অনলাইন ডেস্ক: ভারতে গত মাসে রাতারাতি ৫০০ ও হাজার রুপির নোট বাতিলের পেছনে সরকারের আসল উদ্দেশ্য কী, সেই বিতর্ক ক্রমেই নাটকীয় মোড় নিচ্ছে।
বিরোধীরা ইতিমধ্যেই অভিযোগ তুলেছেন, এই পদক্ষেপে কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই আদৌ সফল হয়নি – তাই সরকার এখন ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ বা নগদহীন লেনদেনের কথা বলে মানুষের নজর ঘোরাতে চাইছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার মাসিক রেডিও ভাষণে ক্যাশলেস সোসাইটির জন্য নানা পুরস্কার ঘোষণা করে সেই বিতর্ককেই আরও উসকে দিয়েছেন।
কিন্তু ভারত কি সত্যিই এমন লেনদেনের জন্য প্রস্তুত – না কি সরকারের আসল উদ্দেশ্যটাই সম্পূর্ণ আলাদা?
ভারতে কালো টাকার খুব কম অংশই নগদে রাখা হয় – ফলে বড় অঙ্কের নোট বাজার থেকে তুলে নিয়ে কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই আদৌ লড়া সম্ভব নয়, এ নিয়ে গত মাসেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন দেশের বহু অর্থনীতিবিদ। এখন দেখা যাচ্ছে, মানুষের কষ্ট করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদির বেঁধে দেওয়া ৫০ দিনের সময়সীমা যখন দ্রুত ফুরিয়ে আসছে – তখন তার নিজের মুখেও কালো টাকার বদলে বেশি শোনা যাচ্ছে ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার কথা। রোববার তার ‘মন কি বাত’ ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পুরো দেশ জুড়ে এখন লোকের মুখে মুখে একটাই প্রশ্ন, একটাই চর্চা – ক্যাশলেস কী জিনিস, কীভাবে ক্যাশ বা নগদ ছাড়াও বেচাকেনা সম্ভব সবাই তা এখন শিখতে উৎসুক!”
“আজ বড়দিনের উপহার হিসেবে সরকারও এই ক্যাশলেসে উৎসাহ দিতে দুটো প্রকল্প ঘোষণা করছে, যে ব্যবসায়ীরা ডিজিটাল বা মোবাইল পেমেন্ট করবেন তারা আয়করে ছাড় পাবেন, একইভাবে রোজ লটারির মাধ্যমে পনেরো হাজার ক্রেতার অ্যাকাউন্টেও জমা পড়বে হাজার রুপির ইনাম,” জানান তিনি। ভারতের বিরোধী দলগুলো মনে করছে, এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী কার্যত মেনে নিচ্ছেন যে কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই মোটেও সফল হয়নি – তার বদলে সরকার এখন নগদবর্জিত লেনদেনের ওপরেই গুরুত্ব আরোপ করতে চাইছে। কংগ্রেস ভাইস-প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী তো সরাসরি অভিযোগ করেছেন, এই ধরনের পেমেন্টকে উৎসাহ দিয়ে সরকার কিছু কর্পোরেট সংস্থাকে সুবিধে পাইয়ে দিচ্ছে। তিনি বলছেন, “ক্যাশলেস করার মানে হল প্রতিটা লেনদেনে বিশেষ কয়েকটা লোককে ফায়দা লোটার ব্যবস্থা করে দেওয়া। যেমন, মোবাইল ওয়ালেট পেটিএম তো আমি বলব পে টু মোদি। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতিকে তিনি ধ্বংস করে ফেলছেন – বিশেষ করে গরিব মানুষ, চাষী, দিনমজুর বা মেহনতি জনতাকে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে।” Iক্যাশলেসে কার ফায়দা, সেটা অন্য প্রশ্ন – কিন্তু অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশ মনে করেন কালো টাকা নয়, একেবারে প্রথম থেকেই সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতে হাজার হাজার কোটি টাকার নগদ লেনদেনের অধিকাংশকে ট্যাক্স স্ক্রটিনির আওতায় নিয়ে আসা – এবং সেই সঙ্গে রুগ্ন ব্যাঙ্কগুলোতে মূলধনের পরিমাণ বাড়ানো। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদকেই সামনে তুলে ধরতে হয়েছে বলে অধ্যাপক খাসনবিশের ধারণা। তিনি বলছেন, “যেটা খুব সচেতনভাবে করা হয় তা হল প্রথমে এমন একটা ন্যারেটিভ রাখা হয়েছিল যেটা মানুষ খাবে। খেয়াল করে দেখুন আপনি যদি বাজারে কারেন্সির জোগান কমাতে চান তাহলে আগে কোনওভাবে আগের কারেন্সি তুলে নিতে হবে। ভারতে ষোলো লক্ষ কোটি টাকার নগদ লেনদেন বন্ধ করতে গিয়ে আপনি যদি ব্যাঙ্কে গ্রাহকদের বলেন টাকা দেওয়া সম্ভব নয় কারণ টাকা আসছে না – সেই গল্প মানুষ খাবে না, ব্যাঙ্কে ভাঙচুর হয়ে যাবে!” “ফলে এর জন্য মানুষকে আগে প্রস্তুত করতে হবে। আর তার শ্রেষ্ঠ উপায় হল লোককে বোঝানো সীমান্তে দাঁড়িয়ে সেনারা দেশের জন্য প্রাণ দিচ্ছে, তুমি না-হয় কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়তে কদিন লাইনে দাঁড়িয়ে একটু কষ্ট করলে!” বলেন তিনি। “এর সঙ্গে একটা ন্যাশনাল হইচই ও দেশাত্মবোধক সুড়সুড়ি সবই জুড়ে দেওয়া হল – যাতে মানুষ এই জিনিসটা ধরে নেন এই টাকাগুলো এখন হাত থেকে চলে যাচ্ছে ঠিকই – কিন্তু শিগগিরি নতুন টাকা আবার হাতে চলে আসবে!” বলছিলেন রতন খাসনবীশ। সেই নতুন টাকা আজও আসেনি – এবং ভারতে অনেক বিশেষজ্ঞই এখন মনে করছেন নতুন নগদের জোগান সীমিত রাখা হচ্ছে ইচ্ছে করেই, কারণ সেটা সরকারের এক বৃহত্তর পরিকল্পনা বা গেমপ্ল্যানের অংশ। তবে যে দেশে এখনও প্রায় চল্লিশ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, সেখানে এভাবে কড়া দাওয়াই দিয়ে সমাজকে ক্যাশলেস করার এক্সপেরিমেন্ট আদৌ সফল হবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানাই।