অনলাইন ডেস্ক: ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় সারা দেশে বড়জোর চার-পাঁচজন কোটিপতি ছিলেন। সে সময় সচ্ছল ধনী বলতে লাখপতিদের বোঝানো হতো। আমি একটি মফস্বল শহরে শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছি। জেলা সদরের শহর হলেও এই জনপদে বিত্তবৈভবের কোনো ছাপ ছিল না। নোয়াখালীর মূল শহরটি মেঘনার ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হওয়ার কারণে মাইজদীতে জেলার সদর দপ্তর অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হয়েছিল। অস্থায়ী শহরে কেউ পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণ করেনি। টিন ও বাঁশের ঘরেই বসবাস করত শহরের গণ্যমান্য পরিবার। সরকারি অফিসগুলোর মধ্যে একমাত্র ট্রেজারি ভবন ছাড়া বাকি সব ছিল বাঁশ অথবা টিনের চালাবিশিষ্ট। কিছু ভবনের দেয়াল ছিল পাকা, কিছু ছিল আধাপাকা, বেশির ভাগের দেয়াল ছিল টিনের অথবা বাঁশের। বেসরকারি স্থাপনার মধ্যে একমাত্র উল্লেখযোগ্য পাকা ভবন ছিল জামে মসজিদ। বিশাল আকারের না হলেও ভবনটি যে চোখে পড়ার মতো ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ছোটখাটো আকারের আরো দু-একটি মসজিদও পাকা ভবনে অবস্থিত ছিল।
শহরে বিদ্যুৎ ছিল না। একটিমাত্র পাকা রাস্তা ছিল, যার সঙ্গে যুক্ত ছিল দু-একটি শাখা রাস্তা। সেগুলো ছিল সরু, তবে পাকা। জেলা প্রশাসক, এসপি, এডিসি, এসডিও, অ্যাডিশনাল এসপি এবং কয়েকটি বিভাগের প্রধান কর্মকর্তার সরকারি জিপগাড়ি ছিল। তবে কারো ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল না। ম্যাজিস্ট্রেট, মুনসেফ ও বিচারক, জিলা স্কুলের হেডমাস্টারসহ অনেক পদস্থ কর্মকর্তা রিকশায় চলাফেরা করতেন। বেসরকারি নাগরিকদের মধ্যে সচ্ছলতার বিচারে নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে যাঁদের টেনেটুনে মধ্যবিত্তের সারিতে ওঠানো যায়, তাঁরা হলেন হাতে গোনা কয়েকজন উকিল, মোক্তার—এককথায় আইনজীবী, সরকারি অফিসের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নন-গেজেটেড কর্মচারী, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ী দোকানদার। তাঁদের কারো কারো সচ্ছলতার পেছনে রয়েছে চর এলাকায় জমির মালিকানা; এর বেশির ভাগ হচ্ছে জেলা প্রশাসনের আনুকূল্যে পাওয়া খাসজমি। নিজ জেলা ও বছরে দু-একবার ঢাকা শহরে যাওয়ার মধ্যে তাঁদের চলাচল সীমিত। একটি আইনজীবী পরিবারের দুজন সদস্য ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য এবং একজন পর্যটক হিসেবে বিলেত গিয়েছিলেন। শহরে আর কোনো বিদেশফেরত লোককে আমি দেখিনি। হজে যাওয়া লোকজনের নাম-পরিচয় শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। শহরতলির এক গ্রাম থেকে আমার এক আত্মীয় হজে গিয়েছিলেন। হজ থেকে ফিরে আসার পর মায়ের সঙ্গে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম।
শহরে টাকার ছড়াছড়ি দেখিনি। প্রাদেশিক পরিষদ কিংবা জাতীয় সংসদের নির্বাচনে প্রার্থীদের মোটরগাড়িতে চলাচল করতে দেখিনি। সাইকেল ও রিকশায় তাঁদের চলাফেরা করতে দেখেছি। আমাদের বাসার সঙ্গেই (একই সীমানাপ্রাচীর) জাতীয় সংসদের একজন গণ্যমান্য সদস্য বাস করতেন। তিনি বিভিন্ন সময় পিপি, জিপি, এমনকি জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান/ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনিও রিকশায় চলাফেরা করতেন। সহজ-সরল ও সাধারণভাবে জীবন যাপন করতেন। বাড়িতে ঘটা করে কোনো অনুষ্ঠান করতেন না। সম্পদ বা আয়ের চাকচিক্যময় প্রকাশ ঘটাতেন না। শহরের কারো মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা ছিল না। চলাফেরার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী-ঠিকাদারদের দুটি বৈশিষ্ট্য তাঁদের সচ্ছলতার ইঙ্গিত বহন করত—(১) তাঁরা এক গরুতে কোরবানি দেন (শেয়ারে নয়) এবং (২) না মুলিয়ে (দরদাম না করে) রিকশায় ওঠেন। দৃষ্টিকটুভাবে কেউ টাকার গরম দেখাতেন না। অত টাকা বোধ হয় তাঁদের ছিল না।
ষাটের একেবারে প্রথম দিকে ঢাকায় আসি এবং কলেজের পড়া শেষ করে ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হই। এ সময় শহরের কিছু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে জানাশোনা হয়। এ ছাড়া উচ্চ আয়ের বিত্তবান ব্যক্তিদের গল্প-কাহিনি বন্ধুবান্ধব ও সিনিয়র ছাত্রদের কাছে শুনতে পাই। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ববঙ্গের অভিজাত হিন্দু পরিবারগুলোর প্রায় সবাই ভারতে চলে যায়। হাতে গোনা কয়েকটি মুসলিম সামন্ত পরিবার; যেমন—ঢাকা, বগুড়া, ধনবাড়ী, দৌলতগঞ্জের নবাব পরিবার এই প্রদেশে বসবাস করছিল। তারা বিপুল সম্পত্তির মালিক ছিল। তবে তাদের হাতে রক্ষিত নগদ অর্থের পরিমাণ কত ছিল, তা সঠিকভাবে বলা যায় না। পঞ্চাশের দশকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কমে যায়। আয়-উপার্জনেও ভাটার টান পড়ে। ষাটের দশকেও তাদের সচ্ছল বিত্তশালী হিসেবে গণ্য করা যেত। তবে তাদের জীবনাচারে অর্থের ঝলকানি চোখে পড়ার মতো ছিল না। আমাদের সতীর্থদের মধ্যে নবাব পরিবারের ছেলে খাজা শামসুদ্দিনের একটি ছোট অস্টিন গাড়ি ছিল, সেই গাড়িতে আমরা ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেতাম। আর গাড়ি ছিল শেরেবাংলার ছেলে ফয়জুল হক বাবুর এবং সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের ছেলে ওবায়দুর রহমানের। সতীর্থ ছাত্রীদের মধ্যে নিয়মিত গাড়িতে আসত মাত্র দু-তিনজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে বিদেশফেরত কয়েকজন অধ্যাপকের গাড়ি ছিল। তাঁদের অনেকেই ছিলেন হলের প্রভোস্ট।
ষাটের দশকের ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে যাঁদের নাম শুনেছি তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বড় কন্ট্রাক্টর জহুরুল ইসলাম ও চা-বাগানের মালিক সাইদুল হাসান। শিল্পপতিদের মধ্যে প্রখ্যাত ছিলেন এ কে খান, পূর্ব পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী সদরে ইস্পাহানি ও কালীগঞ্জের হাজি গুল বক্স। বাকি শিল্পপতি; যেমন—আদমজি, দাউদ, বাওয়ানি, তাঁরা সবাই আবাঙালি। বাঙালি শিল্পপতি; যেমন—মকবুলুর রহমান, আফিলউদ্দিন, আগা ইউসুফ সচ্ছলতার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করেছেন, তবে ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হননি। সে বিবেচনায় স্বাধীনতা লগ্নে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা আধা ডজনের বেশি হবে বলে মনে হয় না। এক হিসাবে দেখা গেছে যে ১৯৭২ সালে ব্যাংকে কোটি টাকার আমানতধারীর সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ। এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৭৫ সালে ৪৭ এবং ১৯৮০ সালে মাত্র ৯৮। শুধু পাঠকের কৌতূহল নিবারণের জন্য জানাচ্ছি যে বর্তমানে এ সংখ্যা ৭০ হাজার ৪৬৩। কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা বৃদ্ধি নিশ্চয়ই অবাক করার মতো।
এ তো গেল শুধু ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখা অর্থের হিসাব। আয় ও সম্পদের পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বিশাল। বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের অবস্থার বিশেষ উন্নতি না হলেও উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের ধনসম্পদ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাংলাদেশে তাদের আছে সোনার খনি। তারা দেখতে পায় এখানে বাতাসে টাকা উড়ছে। একটু বৈষয়িক বুদ্ধি থাকলে, নৈতিকতাবোধ একটু কমিয়ে নিলে, সর্বোপরি ক্ষমতাধরদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে বাতাসে ভেসে বেড়ানো টাকা ধরে নেওয়া এবং ঠিক জায়গায় তা সরিয়ে ফেলা কঠিন কাজ নয়। এ দেশে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ শিথিল, জবাবদিহির বালাই নেই বললেই চলে। দল পাকিয়ে বাজার ক্ষমতা সহজে কবজা করা যায়। নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ উল্টো নিয়ন্ত্রিত হতে পছন্দ করে। এমন অবস্থায় ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বাগিয়ে নিয়ে মহাসুখে টাকা বানানো যায়।
শিল্প-ব্যবসা, আর্থিক খাতের কোন এলাকা থেকে এবং কোন সময় টাকা আসা শুরু করল তা খতিয়ে দেখা প্রাসঙ্গিক হবে। পঞ্চাশের দশক থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছিল। উৎপাদন কাঠামো, উৎপাদনপ্রক্রিয়া এবং অর্থনৈতিক পণ্য তথা ভোগ্যপণ্যের দাম মোটামুটি অপরিবর্তিত ছিল। শ্রমিকের মজুরি, জোতদার-গৃহস্থের নগদ আয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কিংবা ব্যবসায়ীদের আয়ের পরিমাণ লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়নি। এ ধরনের থিতু অবস্থা ভোক্তাসাধারণের জন্য স্বস্তিদায়ক হলেও তা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখে না। দেশের উৎপাদন, আয়-উন্নতি, সম্পদ বাড়াতে হলে নতুন প্রক্রিয়া-পদ্ধতি, নতুন প্রযুক্তি, নব-উদ্যোগ এবং নতুন কর্মধারা নিয়ে এগোতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন হয় মনোজগতে একটা বিরাট আলোড়ন, যা গতানুগতিক জীবনধারাকে বড় রকমের ধাক্কা দিয়ে মানুষকে স্থবিরতা ঝেড়ে ফেলতে বাধ্য করে, বাঁচার প্রয়োজনে মানুষ নতুন নতুন পথ খুঁজে নিতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালায়। ইতিহাস বলে অবশেষে তারা সফল হয়।
১৯৭৩-৭৪-এর মন্বন্তর বাংলাদেশিদের মনোজগতে তেমনি একটি ধাক্কা দিয়েছিল। নানা প্রকার আন্তর্জাতিক উপধায়কের জটিল সমীকরণে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বৃৃদ্ধি পেয়ে সাধারণ মানুষ তথা নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। দ্রব্যমূল্যের চাপে বিত্তহীনরা সরাসরি পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাতে শুরু করে, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। উচ্চমধ্যবিত্তরাও মূল্যস্ফীতির আঁচ অনুভব করে। নগণ্যসংখ্যক উচ্চবিত্ত, যারা কোনোভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভাগীদার হতে পেরেছিল অথবা উত্তরাধিকার সূত্রে বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছিল, শুধু তাদের গায়ে দ্রব্যমূল্যের আঁচ লাগেনি। তবে সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ যন্ত্রণা এত দৃশ্যমান ছিল যে তারাও পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুভব করতে পেরেছিল। এ সময় সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও বুঝতে পারল যে এভাবে চললে বাঁচা যাবে না। নতুন কিছু করতে হবে। নতুন পথে চলতে হবে।
প্রযুক্তির সন্ধান ও প্রয়োগে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করে এগিয়ে গেল। দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো তাদের সাহায্য করল। তারা আগ্রহী কৃষকদের উন্নত বীজ, সার, কৃষি যন্ত্রপাতি ও বালাইনাশক সরবরাহ করল। চাষাবাদের উন্নত পদ্ধতি শিখিয়ে দিল। নতুন ফসল উৎপাদন শেখাল। কৃষি উৎপাদনে এর ইতিবাচক ফল দৃশ্যমান হলো। এক সফলতার হাত ধরে অন্য সফলতা কৃষকের দ্বারে হাজির হলো। কৃষিতে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হতে শুরু করল। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র উৎপাদন, মেরামতকরণ ও সংস্কার সাধনে মেকানিক, টেকনিশিয়ান ও স্বল্প শিক্ষিত দেশীয় উদ্ভাবকরা সম্ভাবনাময় নতুন পথের সন্ধানে এগিয়ে চলল। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা ও পরিকল্পিত প্রণোদনা সীমিত ছিল। তবে সরকার কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি।
স্বাধীনতার পরপরই সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি নিবেদিত থেকে সরকার রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছিল। পরবর্তীকালে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রয়োজনে সরকার ব্যক্তি খাতের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসারিত করতে থাকে। স্বাধীনতার সুফল হিসেবে সরকার বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংযোগের সুযোগ লাভ করে। সরকার এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এসব দেশ এবং সংস্থার কাছ থেকে ঋণ, অনুদান, প্রকল্প ও কারিগরি সহযোগিতা বাবদ বিপুল আর্থিক সাহায্য জোগাড় করতে সক্ষম হয়। ব্যক্তি খাতের প্রতি সরকারের ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ করে পুঁজিবাদী দেশের সম্পদশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভিন্ন আঙ্গিকে এ দেশের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলার-সমৃদ্ধ দেশ এবং তাদের প্রভাবশালী গোষ্ঠী এ দেশের ধর্মাশ্রিত সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গকে উদারভাবে সাহায্য করতে শুরু করে। বিদেশি সংযোগ থেকে এই শ্রেণির ব্যক্তিরাও বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ পায়।
সত্তরের শেষ দিকে বিদেশি সংযোগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করার পথ-ঘাট আবিষ্কৃত হলেও প্রকৃতপক্ষে অর্থবহ বাস্তব কর্মকাণ্ড শুরু হয় আশির দশকে। এ সময় ব্যক্তি খাত লক্ষণীয়ভাবে প্রসারিত হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পেছনে পড়তে থাকে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা নানারূপ সুযোগ-সুবিধা লাভ করে, যার ফলে লাভের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে তাদের আর্থিক ভিত অনেক বেশি মজবুত হয়।
আশির দশকে সরকার ব্যক্তি খাতকে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করতে শুরু করল। বিশেষ করে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পকে নানা রকম প্রণোদনা দিয়ে ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন প্রাণবন্ত সেক্টরে রূপান্তর করার প্রচেষ্টা চালাল। ফলোদয় হলো। নানা পেশার তরুণ উদ্যোক্তারা এ সেক্টরে ভিড় জমাল। রপ্তানিতে কাঁচা পয়সা, আকাশচুম্বী বিশাল লাভ। অল্প সময়ের মধ্যে এ খাতের উদ্যোক্তা-শিল্পপতিরা বিত্তবান হয়ে সমাজের ধনাঢ্য গোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করল। এ দশকে ব্যাংক, বীমাসহ অনেক লাভজনক খাতকে ব্যক্তিমালিকানায় অন্তর্ভুক্ত করা হলো। এসব খাতে ঝুঁকিমুক্ত সীমাহীন লাভের সুযোগ রয়েছে। পথিকৃৎ উদ্যোক্তারা এ সুযোগ গ্রহণ করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হলো। তারা একের পর এক নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলল।
একই প্রক্রিয়া নব্বইয়ের দশকে আরো জোরদার হলো। পোশাকশিল্প, ব্যাংক, বীমার সঙ্গে যোগ হলো মানবসম্পদ রপ্তানি, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, টেলিভিশন চ্যানেল, মোবাইল ফোন কম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউিট স্থাপন। এসব সেক্টরের পথিকৃৎ উদ্যোক্তারা বিপুল অর্থ উপার্জনের সুযোগ পেল। বিশাল অর্জন কাজে লাগিয়ে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পপ্রতিষ্ঠান সম্প্রসারিত করল। শত শত, এমনকি হাজার কোটি টাকার সম্পদের জাল টেকনাফ থেকে টরন্টো পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। এরপর এলো রেন্টাল পাওয়ার, মেগা প্রজেক্ট ও সাঙাত পুঁজির (Crony Capitalism) দশক। সম্পদের পাহাড় আরো উঁচু হলো। দেশি ধনীরা আন্তর্জাতিক ধনকুবেরের সারিতে উঠে এলো। দেশে তো বটেই, বিদেশেও তাদের নাম উচ্চারিত হলো।
স্বাধীনতা বাংলাদেশি জনগণকে বিদেশের সঙ্গে সংযোগের এক অভূতপূর্ব সুযোগ উপহার দিয়েছে। স্বাধীনতা-পূর্বকালে এতদঞ্চলে সচ্ছল, শিক্ষিত, উদ্যোগী নাগরিকের চলাফেরা ও যোগাযোগ সীমিত ছিল বড়জোর করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ পর্যন্ত। স্বাধীনতার পর, বিশেষ করে চুয়াত্তরের ধাক্কায় তারা বুঝতে পারল যে ভালোভাবে বাঁচতে হলে দেশের বাইরে যে সুযোগ-সম্পদ রয়েছে তার ওপর হাত রাখতে হবে। রপ্তানি, কর্মসংস্থান ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশের সম্পদ সংগ্রহ করতে হবে। যে চিন্তা সেই কাজ; এ প্রচেষ্টায় তারা সফল হলো। ঋণ, অনুদান, রপ্তানি, কর্মসংস্থান, রেমিট্যান্স, ব্যক্তিপর্যায়ের সাহায্য সংগ্রহের মাধ্যমে লাখো কোটি টাকা দেশে এলো। এর একাংশ ব্যক্তি খাতে, ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে চলে গেল। শিথিল প্রশাসনিক ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণের কারণে রাষ্ট্রীয় তথা জনগণের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বঞ্চিত করে লোভী সুযোগসন্ধানীরা ধনকুবের হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল। সঙ্গে যুক্ত হলো সাঙাত পুঁজিবাদের (Crony Capitalism) সুরক্ষণ। এসব সুবিধা যারা পেয়েছে তারাই এখন শতকোটি টাকার মালিক। লেখক : ড. সা’দত হুসাইন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান