দেশের খবর: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ই-ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল দেশে আটটি অঞ্চলে ইভিএম মেলা বসেছে। ১২ ও ১৩ নভেম্বর হবে ঢাকায়। গতকাল নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে ৮৪ হাজার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন কিনবে নির্বাচন কমিশন। এগুলো ব্যবহার করা হবে নির্বাচনে। ইতোমধ্যে আমরা নির্বাচন কর্মকর্তাদের ইভিএম প্রশিক্ষণ দিয়েছি।
তিন হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্পও পাস হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আরপিও সংশোধন হবে। বর্তমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশন আরপিও এর ২৬ ধারা সংশোধন করে ব্যালটের পাশাপাশি ইভিএমে ভোট গ্রহণের সুযোগ রাখছে।
তবে যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট দেয়ার এ সিস্টেম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পৃথিবীর শতকরা ৯০ ভাগ দেশে ইভিএম পদ্ধতি নেই। যে দেশগুলো এটি চালু করেছিল তারাও এখন এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বা সংকুচিত করেছে। কোনো কোনো দেশ নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় আছে। ইতোমধ্যে জার্মান, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, রোমানিয়া, প্যারাগুয়ে, নরওয়ে, ইতিলিসহ বেশ কিছু দেশ ইভিএম চালু করার পর বাতিল করে দিয়েছে। বর্তমানে ৪টি দেশে এ ইভিএম পদ্ধতি বহাল আছে। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করে। ২০০৯ সালে জার্মানির ফেডারেল ভোট ইভিএমকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিমকোর্ট ৩টি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করে। নেদারল্যান্ডে ই-ভোটিং কার্যক্রমের প্রয়োগ হয়। তবে, জনগণের আপত্তির মুখে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় নেদারল্যান্ড সরকার। আমেরিকার ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাকিগুলোতেও তা নিষিদ্ধ হওয়ার পথে। ভারতের ইকোনোমিক টাইমস পত্রিকার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে মাত্র ৪টি দেশে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট ইভিএমে সম্পন্ন তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করে।
ড. অ্যালেক্স হালডারমেন নামে এক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছিলেন, আমেরিকায় ইভিএম কারচুপি প্রতিরোধক (টেম্পার প্রুফ) নয়। ফলে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। যুক্তরাজ্যেও অনেক গবেষণা ও আলোচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে নির্বাচনে বিতর্কিত ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সুইজারল্যান্ড-স্পেন-রোমানিয়াসহ বেশ কিছু দেশে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আশাব্যঞ্জক ফল না পাওয়ায় এর আর প্রয়োগ ঘটেনি। নরওয়েতে কোন ভোটার কাকে ভোট দিচ্ছে, এ গোপনীয়তা ভঙ্গের ভয়ে পরীক্ষামূলক নির্বাচনে ভোটের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, জালিয়াতির সুযোগ থাকায় এতে এক চাপে ৫০টি ভোট দেয়া সম্ভব। এক প্রতীকে চাপ দিলে অন্য প্রতীকে যেতে পারে। বিদেশের মাটিতে বসেও ইভিএম হ্যাকিং করা যায় এবং একটি ইভিএম হ্যাকিং করতে এক মিনিটের বেশি সময় লাগে না।
ইভিএম ব্যবহার নিয়ে পার্শ্ববর্তী ভারতে চলছে যথেষ্ট বিতর্ক। ২০০৯ সালের শেষ দিক থেকে এটি বেশ গতি লাভ করেছে। ভারতের আদালতে ইভিএম নিয়ে একাধিক পিটিশন আছে। ভারতে বিভিন্ন এনজিও এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সুপ্রিমকোর্টে মামলা করেছেন ইভিএম নিষিদ্ধ করার জন্য। এর মধ্যে ভারতের জনতা পার্টির প্রেসিডেন্টও দুটি আসন নিয়ে ইভিএম-এর জালিয়াতির বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা করেন। প্রযুক্তিবিদরাও এখন ইভিএমের বিরুদ্ধে সোচ্চার। সম্প্রতি এক বিবৃতিতে ‘ভারতের ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন জালিয়াতি প্রতিরোধক নয়’ দাবি করেছে একদল মার্কিন আইটি বিশেষজ্ঞ। তারা বলেন, ‘ভারতের ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন জালিয়াতি প্রতিরোধক নয় এবং দেশটির নির্বাচন কমিশনকে স্বচ্ছ ও নিরাপদ ভোট গ্রহণ ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা উচিত।’ বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন— হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেন আডিডা, মাইক্রোসফট গবেষক ড. জোশ বেনালো ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাট ব্লেইজ।
ভোটিং মেশিনে কারচুপি সম্ভব অভিযোগ তুলে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ফের ব্যালট পেপারে ভোটের দাবিতে সোচ্চার এখন। তারা দিল্লিতে বিক্ষোভও করেছে। গত ২৭ আগস্টে ভারতের নির্বাচন কমিশনের ডাকা এক সর্বদলীয় বৈঠকে সব বিরোধী দল একযোগে নির্বাচন কমিশনের কাছে ইভিএমের মাধ্যমে কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ জানায়। তারা ইভিএম বাতিলের দাবি জানান। বৈঠকে শাসকদল বিজেপি ছাড়া উপস্থিত ছিল কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বহুজন সমাজ পার্টি, সিপিআই, সিপিএমসহ ৫১টি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম এ পদ্ধতি চালু হয়।