খুলনা

সাতক্ষীরা ও খুলনার উপকূলে নিরাপদ পানির জন্য হাহাকার

By daily satkhira

October 21, 2018

অনলাইন ডেস্ক: খুলনার কয়রা উপজেলার বাগালি ইউনিয়নের বগা গ্রামের গৃহবধূ রোমেছা বেগম। পরিবারের পানযোগ্য পানির চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন খুব সকালে তাকে বাড়ি থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হয় ইসলামপুর গ্রামের সরকারি পুকুরে। পৌঁছতে দেরি হলে আর পরিচ্ছন্ন পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের চারপাশে বাড়ে পানিপ্রত্যাশী মানুষ। সেই সঙ্গে বাড়ে পরিষ্কার পানি পাওয়ার অপেক্ষা। কোনো কোনো দিন পানি নিয়ে বাড়ি ফিরতে বিকাল গড়িয়ে যায়। বিশুদ্ধ নয়, শুধু খাবার উপযোগী একটু পানির জন্য এভাবেই প্রতিদিন রোমেছার মতো হাজারও গৃহবধূকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়।

পাইকগাছা উপজেলার ২নং কপিলমুনি ইউনিয়নের নাসির জানান, তাদের ইউনিয়নে কোনো পুকুরেই পানযোগ্য পানি পাওয়া যায় না। এমনকি মাত্রাতিরিক্ত খনিজ উপাদান থাকায় বেশিরভাগ চাপকলের পানিও পানযোগ্যতা হারিয়েছে।

এই এলাকার মানুষের পানির প্রধান উৎস কপিলমুনি বাজারে বেসরকারি উদ্যোগে বসানো গভীর নলকূপের পানি। প্রতি লিটার ৫০ পয়সার বিনিময়ে পানি কিনতে হয় তাদের। পানির সংকট এতটাই গভীর যে, চাহিদার কারণে এলাকায় গড়ে উঠেছে পানির জমজমাট ব্যবসা। এমনকি খুলনা থেকেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জার ভর্তি পানি ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে সরবরাহ করছে এখানে। তবে যাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই এসব ব্যবস্থার কোনোটিই তাদের কাজে আসে না।

জানা গেছে, খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকায় পানযোগ্য পানি দুষ্পাপ্য। এসব উপজেলার বেশিরভাগ ইউনিয়নেই গভীর নলকূপ কার্যকর নয়। এখানে বসবাসরত মানুষ বর্ষা মৌসুমে মূলত বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে বছরের ২-৩ মাস পান করে। শুষ্ক মৌসুমে সীমিতসংখ্যক পুকুরই তখন হয়ে ওঠে সুপেয় পানির প্রধান উৎস। এসব সংরক্ষিত পুকুরের সংখ্যা এতই সীমিত যে, গ্রামবাসী ৪-৫ ঘণ্টা ব্যয় করে পানি সংগ্রহ করতে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে পুকুরের পানিও শুকিয়ে যায়। অবস্থাপন্নরা তখন উচ্চমূল্যে পানি সংগ্রহ করতে পারলেও দরিদ্রদের মধ্যে পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়।

সংশ্লিষ্টদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে। ফলে লবণাক্ততা বেড়ে নষ্ট হচ্ছে মিষ্টি পানির আধার। যে কারণে উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। আর ভূগর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত উত্তোলনে এ সংকট আরও প্রকট হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে বিশ্বে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পানির চাহিদা। উন্নত জীবনযাপনের প্রয়োজনেও মানুষের দৈনিক মাথাপিছু পানির চাহিদা বেড়ে চলেছে।

কিন্তু নানামুখী অপচয়ের কারণে অনেক স্থানে সুপেয় পানির উৎস সংকুচিত, দূষিত ও ধ্বংস হচ্ছে। এসব কারণে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এ সংকট সর্বাধিক। ওই এলাকায় গড় হিসাবে ২৫২ জনের জন্য একটি নলকূপ থাকলেও অনেক উপজেলায় নলকূপের অস্তিত্ব নেই। সেখানে পানির জন্য পুকুর বা অন্য জলাশয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়।

ওই সব এলাকায় সিডর-আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক জলাশয় নষ্ট হয়েছে। ফলে সুপেয় পানির সংকটও বেড়েছে।

ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই এমন ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধার বাইরে। যার বেশির ভাগই বাস করে উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলে। বিভিন্ন সংস্থার একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আইলাদুর্গত এলাকার ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বর্তমানে পানযোগ্য পানিবঞ্চিত। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং খুলনা জেলার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার ১৯ ইউনিয়নে বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট। মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ মানুষ নলকূপের মাধ্যমে পানি পাচ্ছে। অন্যদের পানি সংগ্রহের জন্য গড়ে দুই থেকে ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত পাড়ি দিতে হচ্ছে। এখনও ৭৮ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে না। আর মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ পুকুর লোনাপানি মুক্ত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকটের অন্যতম সুপেয় পানি। উপকূলীয় এলাকায় এ সংকট সর্বাধিক। সেখানে সুপেয় পানির আধার কম। তার ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেই আধারগুলো নষ্ট হচ্ছে। ফলে সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে সিডর, আইলা, নার্গিস, বিজলীসহ পাঁচটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। এতে মিষ্টি পানির আধার নষ্ট হয়ে নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। ফলে উপকূলের মানুষকে খাবার পানির জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সংকট মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বায়ো সেন্ড ফিল্টার, পিএসএফ (পুকুরপাড়ে বালির ফিল্টার) ও রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং প্লান্ট এবং জলাধার সংস্কার প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও সেটি যথেষ্ট নয়।

এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কারণে উপকূলীয় ও হাওর এলাকায় টেকসই ওয়াশ কার্যক্রম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশেষত উপকূলীয় এলাকায় পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা, আর্সেনিকের উপস্থিতি, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া, পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকায় পানির তীব্র সংকট এবং ব্যয়সাশ্রয়ী প্রযুক্তির উপকরণের অভাবে ওয়াশ কার্যক্রম বাস্তবায়ন দুরূহ ব্যাপার। তাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-৬) অর্জনে নিরাপদ পানি, উন্নত স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি (ওয়াশ) নিশ্চিত করতে জনসচেতনতার পাশাপাশি সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞগণের।

বুধবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত ‘টেকসই ওয়াশ কার্যক্রম: তৃণমূলের অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যৎ দিক-নির্দেশনা’ শীর্ষক কর্মশালায় বক্তারা এ আহ্বান জানান। এতে প্যানেল আলোচক ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি পিটার ডি ভ্রিস, ওয়াটার এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. খায়রুল ইসলাম, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ গোলাম মুকতাদির, এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথের নির্বাহী পরিচালক এসএমএ রশীদ, ইউনিসেফ বাংলাদেশের ওয়াশ স্পেশালিস্ট মোহাম্মদ শফিকুল আলম এবং ব্র্যাকের কমিউনিকেবল ডিজিজ ও ওয়াশ কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. আকরামুল ইসলাম।

কর্মশালায় তারা যেসব বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনে টেকসই ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকায় পানির অভাব দূরীকরণে বিশেষ ব্যবস্থা, প্রত্যন্ত এলাকায় উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া। এসডিজি-৬ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের অংশীদারিত্ব ও সমন্বয় বাড়ানো, সরকারের কর্মসূচির সঙ্গে স্থানীয় সুধীজনকে অন্তর্ভুক্ত করে জনসচেতনতা তৈরি, স্যানিটেশন সুবিধা বাড়াতে বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোক্তা সৃষ্টি, স্বাস্থ্যবিধি ও পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারের আরও অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি, দেশের বিভিন্ন স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ওয়াশ কর্মসূচি জোরদার করা ইত্যাদি।