দেশের খবর: এ যেন তুঘলকি কারবার। একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে ৪০ প্রকল্প। ব্যয় হবে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বরাদ্দের এক তৃতীয়াংশ। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে প্রকল্প অনুমোদনের সংখ্যা ততই বাড়ছে। ভোটের আগে উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের হিড়িক পড়েছে। মন্ত্রণালয়গুলো যে প্রকল্প পাঠাচ্ছে, তাই অনুমোদন দিয়ে দেয়া হচ্ছে। রোববার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) শেষ সভা। সভায় এসব প্রকল্প উপস্থাপন করছে পরিকল্পনা কমিশন। এর আগের একনেক সভাগুলোতেও উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের হিড়িক পড়েছিল। শেষ সভাতে প্রকল্প সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল বলেন, শেষের দিকে প্রকল্প বেশি পাস হলে দোষের কিছু নেই। আগে এত প্রকল্প আসেনি, কিন্তু এখন আসছে বলে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। আমরা সবখানে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চাই। রোববার বিকেলে ডাকা হয়েছে একনেক সভা। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করবেন। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে এ সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী ব্রিফিং করবেন।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, একনেকে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত প্রকল্পগুলোর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে- বাংলাদেশ রেলওয়ের জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প। ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ২৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
নতুন রেল লাইনে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ উভয় ধরনের ট্রেনই চলাচলের ডুয়েলগেজ করা হবে লাইনটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। জি-টু-জি চুক্তির আওতায় প্রকল্প সহায়তা বাবদ প্রায় পৌনে ৯ হাজার কোটি টাকা দেবে চীন। বাকি টাকা সরকারের কোষাগার থেকে সরবরাহ করা হবে।
এরপর রয়েছে পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে (কুড়িল থেকে বোয়ালিয়া পর্যন্ত) ১০০ ফুট প্রশস্ত খাল খনন ও উন্নয়ন (১ম সংশোধিত) প্রকল্প। অনুমোদনকালে ব্যয় ছিল ৫ হাজার ১৪৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এখন এক লাফে প্রকল্প ব্যয় দ্বিগুণ হচ্ছে। ব্যয় ধরা হচ্ছে, ১০ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অনেক প্রকল্পই অনুমোদনের ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করা হয়েছে। এ ছাড়া কঠিন শর্তের ঋণ নিয়েও বড় বড় প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। ফলে দেশ ঋণগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
এরপর প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- পায়রা সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ, ব্যয় ৩ হাজার ৯৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের জন্য ৯টি আবাসিক টাওয়ার নির্মাণ, ব্যয় ৯৭৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। বাংলাদেশ পুলিশের সন্ত্রাস দমন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ব্যয় ৩৫৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ পুলিশের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ, ব্যয় ১১৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। কক্সবাজার বিমান বন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ, ব্যয় ৩ হাজার ৭০৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ঢাকা খুলনা (এন-৮) মহাসড়কের যাত্রাবাড়ি ইন্টারসেকশন থেকে (ইকুরিয়া-বাবুবাজার লিংক সড়কসহ) মাওয়া পর্যন্ত এবং পাচ্চর-ভাংগাংশ ধীর গতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেনসহ ৪ লেনে উন্নয়ন প্রকল্পের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত কারণ, ব্যয় ৪ হাজার ১১১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ জেলা মহাসড়ক (জেড-১০৯৯) হাড়িয়াখালী থেকে শাহপরীর দ্বীপ অংশ পুনঃনির্মাণ, প্রশস্তকরণ এবং শক্তিশালীকরণ, ব্যয় ৬৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। টাঙ্গাইল পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যয় ২২৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। হরিপুর শহরের টেপাখোলা লেক উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে।
এ ছাড়া কুমিল্লা জেলার ৫টি পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৪৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এনহেন্স প্রজেক্ট (এলজিইডি-অংশ), ব্যয় ২২৫ কোটি টাকা। অন্য প্রকল্পগুলো হলো- গ্রাম সড়ক পুনর্বাসন প্রকল্প। ১৬ গোপালগঞ্জ জেলার গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন (১ম সংশোধিত), ফরিদপুর জেলার গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন (১ম সংশোধিত), বৃহত্তর ঢাকা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৪, তিন পার্বত্য জেলায় দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পল্লী সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প।
পশ্চাদপদ কুড়িগ্রাম ও জামালপুর জেলার দারিদ্র্য হ্রাসকরণ, ব্যয় ১৯৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা। গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সেতু/কালভার্ট নির্মাণ, গ্রামীণ মাটির রাস্তা টেকসইকরণের লক্ষ্যে হেরিং বোড বন্ড (এইচবি) করণ (২য় পর্যায়), বঙ্গমাতা ন্যাশনাল সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার রিসার্স সেন্টার স্থাপন, ব্যয় ১ হাজার ৫০৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
মুগদা মেডিকেল কলেজের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি সম্প্রসারণ, ব্যয় ৫২৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন, ব্যয় ১ হাজার ১০৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও একাডেমিক কার্যক্রম সম্প্রসারণ, ব্যয় ৮৩৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রকার যানবাহন ও যন্ত্রপাতি ক্রয়, ৬৪৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। র্যাবের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ডুবুরি ইউনিট সম্প্রসারণ, ব্যয় ১৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ন্যাশনাল পাওয়ার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (১ম সংশোধন), ব্যয় ২ হাজার ৫১৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ব্যয় ১ হাজার ৩৭৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি লি. এর উৎপাদন পদ্ধতি ওয়েট প্রসেস থেকে ড্রাই প্রসেস এ রূপান্তরকরণ (১ম সংশোধিত), ব্যয় ৮৯০ কোটি ১০ লাখ টাকা।
৩৩. বিএআর অব কেরু অ্যান্ড কোং (বিডি) লিমিটেড (১ম সংশোধিত), ব্যয় ১০২ কোটি ২১ লাখ টাকা। এসব প্রকল্পের বাইরে আরও ৬ -৭টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য টেবিলে উঠানো হবে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এ অর্থ বছরের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে ৮-১০টি প্রকল্প অনুমোদন হয়ে আসছিল। তবে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে প্রকল্প অনুমোদনের সংখ্যা তত বাড়ছে। এ বছর এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, প্রতিটি প্রকল্পের শুরুতে যা ব্যয় দেখানো হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহুগুণে এর বাজেট বেড়ে যায়। আমরা এখন ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের দিকে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা মধ্যম আয়ের কথা বলছি, অথচ আমাদের দেশে এখনও এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ দরিদ্র। তাদের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। মানুষ দেশের বাইরে যায় কিন্তু রেমিটেন্স কমে যাচ্ছে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।