অনলাইন ডেস্ক: নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের যে পরিকল্পনা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার গ্রহণ করেছে তা অবিলম্বে প্রত্যাহার চায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
জাতিসংঘের পরামর্শ ছাড়াই দুই দেশের তড়িঘড়ি এই সিদ্ধান্ত মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জীবন ও স্বাধীনতা আবারও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলবে বলে মনে করে সংস্থাটি।
শুক্রবার এক বিবৃতিতে এ কথা জানায় এইচআরডব্লিউ।
বিবৃতিতে এইচআরডব্লিউ‘র শরণার্থী অধিকার বিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক বলেন, “মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা যে সহিংসতা ও নির্যাতনের কারণে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, সে বিষয়টির সুরাহা নিয়ে কিছুই বলছে না দেশটি।”
“যদি বাংলাদেশ জাতিসংঘের পরামর্শ ছাড়াই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে বিগত বছরে তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক সুনাম অর্জন করেছিল তা ক্ষুণ্ন হবে,” যোগ করেন তিনি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বরে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে সই করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে ৩০ অক্টোবর ঢাকায় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) এক বৈঠক বসেন দুই দেশের কর্মকর্তারা। এটি ছিল জেডব্লিউজি’র তৃতীয় বৈঠক।
বৈঠক শেষে কর্মকর্তারা জানান, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলকে পাঠানোর একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। প্রথম ধাপে ৪৮৫ পরিবারের ২ হাজার ২শ’ ৬০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হবে।
মিয়ানমার কর্মকর্তারা জানানা, ১৫ নভম্বের থেকে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রতি সপ্তাহে ১৫০ রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করা হবে। বাংলাদেশ সরকারকে আসছে জাতীয় নির্বাচনের আগে এই প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারকে ৮ হাজার ৩২ রোহিঙ্গার তালিকা দেয় বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬শ’ জনকে সনাক্ত করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এই সনাক্তদের মধ্য থেকে প্রথম পর্যায়ে ২ হাজার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে চায় মিয়ানমার।
বাংলাদেশ তাদের করা নিবন্ধনকৃত তালিকা থেকে যথেচ্ছভাবে এই রোহিঙ্গাদের নাম বাছাই করেছে। তাদের নাম বাছাই, ফেরত পাঠানো ও অন্যান্য বিষয়াদি যা মিয়ানমার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে, এসব নিয়ে প্রতাবাসনের তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও করেনি বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার আবুল কালাম এইচআরডব্লিউ’কে বলেন, “আমরা যে তালিকা তৈরি করেছি সেটি বাছাই করে করা হয়নি। কেননা, তারা সবাই ফিরে যেতে চান।”
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা আরও জানান, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে যাচাই-বাছইয়ের জন্য দ্বিতীয় তালিকাটি ইতোমধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। নতুন এই তালিকায় ২২ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গার নাম ও ঠিকানা রয়েছে।
জুনে জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে সহজ করতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি সমঝোতাস্মারক সই করে। এরপর থেকে রাখাইন রাজ্যে তাদের সীমিত মূল্যায়নও শুরু হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ও মিয়ানমার তাদের নেয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে ইউএনএইচসিআর’র সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেনি। জাতিসংঘ দুই দেশের এই সিদ্ধান্তকে ‘তড়িঘড়িমূলক ও অপরিপক্ক’ বলে আখ্যা দিয়ে এর বিরোধিতা করেছে।
ইউএনএইচসিআর’র মুখপাত্র আন্দ্রেজ মাহেসিজ ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলেন, “রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা রোহিঙ্গাদের সেখানে ফিরিয়ে যাওয়ার জন্য নিরাপদ, মর্যাদাকর ও টেকসই নয় বলে আমরা মনে করি। এই কারণে ইউএনএইচসিআর এই মুহূর্তে কোনো রোহিঙ্গাকে সেখানে ফেরত পাঠাতে সহায়তা করতে আগ্রহী নয়।”
চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক এই সংস্থা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গাদের যে তালিকা আদান-প্রদান হয়েছে সেটির প্রস্তুত, হস্তান্তর, মিয়ানমার সরকার কর্তৃক গ্রহণ এবং যাচাই-বাছাই কোনোটির সঙ্গেই ইউএনএইচসিআর’র সম্পৃক্ততা নেই।
বাংলাদেশের উচিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বৈধ শরণার্থী মর্যাদা ও কাগজপত্র প্রদানসহ এই মানবিক প্রক্রিয়ায় ও যে কোনো স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন পরিচালনায় সমন্বয় সাধনে ইউএনএইচসিআর’কে প্রধান ভূমিকা পালন করতে দেয়া।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধন ও মানবতাবিরোধী নির্যাতনের শিকার ৭ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা গত বছর বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তারা আগে পাড়ি জমানো বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের শিকার ২ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে বাংলাদেশের ক্যাম্পে এসে আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন এরই মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি ও গণহত্যার অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান চালানোর জন্য যথেষ্ঠ তথ্য পেয়েছে।
যদিও বাংলাদেশ জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনের অংশীদার নয়, তথাপি প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী, যেখানে নির্যাতন-নিপীড়ন ও হত্যার আশঙ্কা রয়েছে, সেখানে জোরপূর্বক শরণার্থীদের ফেরত না পাঠাতে বাধ্য।
অক্টোবরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের প্রতিনিধি তার বক্তব্যে বলেছিলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আগে মিয়ানমার সরকারকে বৈষম্যমূলক আইন, নীতি ও এর চর্চা বিলুপ্ত করতে হবে। তিনি এখানে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়ার প্রধান কারণগুলো তুলে ধরেন এবং তাদের অধিকারের ও নাগরিকত্ব নিশ্চিতের দাবি জানান। সেই সঙ্গে তিনি দায়বদ্ধতা ও নির্যাতন বন্ধে বিচারের নিশ্চয়তার প্রুতিশ্রুতি চান, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে ন্যূনতম দাবি।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা করা হয়েছে তাদের সঙ্গে আলোচনা ও সম্মতি ছাড়াই, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পরিপন্থি। একটি অবাধ, পরিপূর্ণ পছন্দসই প্রত্যাবাসনের জন্য শরণার্থীদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। সেই সঙ্গে ফেরত পাঠানোর উদ্দেশ্য, যেখানে ফেরত পাঠানো হবে সেখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি, নিরাপত্তা, সহায়তা ও জানমাল রক্ষার বিষয়ে সঠিক তথ্য তাদেরকে অবহিত করতে হবে।
এইচআরডব্লিউ’র সঙ্গে আলাপকালে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থীই নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আশা ব্যক্ত করেছেন। তবে তার আগে নিজেদের নিরাপত্তা, জমিতে যাওয়া ও জীবিকা অর্জনের অধিকার, চলাফেরার স্বাধীনতা, নাগরিকত্বের অধিকার ও নিজস্ব পরিচিতি লাভের নিশ্চিয়তা দাবি করেছেন তারা।
৩১ অক্টোবর রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যায় বাংলাদেশ-মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল। এই প্রতিনিধি দলের কাছে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আগে নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও বিচারের নিশ্চয়তা চেয়ে একটি চিঠি হস্তান্তর করে। চিঠিতে বলা হয়, “আমাদেরকে সমান নাগরিকত্ব ও মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে আপনার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রমাণ দাবি করছি আমরা। আমরা আপনাকে জানাচ্ছি যে, দাবিগুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে যাচ্ছি না।”
এইচআরডব্লিউ‘র শরণার্থী অধিকার বিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক বলেন, “মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সর্বশেষ এই উদ্যোগ তাদের জাতিগত নিধন নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা মাত্র, যাতে করে কাউকে এই ঘটনায় বিচারের আওতায় না আনা হয়।”
এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অনুদান দেয়া থেকে দাতাদের বিরত থাকারও আহ্বান জানান ফ্রেলিক। তিনি বলেন, “দাতাদের উচিত এই বিপজ্জনক পরিকল্পনায় অংশ না নেয়া। কেননা, এটি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার জন্য হুমকি।”