দেশের খবর: শাপলা চত্বর অবরোধ করে সরকার পতনের চেষ্টা করেছিল হেফাজতে ইসলাম। সেই হেফাজত এখন সরকারের পক্ষে কথা বলছে। সংগঠনটির আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীও এখন ‘শেখ হাসিনাতে মুগ্ধ’। শাপলা চত্বরের ঘটনার পর শেখ হাসিনার সরকারকে ‘নাস্তিক-মুরতাদের দোসর’ বলে অভিহিত করলেও এখন আল্লামা শফী বলছেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ হলেও কোনো আপত্তি নাই। এ দলে এমন মানুষ আছে, যারা দ্বীনকে ভালোবেসে মোটা অঙ্কের টাকা মাদ্রাসায় সাহায্য করে।’ হেফাজতকে বশে আনার জন্য চারটি পন্থা প্রয়োগ করেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। শেষ পর্যন্ত সফলতাও মিলেছে তাতে। হেফাজতে ইসলাম এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গণসংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ জন্য সংগঠনটি ১৫ সদস্যের কমিটিও গঠন করেছে। এ প্রসঙ্গে হেফাজতের আমির মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, কওমি সনদের মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দিয়ে হেফাজতের প্রতি দরদ দেখিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারা তাই তাকে সংবর্ধনা দেবেন। এদিকে নির্বাচনের আগে হেফাজতে ইসলামের এমন অবস্থান টেনশন বাড়িয়েছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির। কারণ হেফাজতের ভোট ব্যাংক টার্গেট করে আল্লামা শফীর সঙ্গে এ দুটি দলের নীতিনির্ধারকরাও অনেকদিন হলো যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি ও ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, ‘ভোটের মাঠে হেফাজতকে ফ্যাক্টর মনে করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তাই নীতিগত মিল না থাকলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছে। হেফাজতের হঠাৎ সুর পাল্টানো এ রাজনীতিরই অংশ।’ এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। তবে তাদের একটি বড় ভোট ব্যাংক রয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সমর্থন প্রত্যাশা করে।’
বশে আনতে চার পন্থা: পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চারটি পন্থা প্রয়োগ করে হেফাজতে ইসলামকে আওয়ামী লীগ বশে এনেছে। এগুলো হলো- কওমি সনদকে মাস্টার্সের সমমানের স্বীকৃতি দেওয়া, হেফাজতের বিরুদ্ধে সারাদেশে দায়ের করা ৮৩টি মামলার সবগুলো নিষ্ক্রিয় করে রাখা, সংগঠনটির তহবিলে নিয়মিত দান-খয়রাত করা ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগের মাধ্যমে উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি করা। হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগও রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার বার্তা নিয়ে আল্লামা শফীর সঙ্গে দেখাও করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল জয়নাল আবেদিন। এসব কারণে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি নানাভাবে চেষ্টা করেও হেফাজতকে নিজেদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলতে পারেনি।
বিএনপির হয়ে হেফাজতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন। জাতীয় পার্টির হয়ে যোগাযোগ রাখেন হাটহাজারীর সাংসদ ও বনমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। শাপলা চত্বরের ঘটনার পর আল্লামা শফীর সঙ্গে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজে দেখা করেছেন। হেফাজতের ভোট ব্যাংক নিজেদের পক্ষে টানতেই কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতারা যোগাযোগ রেখেছেন হেফাজতের আমিরের সঙ্গে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চমক দেখাতে পেরেছে আওয়ামী লীগ।
হেফাজতের ভোট ব্যাংক: বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু হেফাজতের হিসাবে সারাদেশে তাদের ৩০ হাজার মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী রয়েছে ৫০ লক্ষাধিক। কওমি মাদ্রাসা উত্তীর্ণ সাবেক শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৮৫ লাখ। তাদের প্রত্যেকের পরিবারে গড়ে তিনজন সদস্য ধরে প্রায় আড়াই কোটি ভোটার থাকার দাবি করছেন হেফাজতের আমির মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
মাওলানা আজিজুল বলেন, আসন্ন নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের ভোট ব্যাংক বড় ফ্যাক্টর। এটি বুঝতে পেরে বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। কিন্তু তারা শত প্রলোভন উপেক্ষা করে রাজনীতি থেকে দূরে রয়েছেন। তবে কোনো মুসলমান যদি তাদের সঙ্গে দেখা করতে চান, তারা তাদের না করেন না। কে কোন রাজনৈতিক দল করে, সেটি তাদের বিবেচ্য বিষয়ও নয়।
শেখ হাসিনাতে মুগ্ধ আল্লামা শফী: হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী জানান, কওমি সনদের স্বীকৃতি একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। বিশাল সম্মানের বিষয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটি তাকে দিয়ে সম্মান দেখিয়েছেন। এ জন্য তারা তার কাছে কৃতজ্ঞ। আল্লামা শফী বলেন, ‘উনি (শেখ হাসিনা) এটা আমাকে এমনি মহব্বত করে দিয়েছেন। আমি আওয়ামী লীগ হই নাই। আপনাদের এ রকম কথাবার্তা ভুল। কথাবার্তা বলার সময় সত্য-মিথ্যা যাচাই করে বলবেন। কী করে বলেন আমি আওয়ামী লীগ হয়ে গেছি?’ তিনি এ কথাও বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ হলেও কোনো আপত্তি নাই। এ দলে এমন মানুষ আছে, যারা দ্বীনকে ভালোবেসে আমাদের মোটা অঙ্কের টাকা মাদ্রাসায় সাহায্য করে।’
গত ১ অক্টোবর দারুল উলুম হাটহাজারীর ছাত্র মিলনায়তনে বেফাকুল মাদারিসিল আরবিয়া বাংলাদেশ ও আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের ২০১৮ সালের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় মুমতাজ (জিপিএ ৫) প্রাপ্ত চট্টগ্রাম বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ এবং ‘কওমি মাদরাসার ঐতিহ্য ও অবদান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আল্লামা শফী এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীকে গণসংবর্ধনা দিতে কমিটি গঠন: দশম জাতীয় সংসদের ২২তম অধিবেশনে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান দিয়ে বিল পাস করা হয়। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গণসংবর্ধনা দেবে আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কাওমিয়া বাংলাদেশ। হেফাজত দুর্গ বলে খ্যাত দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় গত সোমবার অনুষ্ঠিত হাইয়াতুল উলইয়ার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ জন্য গঠন করা হয়েছে ১৫ সদস্যের একটি গণসংবর্ধনা বাস্তবায়ন কমিটি। হাইয়াতুল উলইয়ার কো-চেয়ারম্যান মাওলানা আশরাফ আলীকে এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। তবে কবে বা কখন এ সংবর্ধনা দেওয়া হবে, তা এখনও ঠিক করা হয়নি। উল্লেখ্য, হাইয়াতুল উলইয়ার চেয়ারম্যান ও হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
নিষ্ফ্ক্রিয় সেই ৮৩ মামলা: ১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ করেছিল। এক পর্যায়ে সরকার পতনের দাবিতে ব্যাপক তাণ্ডবও চালায় তারা। এ ঘটনায় চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ৮৩টি মামলা হয়। এসব মামলায় হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীসহ তিন হাজার ৪১৬ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয়। এসব মামলার মধ্যে এখন তদন্তাধীন আছে ৬২টি। গত পাঁচ বছরে এসব মামলার আসামির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পুলিশ। ৮৩টি মামলার মধ্যে কেবল বাগেরহাটের একটি মামলায় বিচার শেষ হয়েছে। রায়ে খালাস পেয়েছেন প্রত্যেক আসামিই। দুটি মামলার অভিযোগ প্রমাণ করতে না পেরে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে শেষ করে দিয়েছে। ১৮টি মামলার অভিযোগপত্র দায়ের হলেও বিচার শুরু হয়নি এখনও। হেফাজতকে বশে আনার ক্ষেত্রে কওমি সনদের পাশাপাশি এসব মামলার নিষ্ফ্ক্রিয়তাও গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বলে মনে করেন বিশ্নেষকরা। তথ্যসূত্র: সমকাল অনলাইন।