সুভাষ চৌধুরী:
শিল্পীর রং তুলিতে ফুটে উঠেছে একটি বাংলাদেশ। শ্যামলে সবুজে ¯œাত ¯িœগ্ধ চিরায়ত বাংলার অমলিন প্রকৃতি। ফুল পাতা পাখি বিস্তীর্ন নদী বর্ষায় বাংলা ধান সরষে ক্ষেত সবই দেখা দিয়েছে তুলি আঁচড়ে। উঠে এসেছে রক্তঝরা ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, লাল সবুজ পতাকা হাতে বিজয় দিবস, গণতন্ত্রের জন্য অবিরাম সংগ্রামের এক একটি ইতিহাস ,এক একটি সংগ্রাম। সাতক্ষীরার ঈষিকা অর্কেস্ট্রার এমএ জলিল এই একক চিত্র প্রদর্শনী উপহার দিয়েছেন। শিল্প কলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত পাঁচদিনব্যাপী এ চিত্র মেলা শেষ হয়েছে ২০১৬ এর শেষ সূর্যোদয় সূর্যাস্তের দিন শনিবার। শিল্পকলা ভবনের প্রাচীর জুড়ে ৭৪ টি জল রং ছবির প্রস্ফূটিত চিত্র কেড়ে নিয়েছিল সবার দৃষ্টি। অপলক নেত্রে দর্শকরা তাদের প্রাণ জুড়িয়েছেন বাংলাদেশকে বারবার দেখে। দুষ্টু ছেলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে। ফিরছে না কেনো এই উদ্বেগ নিয়েই কাটছে মায়ের দিন। সেকি আর ফিরবে না কোনোদিন। নাকি সালাম রফিক শফিক বরকতের পথে দামাল সন্তানদের মতো রক্ত দিয়ে গড়ে তুলবে এক একটি শহীদ বেদী। চেয়ে দেখো কালো ধোয়ার মতো কুন্ডলী পাকিয়ে কিভাবে বাংলাদেশকে তিল তিল করে গ্রাস করছে দুর্নীতি সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদ। এখনই এদের পরাভূত করতে না পারলে কেমন বাংলাদেশ হবে তা নিয়ে আতংকিত হয়ে উঠেছে প্রদর্শিত চিত্রকর্ম। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই মিছিল, ৫২ তে মাতৃভাষার জন্য সন্তানদের বাঁধ ভাঙ্গা মিছিল স্লোগান আর তাদের আত্মাহুতিতে জন্ম নেওয়া প্রথম শহীদ মিনার আমাদের চিন্তার জগতকে নিয়ে গেছে বহু গভীরে। উনসত্তুরে সাত কোটি বাঙ্গালির গনঅভ্যুত্থান আর ছাত্র নেতা আসাদের আত্মত্যাগ, সত্তুরের সাধারণ নির্বাচনে বাঙ্গালির নিরংকুশ জয় ইতিহাসের পেছন পাতা অনুশীলনে নিয়ে গেছে দর্শকদের। ৭ মার্চ তর্জনী উচিয়ে বঙ্গবন্ধুর গগন বিদারী ভাষণ, ২৫ মার্চের কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালির ওপর পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হামলার করুণ চিত্র ধরা পড়েছে শিল্পীর তুলিতে। পাক হানাদার বাহিনীর বাঙ্গালির ওপর হামলা ও গণহত্যা, নির্যাতিত শরনার্থীদের দেশ ত্যাগের করুন চিত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কালীন স্মৃতির পাতায় নজর কেড়ে নেয়। দেশ মাতৃকার স্বাধিকার অর্জন,বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে স্বাধীন ভূখন্ড হিসাবে তুলে ধরার অবিরাম সংগ্রামে রাইফেল হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুবিনাশী যুদ্ধ দর্শকদের সংগ্রামী জীবনে নতুন করে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে বিজয় দিবসের উল্লাসের চিত্র। সেই সাথে সাথে লাল সবুজের পতাকার অমলিন ছবিও উপহার দিয়েছেন তিনি। শিল্পী এমএ জলিলের ছবিতে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষয় ক্ষতির আশংকার দৃশ্য। এ দৃশ্য আমাদের জীবন জীবিকা ভাবনায় নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। ভাবতে শিখিয়েছে পরিবর্তিত জলবায়ুর করাল গ্রাস থেকে কিভাবে নিজেদের রক্ষা করা যাবে তা নিয়ে। এমএ জলিলের চিত্রকলায় আরও উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যুগ¯্রষ্টা কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি, মাষ্টারদা সূর্য সেন, নারী জাগরনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানি ,বীর কন্যা প্রীতিলতা সেন, বিপ্লবী ইলা মিত্র সহ মহামনিষীদের প্রতিকৃতি। চিত্রে তিনি উপহার দিয়েছেন লালন ফকির, শাহ আবদুল করিম আর হাসন রাজার মতো মরমী শিল্পীর অবয়ব। শিল্পী এসএম সুলতানকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তুলির আঁচড়ে। চিত্রকলায় বীরত্বের সাথে স্থান করে নিয়েছে ‘গনতন্ত্র মুক্তি পাক স্বৈরাচার নিপাত যাক’ দৃশ্যও। এমএ জলিল তার ছবিতে বিজয়ানন্দে আমি বাংলার গান গাই দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন। আছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন পতাকা কাঁধে নিয়ে বীরের বেশে অস্ত্র সমর্পন। একক চিত্রে আরও ফুটে উঠেছে ৪৭ পূর্ব ও পরবর্তী ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। আছে মওলানা ভাসানির কাগমারি সম¥েলনের দৃশ্য, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার আন্দোলন, একাত্তরে বীরাঙ্গনা মা ও বোনেদের ওপর নির্যাতনের চিহ্ণ। আছে বুদ্ধিজীবী হত্যা, বধ্যভূমি, একাত্তরে গণহত্যার শিকার মানবসন্তানের দেহ পচে গলে ওঠার হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য। শিল্পীর তুলিতে ফুটে উঠেছে বাঙ্গালির স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম ও আত্মশক্তির কাছে ১৬ ডিসেম্বর এএকে নিয়াজীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পন। দীর্ঘ সংগ্রামে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের পরও বাংলাদেশে স্বৈরাচারি থাবা মোকাবেলায় বাঙ্গালির গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ডা. মিলনের আত্মদানের দৃশ্যও তুলে ধরতে ভোলেননি শিল্পী জলিল। শিল্পী ভুলে যাননি সমাজে নানাভাবে নিবর্তনের শিকার নারীর অনুশোচনার কথা। ভোলেন নি একান্তে বসে দুই প্রবীনার পুরনো দিনের স্মৃতিচারণের কথা। ফেলে আসা দিনগুলি নিয়ে তাদের অনুশোচনার দৃশ্য তুলিতে ধারণ করেছেন তিনি। অস্তায়মান সূর্যের লাল আভায় ডানা ভাসিয়ে বিহঙ্গ্রে নীড়ে ফেরার চিরায়ত ছবি আর সেই সাথে কর্ম ক্লান্ত শ্রমজীবীর কুটিরে ফেরার দৃশ্য আমাদের গ্রামবাংলাকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে। ছবিতে রয়েছে এক ঝাঁক উড়ন্ত বলাকার আকাশ পথে ভেসে চলার মুগ্ধকর দৃশ্য। ছবিতে রয়েছে একজন উর্বশীর ভ্রান্ত পথ চলা। রয়েছে মাতৃত্ব আর মাতৃ¯েœহের এক ¯িœগ্ধ পরশ। জসীমউদ্দিনের পল্লী কবিতার আদলে চিত্রে জাগরিত হয়েছে স্মৃতি ‘তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়’। আছে বৃক্ষছায়ায় কারও জন্য প্রতীক্ষার দৃশ্য। আল পথে কৃষকের হেঁটে চলা , প্রকৃতির কোলে সবুজের আস্তরন উপহার দিতে মাঠে কৃষক আর বাড়ির আঙ্গিনায় কিষানীর শস্য মাড়াইয়ের দৃশ্য চাঁদনি রাতে স্ফটিকের মতো ফুটে উঠেছিল দর্শকদের নজরে। লাল সুর্যের আভায় ভেসে চলা নৌকা আর মাঝির মুখে ‘ও নদীরে’ ভাওয়াইয়া বাঙ্গালি সংস্কৃতিকে আবারও তুলে ধরেছিল। সেই সাথে মধ্যরাতে বাঁশের বাঁশরীর করুন সুর লহরীতে কেঁদে ওঠে বিরহী নারীর হৃদয় – এ দৃশ্যও উপহার দিয়েছেন তিনি। সাতক্ষীরায় এই প্রথম কোনো একক নান্দনিক চিত্র প্রদর্শনী দৃশ্যে অনুভবে আর অবগাহনে নাগালে পেয়েছেন সাতক্ষীরার মানুষ। তারা হৃদয় দিয়ে হাতড়েছেন স্মৃতি, দুরদৃষ্টি দিয়ে ভেবেছেন ভবিষ্যত, স্মরণে এনেছেন ভাষা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, অবিরাম বাংলার চিরায়ত দৃশ্য। যা ৭৪ শিল্পকর্মের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন সাতক্ষীরার শিল্প কর্মে পাইওনীয়র এমএ জলিল।