসনিয়ার বাসিন্দাদের মধ্যে মুসলিম ৪৪ শতাংশ, সার্ব ৩১ শতাংশ ও ক্রোয়েট ১৭ শতাংশ। এই তিন জাতির প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থা গড়ে ওঠে সেখানে। তবে স্বাধীন হয়েও সেখানে শান্তি ফিরে আসেনি, শুরু হয় জাতিগত যুদ্ধ।

স্বাধীনতার এই ঘোষণা বসনীয়-সার্ব রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। সার্বীয় সরকারের প্রধান স্লোবদান মিলসোভিচের সহায়তায় বসনীয়-সার্ব বাহিনী এবং যুগোস্লাভ পিপল’স আর্মি রাষ্ট্রটির সার্বীয় অংশ নিজেদের দখলে নিতে রিপাবলিক অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় হামলা চালায়। এরপর খুব দ্রুত বসনিয়াজুড়ে যুদ্ধ শুরু হয়। বসনিয়ার বিভিন্ন অংশের (বিশেষ করে পূর্ব বসনিয়ার) জাতিগত জনগোষ্ঠী এই যুদ্ধে অংশ নেয়।

ক্রোয়েশীয় ও সার্বীয় প্রেসিডেন্ট দুজন নিজেদের মধ্যে বসনিয়াকে ভাগ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। সার্বীয় যুগোস্লাভ সেনাদের সহায়তায় সার্বীয় সংখ্যালঘুরা নিজেদের অঞ্চলগুলোকে ভাগ করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে সারায়েভো দখলদারিত্বে নেমে জাতিগত নিধন শুরু করে। মুসলিমদের গণহত্যা শুরু করে। ক্রোয়েটরাও নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তি শুরু করে। ১৯৯২ সালের আগস্টের শেষে বিদ্রোহী বসনীয় সার্বরা বসনিয়ার ৬০ শতাংশ দখল করে নেয়। উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট (ন্যাটো) এতে হস্তক্ষেপ করার পর যুদ্ধের তীব্রতা কমে আসে। ১৯৯৫ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বসনিয়ায় সার্বদের লক্ষ্য করে বোমা ফেলে ন্যাটো বাহিনী। সার্ব জাতিসংঘের নিরাপদ এলাকা তুজলা, জেপা ও স্রেব্রেনিৎসায় ঢুকে পড়ে মুসলিম নিধন শুরু করে। বলা হয়, ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে আড়াই লাখ লোকের মৃত্যু হয়। যুদ্ধ বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ১৯৯৫ সালের ২১ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ডেটনে ‘দ্য জেনারেল ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট ফর পিস ইন বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা’ প্রণীত হয়। এটি ‘ডেটন চুক্তি’ বা ‘ডেটন শান্তি চুক্তি’ নামেও পরিচিত। ১৯৯৫ সালে ১৪ ডিসেম্বর প্যারিসে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচ, ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট ফ্রেনজো তুজমান এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার প্রেসিডেন্ট আলিজা ইজেৎবেগোচ।

১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিন সদস্যের প্রেসিডেন্সি পর্ষদে বসনিয়াক বা বসনীয় মুসলিম ইজেৎবেগোচ চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। তবে সব জাতির প্রতিনিধিত্ব থাকলেও সরকার জাতিগত সমস্যা সমাধান বা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য কমই দেখাতে পেরেছে। সেখানে শান্তি রক্ষায় ন্যাটো বাহিনী অকার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তবে জটিল প্রশাসনিক কাঠামো আর তীব্র জাতিগত বিভেদের দেশটিতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা থাকলেও সেখানের শীর্ষ ব্যক্তিদের বসনিয়া যুদ্ধ ও স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার দায়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে শীর্ষ ব্যক্তিদের বিচার বসনিয়ার যুদ্ধ চলাকালে সার্ব বাহিনী ছোট শহর স্রেব্রেনিৎসার প্রায় আট হাজার মুসলিম পুরুষ ও ছেলে শিশুদের হত্যা করে। তারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের হেফাজতে ছিল। এর বাইরে বসনিয়া যুদ্ধের জন্য মুসলিম নেতাদেরও অভিযুক্ত হয়ে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নেদারল্যান্ডসের হেগে শহরে এই যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করে। দ্রাজেন এরদেমোভিচ নামের একজন ক্রোয়েট সার্বদের পক্ষে স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যায় অংশ নেওয়ার দায়ে পাঁচ বছরের সাজা পান। ওটাই ছিল প্রথম রায়। এরপর ২০০১ সালে বসনিয়ার সার্ব জেনারেল রাদিমলাভ ক্রস্টিচকে স্রেবেনিৎসা গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেন আদালত। ১৯৫১ সালে জাতিসংঘের গণহত্যার বিচারবিষয়ক চুক্তি হওয়ার পর ইউরোপের কোনো দেশের জন্য সেটি ছিল প্রথম বড় ধরনের রায়। রায়ে তাঁকে ৪৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ওই বছর সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলাএই বিচারের রায় ঘোষণার আগেই ২০০৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

ডেটন চুক্তি অনুসারে বসনিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক প্রশাসক প্যাডি অ্যাশডাউনের ক্রমাগত চাপের মুখে স্রেবেনিৎসা গণহত্যার দায় ২০০৪ সালের জুনে সার্ব নেতারা স্বীকার করেন। বসনিয়া যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দাবি করলেও আদালত তা বাতিল করেন। তবে বিচারক রোজালিন হিঙ্গিস গণহত্যা প্রতিরোধ করতে না পারায় সার্ব নেতাদের ভর্ৎসনা করেন।

২০০১ সালে তিনজন মুসলিম জ্যেষ্ঠ জেনারেলও বসনিয়া যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হন। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সার্বের রাজনৈতিক দল এসডিএস যুদ্ধের সময়ের তাদের নেতা রাদোভান কারাদিচ সহ সন্দেহভাজন সব যুদ্ধাপরাধীকে বহিষ্কারে ভোট দেয়। ২০০৭ সালে শীর্ষ পলাতক জ্রাভকো তলিমির ও ২০০৮ সালে রাদোভান কারাদিচ গ্রেপ্তার হন। ২০১২ সালে তলিমিরকে যাবজ্জীবন ও ২০১৬ সালে কারাদিচকে ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সার্বিয়া কর্তৃপক্ষ যুদ্ধাপরাধের দায়ে সার্ব সাবেক সেনাপ্রধান রাতকো ম্লাদিচকে ২০১১ সালে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধীর একজন বলা হয়ে থাকে। স্রেবেনিৎসা গণহত্যার দায়ে তাঁর বিচার শুরু হয়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, বিবিসি, এএফপি, বলকান ইনসাইট