অনলাইন ডেস্ক : টেলিভিশনের টক শোতে লেখিকা মাসুদা ভাট্টিকে অশালীন আক্রমণের দায়ে দায়েরকৃত এক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মইনুল হোসেনকে। এদিকে মাসুদা ভাট্টির তীব্র সমালোচনা করে সোশ্যাল সাইটে দুদিন আগে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন প্রখ্যাত নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন। মাসুদা ভাট্টি এরপর নিজের জবাব দিয়েছেন। আজ সোমবার সন্ধ্যায় আবারও একই ইস্যুতে ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাস লিখেছেন তসলিমা।
পাঠকদের জন্য নির্বাসিত এই লেখিকার স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো : ‘মাসুদা ভাট্টি যে এত শক্তিধর জানতাম না। কেউ তাকে একটা গালি দিল, বাহ ২০ কোটি টাকার মামলা ঠুকে দিল তার বিরুদ্ধে। আর সেই লোক, শুনেছি বিরাট কিছু, গ্রেপ্তার হয়ে গেল, তাকে এখন জেলের ভাত খেতে হচ্ছে। আমার মাথার মূল্য যে লোক ঘোষণা করেছে, যে আমাকে খুন করবে ঘোষণা করেছে, তার বিরুদ্ধে যদি আমি মামলা করতে যাই, পারবো? আমার কিছু বই বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছে, বই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে এবং বাক স্বাধীনতার পক্ষে যদি সামান্য মামলাও করতে যাই , পারবো?’
‘পারবো না। কারণ আমাকে দেশে ঢুকতে দেওয়া হয় না। আমি কোনো উকিলকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে পারি। তাই না? কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কিছুতেই চায় না আমি কাউকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিই। কোনো উকিলকে নয়, নিজের বোনকেই অনেকগুলো বছর যাবত চেষ্টা করছি দিতে , বাংলাদেশের কোনো দূতাবাসই আমাদের পাওয়ার অব অ্যাটর্নির ডকুমেন্ট সত্যায়িত করে না। আমাকে পঙ্গু বানিয়ে রাখা সরকারি সিদ্ধান্ত। আমি দেশে ফিরতে পারবো, আমার বই লোকে পড়তে পারবে না, আমি কোনো খুনীর বিরুদ্ধেও মামলা করতে পারবো না।’
‘লোকে কার পক্ষে থাকে? ক্ষমতার পক্ষে নাকি অনাথের পক্ষে? অবশ্যই ক্ষমতার পক্ষে। তাই আছেও সেরকম। ক্ষমতা অন্যায় করলেও ক্ষমতাকে ‘ভিক্টিম’ সাজানো হয়েছে। অনাথের সব দোষ। অনাথ কেন সত্যটা বলে দিল, কেন অসময়ে হাটে হাঁড়ি ভাংলো? সরকারি লোকেরা এক পক্ষ। বিশাল সেই পক্ষ। অন্যদিকে আমি একা। সরকার বিরোধী লোকেরা আমার পুরোনো শত্রু। তারাও তো এককালের সরকার। কোনো তফাত নেই ওদের আর তাদের ভেতর। সবাই তসলিমা-বিরোধী।’
‘মাসুদা ভাট্টি নামক ক্ষমতাবান আমার সত্য ফাঁসের ‘জবাব’ দিয়েছে। জবাব তো নয়, আবারও এক রাশ মিথ্যের কলস উপুড় করেছে। আমি তাকে আমার পাবলিশার হিসেবে নাকি ফ্যান হিসেবে পরিচয় করিয়েছি, বড় ব্যাপার নয়। সে আমার পাবলিশারও নয়, ফ্যানও নয়। আমাকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়ে নিয়েছে নিজের স্বার্থের জন্য। সবচেয়ে বড় যে মিথ্যেটি ছিল, সেটি হলো ‘সে বাংলাদেশে ফিরে গেলে তাকে মৌলবাদিরা মেরে ফেলবে’ — এই মিথ্যে বাক্যটির কারণে সে ব্রিটেনে পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম পেয়েছিল।’
‘তখন তার পক্ষে নাকি সাংবাদিকরা দাঁড়িয়েছিল, তবে কারও দাঁড়ানোর জন্য কিন্তু তার পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম হয়নি, হয়েছে আমার চিঠির কারণে। ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথা বললো, এই সত্যটা কিন্তু বললো না। ব্রিটেনে পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার পর আমাকে কিন্তু কোনো ধন্যবাদও দেয়নি। দেবে কেন, আমার পিঠে ছুরি বসাবার জন্য তখন তো ছুরি শানাতে ব্যস্ত ছিল। উপকারীর উপকার স্বীকার করতে তার ইচ্ছে তো হয়ই না, বরং অপকার করতে ইচ্ছে হয়।’
‘এই উপকারের কথা উল্লেখ করার প্রয়োজন অনুভব করতাম না, যদি বদমাইশি না করতো। ক্ষতিকর লোকদের চিহ্নিত করতে হয় সর্ব সাধারণের মংগলের জন্য। অপ্রেসর এখন চমৎকার ভিক্টিম রোল প্লে করছে। বলছে আর কত শাস্তি আমি দেব তাকে? কী শাস্তি আমি তাকে দিয়েছি, শুনি। তার সম্পর্কে সত্য তথ্য জানানোর নাম বুঝি শাস্তি?’
‘আরও বড় মিথ্যে কথা লিখেছে, সে নাকি আমার বইয়ের সমালোচনা করেছে, ব্যক্তি আক্রমণ করেনি। রিয়েলি? দেখাক তার তিন কিস্তিতে লেখা তসলিমার প্রতি ঘৃণা আর নিন্দা ছুড়ে দেওয়া সেই নোংরা গালাগালি গুলো? তার লেখার শিরোনাম ছিল ‘তসলিমা নাসরিনের ক- ফুরিয়ে যাওয়া যৌবনের আত্মযৌবনিক কামশাস্ত্র’। শিরোনাম পড়েই নিশ্চয়ই অনুমান করা যায়, কী বলতে চেয়েছে সে। ওই নোংরা জিনিস আমি রাখিনি, কিন্তু নিজের রচনা তো নিজে সে রেখেছে। দেখাক। মানুষ পড়ুক।’
‘তসলিমা কুড়ি বছরে কুড়িবার লিখেছে তার কীর্তিকলাপ সম্পর্কে? ২০০৩ থেকে এখন ১৫ বছর। তো এই ১৫ বছরে তাহলে ছন্দ মিলিয়ে তাকে বলতে হবে ১৫ বার। সত্য শতবার উচ্চারণ করতে হয়, ১৫ বার তো কমই। এই ১৫ বছরে তার একবারও কেন ইচ্ছে করলো না ক্ষমা চাইতে? আজ যখন বড় বড় বুদ্ধিজীবী আর নারীবাদী দাঁড়িয়ে গেছে মাসুদাকে কেন চরিত্রহীন বলা হলো এই প্রতিবাদে, তখন কেন আমার মনে হবে না এরা সব হিপোক্রেটের জাত? তখনই বলতে ইচ্ছে করেছে চরিত্রহীনকে চরিত্রহীন বলবে না তো কী বলবে! আমি কোনো ‘মোক্ষম’ সময় বেছে নিইনি। সব সময়ই সত্য বলার সময়। যারা নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধে আদায়ে ব্যস্ত, তাদের কাছেই সত্য বলার জন্য এই সময়টা ভালো, ওই সময়টা খারাপ । আমার কাছে নয়।’
মইনুল হোসেন কী কারণে মাসুদাকে চরিত্রহীন বলেছে্ন, সে মইনুল হোসেন জানেন। আমি তাকে কী কারণে চরিত্রহীন বলেছি,ব্যাখ্যা করেছি। মাসুদা দাবি করেছে আমার পক্ষে সে লিখেছে অনেক। মানুষের সহানুভূতি কাড়ার জন্য ন্যাকামো বেশ জানা আছে তার। আমার সহানুভুতি পাওয়ার জন্যও একসময় ন্যাকামো করেছিল, আঁড়ালে ছুরিতে শান দিচ্ছিল। এখন সরকারি আরাম আয়েস জুটছে তার, রথী মহারথীরা তাকে ঘিরে আছে, আর সে ভান করছে, তার নাকি সংকটকাল চলছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দোষ দিয়েছে আমাকে।’
‘আমি দেশের রাজনৈতিক অবস্থার এদিক ওদিক করে দিয়েছি। আমি একা মানুষ, কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক, ধর্মীয় দল আমার পক্ষে কোনোদিন ছিল না, থাকবেও না। মাসুদা ভাট্টির মতো আমি প্রভাবশালী নই। আমার কোনো ক্ষমতা নেই রাজনীতির জগতে কোনো ঢিল ছোঁড়ার। আমার মতো রাজনীতি না বোঝা বোকা লোক যেমন সংসারে আছে, মাসুদা ভাট্টির মতো ধুর্ত লোকেরা চিরকালই ছিল, আছে।’
‘মানুষের পিঠে চড়ে চড়ে উঁচুতে গিয়ে ওঠে, তারপর লাথি মেরে ফেলে দেয় নিচের মানুষদের। আমি অনেক লোক দেখেছি জীবনে, মাসুদা ভাট্টির মতো এত ভয়ঙ্কর মিথ্যুক আর চরিত্রহীন জীবনে দেখিনি। আমাকে নিয়ে মন্দ কথা অনেক লোকই লিখেছে, এসবে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু যার জীবনের সবচেয়ে বড় উপকারটি আমি করে দিলাম, উপকারটা লুফে নিয়ে সে যখন আমার বই রিভিউয়ের নামে ব্যক্তি আমাকে জঘন্য আক্রমণ করে , যৌন হেনস্থাকারীর পক্ষ নিয়ে আমাকেই করে কুৎসিত পুরুষতান্ত্রিক আক্রমণ, তখন কষ্ট হয়। সেই কষ্ট থেকেই লিখেছি গতকাল।’