জাতীয়

ভাঙাগড়ায় অস্থির রাজনীতি

By daily satkhira

October 17, 2018

দেশের খবর: ভোটযুদ্ধের দামামা বাজছে। টালমাটাল রাজনীতির মাঠ। একদিকে কোমর বেঁধেই আছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন জোট। আরেক দিকে তুমুল প্রস্তুতি বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী জোটে। তাল মিলিয়ে চলছে ভাঙাগড়ার খেলা। গতকালও ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেছে এনডিপি ও বাংলাদেশ ন্যাপ। আরো চারটি দল বেরোনোর পথে।

মিত্র বাড়তে পারে আওয়ামী লীগের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নতুন করে মিত্রের সন্ধানে নেমেছে। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে নির্বাচনী মহাজোটের কলেবর বৃদ্ধির। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে আসছে—এমনটা ধরে নিয়েই প্রস্তুতি শুরু হয়েছে ক্ষমতাসীন মহলে। তারা আশা করছে, তাদের নির্বাচনী মহাজোটে কয়েকটি দল যোগ দেবে। নতুন দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে মহাজোটগতভাবে নির্বাচন, নাকি আওয়ামী লীগ এককভাবে মাঠে নামবে, সে বিষয়টি নির্ভর করছে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির সিদ্ধান্তের ওপর। বিএনপি নির্বাচনে এলে মহাজোটগতভাবে নির্বাচনের ঘোষণা দেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট সূত্র কালের কণ্ঠকে এ তথ্য জানিয়েছে।

মহাজোটের কলেবর বৃদ্ধি করার চেষ্টার বিষয়টি স্বীকার করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম মঙ্গলবার বলেন, ‘নতুন দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। তবে বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে রাজনৈতিক মেরুকরণের ওপর।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে এলে এক ধরনের চিন্তা, না এলে ভিন্ন চিন্তা রয়েছে। বিএনপি এলে মহাজোটগতভাবেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে। নতুন কয়েকটি দলের সঙ্গে এ নিয়ে যোগাযোগ হচ্ছে।’

আজ বুধবার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১৪ দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেও নতুন মিত্রদের বিষয়টি আলোচনায় স্থান পেতে পারে। আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, তারা চেষ্টা করছে কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এবং এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে এলডিপি ও বিকল্পধারাও মহাজোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। শেষ পর্যন্ত যদি তা না হয়, তাহলে নির্বাচনী সমঝোতা হবে। অলি আহমদ তিনটি আসন চান। বি চৌধুরী তাঁর ছেলে মাহী বি চৌধুরী ও মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের আসন দুটি চাইতে পারেন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এর বাইরে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সঙ্গে আলোচনা চলছে। জাকের পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা আমীর ফয়সলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতারা কথা বলেছেন বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। জাকের পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা আমীর ফয়সল ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ড. সায়েম আমীর ফয়সল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করতে এলে দুই দলের নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়।

ইসলামী দলগুলো ছাড়াও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সিপিবিসহ বামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। সিপিবিসহ বেশ কয়েকটি বামপন্থী দল দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে। এবারও নির্বাচনে যাবে কি যাবে না সে ব্যাপারে সিপিবি নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। আওয়ামী লীগ চাইছে বিএনপি বর্জন করলেও তারা যেন নির্বাচনে অংশ নেয়।

দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বাম জোট নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আজকে একটি বিষয় ভালো লাগছে যে বামপন্থীরা এক সুরে কথা বলছেন। সেটি হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে তাঁরা নেই। এই উচ্চারণ যাঁরা করেছেন, আসুন না আমরা মিনিমাম পয়েন্টে ম্যাক্সিমাম ইউনিটি গড়ে ফেলি।’ এদিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের সঙ্গেও আওয়ামী লীগের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি মহাজোটের প্রধান শরিক। বিএনপি নির্বাচনে এলে জাতীয় পার্টি মহাজোটগতভাবেই নির্বাচন করবে—এমন দাবি ক্ষমতাসীনদের। তাদের কৌশল নিজেদের ঐক্য সুসংহত করার পাশাপাশি বিএনপির ঐক্যে ভাঙন সৃষ্টি। এরই মধ্যে এ বিষয়ে অনেকটা সফল হয়েছে ক্ষমতাসীনরা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যায়নি বিকল্পধারা। গতকাল ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি)।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক মেরুকরণের ওপর নির্বাচনী জোট, মহাজোট গঠনের বিষয়টি নির্ভর করছে। বিএনপি নির্বাচনে এলে নিশ্চয় তাঁরা জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে জানান।

আওয়ামী লীগ বেশ আগেভাগেই মিত্র খুঁজে বের করতে অনেকগুলো দলের সঙ্গে আলোচনা করেছিল। গত ১৮ জুলাই ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে তৃণমূল বিএনপি চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ জাতীয় জোটের প্রধান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের আলমগীর মজুমদার, সম্মিলিত ইসলামিক জোটের মাওলানা জিয়াউল হাসান, ইসলামিক ফ্রন্টের সৈয়দ বাহাদুর শাহ, কৃষক শ্রমিক পার্টির ফারহানা হক চৌধুরীসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলন, জাগো দল, একামত আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক জোটের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতারা। বৈঠকে নির্বাচনী মহাজোটে অন্তর্ভুক্তির বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের পক্ষে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, দিলীপ বড়ুয়া, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, শিরীন আখতার প্রমুখ।

এ বিষয়ে অগ্রগতি সম্পর্কে তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয় জোটের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা জানান, একসঙ্গে নির্বাচন করার পরিকল্পনা থেকেই তিনি ২৫ জন প্রার্থীর একটি নামের তালিকা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠিয়েছেন। মহাজোটে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

বিএনপি জোট বাড়ার সঙ্গে কমছেও ক্ষমতাসীন জোট ও বলয়ের বাইরে থাকা সব দলকে এক কাতারে আনতে দীর্ঘদিনের চেষ্টার ফসল হিসেবে বিএনপি কয়েকটি দলকে নিয়ে সম্প্রতি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট গড়েছে। কিন্তু নতুন জোট গড়ার তিন দিনের মাথায় ভাঙন দেখা দিয়েছে পুরনো জোটে। মঙ্গলবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি)। জোটের শরিক আরো কয়েকটি দল একই পথে হাঁটতে পারে বলে জানা গেছে। জোটের অন্যতম শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) বর্তমান জোটেই থাকছে নাকি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে যাচ্ছে, নাকি এলডিপির নেতৃত্বে নতুন কোনো জোট হচ্ছে—এসব নিয়ে এখন রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা রয়েছে। এমনও শোনা যাচ্ছে, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম আসন্ন নির্বাচনকালীন সরকারেও থাকতে পারেন।

২০ দলীয় জোটের শরিক একটি দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা জানান, আরো অন্তত চারটি দল এই জোট ছাড়ার চিন্তা করছে। ওই চারটি দলের মধ্যে আছে ধর্মভিত্তিক একটি দল। এ ছাড়া ২০ দলীয় জোটের শরিক যে চারটি দলকে এরই মধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে, সেগুলোর মধ্যেও একটি দল জোট ছাড়ার পথে আছে। ওই দলেরই এক সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ছাড়ার পক্ষপাতী চারটি দলের নেতারা গতকালই নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন। এর কারণ জানতে চাইলে ওই নেতা বলেন, বিএনপি তার পুরনো মিত্রদের অবমূল্যায়ন করায় সংশ্লিষ্ট দলগুলোর মধ্যে ক্ষোভ ছিল আগে থেকেই। সম্প্রতি এই ক্ষোভ আরো বেড়েছে।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘সকলেরই নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা আছে। তাই কে থাকবে আর কে থাকবে না এটা তাদের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার।’ বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে এটা ঠিক। আর ২০ দলীয় জোট থেকে দলগুলোকে বের করতে সরকার তো বসেই আছে।’ এদিকে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২০ দলীয় জোটে ভাঙনের সুর নিয়ে চিন্তিত নয় বিএনপি। বরং দুটি দল চলে যাওয়ায় বিএনপি কিছুটা ক্ষুব্ধ। দল দুটিকে ফেরাতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না বলেও জানান বিএনপির নেতারা।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘তারা (বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপি) যেসব কারণ দেখিয়ে জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে, তা সঠিক নয়। আমরা সব সময় ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে আলোচনা করেই সব সিদ্ধান্ত নিই। কাউকে অবমূল্যায়ন করা হয়নি। আসন ভাগাভাগি নিয়ে আমরা এখনো কোনো আলোচনাই করিনি। আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করতে নানা ধরনের চক্রান্ত চলছে।’ নজরুল ইসলাম খান আরো বলেন, ‘আশা করি ন্যাপ ও এনডিপি তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘আমরা গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এ জন্য ফ্রন্ট গঠন করা হয়েছে। এই ফ্রন্টের সবাই তো এক অনুসারী নয়। তার পরও এক হয়েছি, কারণ এই সরকারকে হটাতে হবে। এই পরিস্থিতিতে দুটি দল কেন চলে গেল তা পরিষ্কার নয়। হয়তো তারা সরকারি তরফ থেকে কোনো প্রপোজাল পেয়েছে বা নিজেরাই থাকতে চাচ্ছে না। তবে যাই হোক, আমরা তাদের নিয়ে চিন্তিত নই এবং তাদের জোটে ফেরাতে উদ্যোগও নেওয়া হবে না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক আগে থেকেই ২০ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি নিবন্ধিত দল নির্বাচনে তাদের আসন নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে আসছিল। কিন্তু বিএনপি সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে বরং নতুন ফ্রন্ট গঠনে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে বিকল্পধারার সঙ্গে বিএনপির ঐক্যের চেষ্টা ভালোভাবে নেয়নি ২০ দলীয় জোটের শরিক কয়েকটি দল। এ ছাড়া তাদের অভিযোগ ছিল, জোটের বৈঠক হয় শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য। এই পরিস্থিতিতে দুটি দল বেরিয়ে গেছে। এর আগে ২৭ সেপ্টেম্বর জোটের বৈঠকে বিকল্পধারার সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা নিয়ে নানা কথা হয়। সর্বশেষ গত সোমবার ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের ‘এক-এগারো’কালীন ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের সময় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছিলেন। এখন কিভাবে তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন?’ এ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে তাঁর বাদানুবাদ হয়। মির্জা ফখরুল ন্যাপের মহাসচিবকে তাঁর বক্তব্য শেষ করতে দেননি। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এখন এসব প্রশ্ন তোলার, দোষত্রুটি খোঁজার সময় নয়।

গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত আমরা নিজেরা কোনো জোটের সঙ্গে যাচ্ছি না। তফসিল ঘোষণার পর আমাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতে পারে। এর আগে একলা চলো নীতিতে আমরা আমাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করব।’

জোট ছাড়ার ঘোষণা দুই দলের: গতকাল বিকেলে রাজধানীর গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছড়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপি। দল দুটির নেতারা জানান, জোটের বিভিন্ন বৈঠকে শরিক দলগুলোর মনোনয়নের বিষয়টি সামনে আনতে চাইলেও বিএনপি কৌশলে তা এড়িয়ে যায়। ‘এক-এগারোর কুশীলব, মাইনাস টু ফর্মুলার বাস্তবায়নকারীরা’ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় বিএনপি তার সব নৈতিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া এবং এনডিপির চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্তজা ও মহাসচিব মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসাসহ দুই দলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী উপস্থিত ছিল।

লিখিত বক্তব্যে জেবেল রহমান গানি বলেন, ‘‘বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটকে সম্প্রসারণ করে ১৮ দলীয় জোটে রূপান্তরের সময় থেকে বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপি এই জোটের অংশীদার, যা পরবর্তী সময়ে ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। বিএনপির নেতৃত্বে শরিক হিসেবে আমরা আমাদের সাধ্যমতো অবদান রাখায় সচেষ্ট ছিলাম। নিজেদের মতবিরোধ ও মতপার্থক্য থাকলেও জোটের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সকল সময়ই ছিলাম আন্তরিক। এমনকি ২০১৪ সালের নির্বাচনে নানা ধরনের লোভনীয় প্রস্তাব থাকার পরও জোটের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো কেউ তৎকালীন ১৮ দলীয় জোট ত্যাগ করেনি। এই ত্যাগকে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি কোনো রকম মূল্যায়ন করেছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়নি। বরং তাদের ভাবখানা এ রকম—‘তারা যাবে কোথায়?’ গত সোমবার ২০ দলীয় জোটের বৈঠকেও বিএনপির উপস্থিত নেতারা বলেছেন, তাঁদের ওপর আজকে যে ঝড় কিংবা রাজনৈতিক চাপ তা শুধু ২০ দলীয় জোটের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। এই জোট না থাকলে তাঁরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হতো না।”

জেবেল রহমান বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমাদের কারণে কেউ চাপে থাকুক সেটা আমরা প্রত্যাশা করি না। বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, এই দলগুলো তাদের পাশে ছিল বলেই তারা তাদের অনেক ব্যর্থতার কিছু ভাগ দিতে পারে। না থাকলে তাও পারত না। ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপির জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত থাকলে আমরা তা পর্যবেক্ষণ করছিলাম। গত ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যের নামে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামক একটি জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে আত্মপ্রকাশ করতে গিয়ে বিএনপি ও তার বন্ধুরা যেসব ঘটনার অবতারণা করেছে তা সত্যিই দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক।’

জেবেল রহমান আরো বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের ক্ষেত্রে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের নায়কদের আচরণ সমগ্র জাতির সঙ্গে আমাদেরও হতাশ করেছে। সাবেক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এ ধরনের আচরণ রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব বা বিএনপির নেতৃস্থানীয় প্রবীণ নেতাদের কাছে জাতি বা কোনো রাজনৈতিক কর্মী এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন করে পথ চলতে চাই। প্রকৃত দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্য চাই। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানাই চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপনি অবিলম্বে সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করুন।’

পরে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন জেবেল রহমান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘লোভে বা চাপে পড়ে ২০ দলীয় জোট ছিন্ন করছি না।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারি দল আমাদের কোনো অফার দেয়নি। ২০ দলীয় জোট বিলুপ্ত হলো কি না তাও বলতে পারছি না।’

অলির ২০ দলে থাকা না থাকা নিয়ে গুঞ্জন: নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা যায়, ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল এলডিপি প্রেসিডেন্ট অলি আহমদ সম্প্রতি ঘোষিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নিয়েও বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। আবার নানা বিষয়ে সরকারেরও সমালোচনা করছেন। জোটের প্রধান দল বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে গেলেও সেখানে অলি আহমদকে দেখা যায়নি। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জোটের প্রধান ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই জোটের সভাগুলোতে দেখা যাচ্ছে না অলি আহমদকে। তবে তাঁর পরিবর্তে ওই সভাগুলোতে মহাসচিব অথবা যুগ্ম মহাসচিবরা যাচ্ছেন।

এলডিপি নেতারা জানান, তাঁদের রাজনৈতিক কোনো অবস্থান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। সময়ই বলে দেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি। তবে জোট ছাড়া হবে বিষয়টি নিশ্চিত নয়। আপাতত বর্তমান জোটেই তাঁরা রয়েছেন।

জানা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের আগেও চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্যকে নিয়ে আলোচনার কমতি ছিল না। তখন বলা হয়েছিল, ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তৎকালীন সরকার থেকে অলি আহমদকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় থাকার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। কিন্তু অলি আহমদ সরকারের এসব প্রস্তাবে রাজি হননি।

বর্তমানে ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে এলডিপির আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে যাওয়ার গুঞ্জন সম্পর্কে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম সোমবার বলেন, ‘আওয়ামী জোটে যাওয়ার বিষয়টি শতভাগ ভিত্তিহীন। রাজনৈতিক কোনো অবস্থান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।’

সম্প্রতি অলি আহমদ জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ায় বিকল্পধারাকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টার বিষয়ে যে কঠোর মন্তব্য করেন সে সম্পর্কে শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। বিকল্পধারা ও বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে উদ্দেশ করে আমাদের দলীয়প্রধান ওই মন্তব্য করেছিলেন।’ তিনি (অলি) কী এখন প্রধান দুই জোটে পা রাখছেন কি না এই প্রশ্নে সেলিম বলেন, ‘আমরা ২০ দলীয় জোটে আছি। আসলে নির্বাচন আসন্ন। তাই গুঞ্জন, প্রলোভন, আমন্ত্রণ থাকে, থাকবে। তবে নির্বাচন যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে আমরা কিংবা ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে যাব কি না তা এখনো বলতে পারছি না।’

২০ দলীয় জোটের সভাগুলোতে এলডিপি প্রধানকে দেখা যাচ্ছে না কেন—এই প্রশ্নের উত্তরে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, আসলে আগে তিনি সব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন। ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানোর পর ২০ দলের সভাগুলোতে তিনি যাচ্ছেন না। উনার প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের মহাসচিব অথবা আমি যাচ্ছি।’

চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলা এলডিপি সাধারণ সম্পাদক আখতার আলম প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমাদের দলের সভাপতি কেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে যাবে? এই জোটে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমরা ২০ দলীয় জোটেই আছি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তো সরকারের অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। ওই সময় তিনি সরকারের প্রস্তাবে রাজি হননি। এখন তো সরকারের পায়ে মাটি নেই। বর্তমান সরকার বেকায়দায় আছে।’

প্রসঙ্গত, নবম সংসদে এলডিপি এককভাবে ৪২টি আসনে নির্বাচন করেছিল। দলীয়প্রধান অলি আহমদ নিজ নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রামের চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম-১৪) থেকে নির্বাচিত হন। এ ছাড়া আর কোনো আসন পায়নি এলডিপি। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন নির্বাচনের জন্য দলটির শতাধিক আসনে প্রার্থী ঠিক রয়েছে। এসব আসনে এককভাবে নির্বাচন করার জন্যও প্রস্তুতি রয়েছে। জোটের কাছে অর্ধশতাধিক আসন চাইতে পারে দলটি। তবে নির্বাচন এককভাবে নাকি জোটগতভাবে হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

রাজনীতির মাঠে আলোচনায় থাকা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে গত সোমবার ঢাকায় অবস্থান করা অলি আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোনে এ নিয়ে আলাপ করতে রাজি হননি।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর অলি আহমদ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ আসন থেকে ছয়বার নির্বাচিত হন। এর মধ্যে পাঁচবার বিএনপি থেকে এবং ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে নিজ দল এলডিপি থেকে নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে নির্বাচনে তিনি এমপি হলেও ওই আমলে মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। একপর্যায়ে তিনি ২০০৬ সালে বিএনপি থেকে বেরিয়ে নতুন এ রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এর আগে বিএনপিতে থাকাকালে তিনি সব শেষ দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা জানান, রাজনীতির মাঠে এখন আলোচনা চলছে অলি আহমদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের হয়ে চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) এবং চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া আংশিক) এই দুটি আসনে নির্বাচন করতে পারেন। এ ছাড়া দলের মহাসচিবসহ আরো কয়েকজনের জন্য আওয়ামী জোট আসন ছেড়ে দিতে পারে। তবে সরকারের পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটেও আসন নিয়ে দেনদরবার চলছে বলে জানান কয়েকজন নেতা।