জাতীয়

দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি বদলে যাচ্ছে পদ্মা সেতু ঘিরে

By daily satkhira

October 19, 2018

অনলাইন ডেস্ক: পদ্মা সেতু আর পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে দক্ষিণাঞ্চল হবে ‘সিঙ্গাপুর’। অর্থাৎ সিঙ্গাপুরের মতো সক্ষম হবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি। কয়েক বছর আগে বরিশালে একটি অনুষ্ঠানে আশাজাগানিয়া এই উক্তিটি সর্বপ্রথম করেছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। ৮ অক্টোবর গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দক্ষিণাঞ্চল এখন আর অবহেলিত নেই।’ সরকারপ্রধানসহ একাধিক মন্ত্রী, এমপি, নেতাসহ সরকারের অনেক কর্মকর্তার মুখে ঘুরেফিরেই উচ্চারিত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের ‘সিঙ্গাপুর’ বনে যাওয়ার গল্প। সঙ্গে রয়েছে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করার বিরল সুযোগের পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। রেললাইন আসছে কুয়াকাটা-পায়রা পর্যন্ত। ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ভূমি উন্নয়ন প্রকল্প ১১ অক্টোবর একনেকের সভায় অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরও রয়েছে বিস্তৃত নৌপথ। এমন সম্ভাবনার দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক হারে গড়ে উঠবে দেশি-বিদেশি শিল্প-কলকারখানা। পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হবে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, হবে ব্যবসায়িক জোন। এমন ভাবনায় আগে থেকেই দক্ষিণাঞ্চলমুখী হয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। নতুন করে অনেকে আসছেন স্বপ্নের ‘সিঙ্গাপুরের’ উদ্যোক্তা হতে। কেউ পছন্দের জমি পাচ্ছেন, কেউ এখনো খুঁজছেন। তবে আশা ছাড়ছেন না। কীভাবে গড়ে উঠবে স্বপ্নের ‘সিঙ্গাপুর’, কবে হবে দৃশ্যমান, এর ভিতরের রহস্যটাই কী—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. তারিকুল হক বলেন, সিঙ্গাপুর এক দিনে এমন হয়নি। একসময় মালয়েশিয়া তাদের বের করে দিয়েছে। তাদের নেতা লি কুয়ানের অদম্য প্রচেষ্টায় সিঙ্গাপুর আজ এ অবস্থায়। মাত্র ৭৩০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সিঙ্গাপুর এখন সারা বিশ্বে উজ্জ্বল। তিনি বলেন, পায়রা বন্দর, পদ্মা সেতু হচ্ছে, লেবুখালীতে হচ্ছে সেতু এবং সেনানিবাস, কলাপাড়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে, ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা-পায়রা ফোর লেন ও রেললাইন প্রক্রিয়াধীন। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পায়রা বন্দর হবে অন্যতম। এখানে জমির মূল্য কম। রয়েছে সস্তা শ্রম। ২০২১ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর কানেকশন হয়ে গেলে এর পরই শুরু হবে ইন্ডাস্ট্রি। সময়ের প্রয়োজনে দ্রুত চোখে পড়বে আমূল পরিবর্তন। সব দিকের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে গ্রেটার বরিশাল দ্রুততম সময়ের মধ্যে ট্যুরিস্ট হাব, কমার্শিয়াল হাব এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাবে পরিণত হবে বলে মনে করেন জাইকার একটি প্রকল্পের পরামর্শক প্রকৌশলী তারিকুল হক। প্রকৌশলী তারিকুল হক আরও বলেন, মিল-ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠতে প্রথমেই ট্রান্সপোর্টেশন (পরিবহন) প্রয়োজন। সবচেয়ে সহজ এবং সাশ্রয়ী হচ্ছে নৌ, রেল ও সড়কপথ। আকাশপথ এক্সপেনসিভ হলেও বরিশালে সব ধরনের যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকায় ঢাকা থেকে বরিশাল এবং পায়রা বন্দর পর্যন্ত মহাসড়কের পাশে কোনো আনসোল্ড জমি নেই। তার মতে, গুরুত্ব বুঝে উদ্যোক্তারা দক্ষিণাঞ্চলে জমি কেনায় ইতিমধ্যে বিপুল বিনিয়োগ করেছেন। এখন অপেক্ষা অবকাঠামোর। সরকারি ব্রজমোহন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, এখনো দক্ষিণের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। কৃষি-অর্থনীতির উন্নয়নে কৃষির বৈচিত্র্যকরণ, আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির প্রয়োগ, নদীভাঙন রোধ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, লবণপানির প্রভাব মোকাবিলা, স্বল্প সুদে কৃষিঋণ এবং বাজারজাতকরণের জন্য প্রচুর অবকাঠামো নির্মাণ জরুরি। কৃষি ছাড়াও দক্ষিণে এখন শিল্পায়নের বিশাল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ আক্তারুজ্জামান। তার মতে, পূর্বে ভোলার গ্যাস, পশ্চিমে মোংলা বন্দর, উত্তরে পদ্মা সেতু আর দক্ষিণে পায়রা বন্দর-কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত—এই পাঁচের সম্মিলনে মাত্র কয়েক বছরেই জেগে উঠছে ‘দক্ষিণাঞ্চল’। দক্ষিণে সস্তা শ্রম, অবরিত জমি, কম খরচে নৌপরিবহনসহ সড়কপথেও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ব্যাপক শিল্পের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। অপসোনিনসহ অনেকেই ইতিমধ্যে শিল্প সম্প্রসারণ করেছে। উদ্যোগী হয়েছেন অনেকে। শিল্প করার জন্য সম্প্রতি পায়রা সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি জমি দেখতে গিয়েছিলেন বিএনপির সিনিয়র এক নেতা। বরিশালের সন্তান ওই নেতাসহ তার এক বন্ধুর একসঙ্গে শিল্প করার পরিকল্পনা রয়েছে সেখানে। বিরোধিতার স্বার্থে কার্পণ্য না করে ওই নেতা বলেন, পায়রা সমুদ্রবন্দর হবে ‘ভায়াব্ল’। এখান দিয়ে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট দ্রুত হবে। ঢাকার সঙ্গে সহজ হবে নৌ, সড়ক, রেল ও আকাশপথের যোগাযোগ। তাই বন্দরের কাছাকাছি শিল্পের জন্য জমি চাই তাদের। যারা সারাক্ষণ সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত, তারাও এক বাক্যে স্বীকার করছেন বরিশালের বদলে যাওয়ার গল্প।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর পরিচালক, বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. সাইদুর রহমান রিন্টুর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল সিঙ্গাপুর বনে যাওয়া সম্পর্কে। তিনি বলেন, পায়রা বন্দরের কাজ চলছে। পদ্মা সেতুর চলমান। ফোর লেন অনুমোদন দিয়েছে সরকার। পায়রা-কুয়াকাটা পর্যন্ত সব সেতু হয়ে গেছে (লেবুখালীর কাজ চলমান)। নৌ যোগাযোগের উত্তম ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর ভোলার গ্যাস আসছে। কলাপাড়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে। লেবুখালীতে হচ্ছে সেনানিবাস। পদ্মার এপার হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বরিশালের চরমেঘায় হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কুয়াকাটা ও বরিশালে সরকারি উদ্যোগে হচ্ছে দুটি ফাইভস্টার হোটেল। চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বরিশালে ব্যাপক হারে গড়ে উঠবে শিল্প-কলকারখানা। কর্মসংস্থান হবে লাখ লাখ মানুষের। সবকিছু মিলিয়ে শিল্প, ব্যবসা আর পর্যটনের ওপর ভিত্তি করে ‘সিঙ্গাপুরে’ পরিণত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল—এমনটাই মনে করছেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা, শিল্পোদ্যোক্তা ও জনপ্রতিনিধি রিন্টু।

শুধু শিল্প আর ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, পায়রার অদূরেই রয়েছে ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। সেখানে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়। রয়েছে দেশের বৃহত্তম প্রাচীন বৌদ্ধমন্দির, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন।

কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব শরীফ বলেন, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় উপভোগ করা যায় পৃথিবীর মাত্র দুটি স্থানে। এর একটি হলো কুয়াকাটা আর অন্যটি জাপান। কুয়াকাটা থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত সাইট ট্যুরও এখন সময়ের ব্যাপার। কুয়াকাটা মাস্টারপ্ল্যানে রয়েছে জাতীয় ক্রিকেট ভেন্যু, দুটি স্টল এয়ারপোর্ট, মেরিন ড্রাইভসহ অনেক কিছু। এত সম্ভাবনার কুয়াকাটায় হচ্ছে ট্যুরিস্ট হাব। তবে ভাঙন থেকে কুয়াকাটা রক্ষায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে বেড়িবাঁধ ও মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ জরুরি বলে তিনি মনে করেন।

দক্ষিণের বদলে যাওয়ার রহস্য জানতে চাইলে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। খুলনা আর চট্টগ্রাম অঞ্চলে দুটি বন্দরে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে। অর্থনীতিতে ওই দুই অঞ্চল অনেক সমৃদ্ধ। এই দুই বিভাগের মাঝে বরিশালের (ছয় জেলা) সঙ্গে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, বাগেরহাট এত দিন ছিল পিছিয়ে। এ অঞ্চলের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর, ফোর লেন, রেললাইন, লেবুখালীতে সেতু ও সেনানিবাস, কলাপাড়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, হিজলায় পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পদ্মার এপারে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করছেন। পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের উন্নয়নে এতগুলো মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েই প্রধানমন্ত্রী তার দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এটাই বদলে যাওয়ার ভিতরের ‘রহস্য’ বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট দুলাল। আগামী কয়েক বছরে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছলে দক্ষিণাঞ্চলে ‘সিঙ্গাপুরের’ চেহারাই ফুটে উঠবে এমন স্বপ্ন দেখেন তিনি।

এক অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১০ সালে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১.৫ শতাংশ। অথচ ওই বছর বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৯.৪ শতাংশ। ২০১৬ সালে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৪ ভাগ এবং বরিশালের দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬.৫ ভাগ। অর্থাৎ পিছিয়ে থাকলেও বরিশালে দ্রুত কমছে দারিদ্র্যের হার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বরিশালে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র বেড়ে যাওয়ায় দ্রুত কমছে দারিদ্র্যের হার। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে ১০ বছরের মধ্যে বরিশাল বিভাগের দারিদ্র্যের হার ১৫-১৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে ধারণা।

অর্থনীতির শিক্ষক মো. আক্তারুজ্জামানের মতে, ‘সিঙ্গাপুর হচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আমতলী উপজেলার চেয়েও আয়তনে ছোট। এত ছোট একটা দেশ সমুদ্রবন্দর, পর্যটন আর মেডিকেল সার্ভিসের ওপর ভর করে ধনী রাষ্ট্র হতে পারলে আমরা (দক্ষিণাঞ্চল) কেন পারব না?’