ক্রীড়া ডেস্ক: নেপিয়ারের এক রেস্তোরাঁয় বসে কথা হচ্ছিল তাসকিন আহমেদের সঙ্গে। মুখে সব সময় লেগে থাকা হাসিটা বাড়তি ঝিলিক দিচ্ছে যেন। ব্যাপারটা রহস্যময় নয়? পরদিন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি। সেই দলে তাঁর না থাকার কথাই শোনা যাচ্ছিল তখন। তবু তাসকিন কেন এত হাসিখুশি!মনের মধ্যে যখন এই প্রশ্নের দৌড়ঝাঁপ, তাসকিন এই প্রতিবেদককে ফেলে দিলেন আরও বিস্ময়ের মধ্যে, ‘আমার মনে হয় টি-টোয়েন্টি সিরিজে কোনো ম্যাচেই খেলা হবে না…।’ অদ্ভুত ব্যাপার! দল হারছে বলে মানুষের কটু কথা শোনার ভয়ে ফেসবুকে দৃশ্যমান আনাগোনা কমিয়ে দিয়েছেন। এখন টি-টোয়েন্টিও না খেললে নিউজিল্যান্ডে তাসকিনের কাজটা কী? হতে পারেন একজন হাসিখুশি-উচ্ছল তরুণ, কিন্তু একটি সিরিজে কোনো ম্যাচই খেলা হবে না বুঝে যাওয়ার পরও ভেতরে ফুর্তির ভাবটা কীভাবে থাকে? খেলতে না হওয়ায় মানুষের এত আনন্দ!আসল কথা হলো, টি-টোয়েন্টি সিরিজ না খেলার মধ্যেই লুকিয়ে তাসকিনের টেস্ট অভিষেকের সম্ভাবনা। দলসূত্রে আগেই জানা গিয়েছিল, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হবে তাসকিনের। সেটা হতে পারে প্রথম অথবা দ্বিতীয় টেস্টে। টি-টোয়েন্টি সিরিজ থেকে তাঁকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত সে কারণেই। অভিষেক টেস্টে যতটা সম্ভব তরতাজা তাসকিনকে চাইছেন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।তাসকিনের মধ্যেও নেই টি-টোয়েন্টি না খেলার হতাশা। সিরিজের বাকি দুই ম্যাচেও যদি সত্যি সত্যিই দলে রাখা না হয়, তবু তাঁর মন খারাপ হবে বলে মনে হয় না। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়, জীবনের এই থিওরি এরই মধ্যে বোঝা হয়ে গেছে। শারীরিক গড়ন, বলের গতি ও ধরন—সব মিলিয়ে একটা সময় পেসার তাসকিনের মধ্যে টেস্টে ভালো করার সম্ভাবনাই বেশি দেখেছে সবাই। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরুতে পাওয়া হাঁটুর চোটে সেটা দীর্ঘায়িত হলো অনেক। ২০১৪ সালের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক, এরপর দুটি বছর শুধু সতর্কতার কারণে তাঁকে দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট থেকে দূরে রাখা হয়েছে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট সর্বশেষ খেলেছেন ২০১৩ সালের বিসিএলে। মাঝে হোম সিরিজের আগে বিদেশি দলগুলোর বিপক্ষে দু-একটি তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচ খেললেও দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটের চাপ সে অর্থে দেওয়া হয়নি।তবে এখন নিজেকে টেস্ট খেলার মতো ফিট মনে করছেন তাসকিন। হাঁটুর পুরোনো চোট দীর্ঘদিন মাথা চাড়া না দেওয়ায় ফিজিও-চিকিত্সকদের দিক থেকেও বাধা নেই। সেই দুপুরে আড্ডার মধ্যেই বলছিলেন, ‘আমি তো চাই সব ধরনের ক্রিকেটে খেলতে। ইনশা আল্লাহ, অনেক ফিট এখন। খেলতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’ কিন্তু টেস্ট খেলার তো একটা আলাদা প্রস্তুতি লাগে। নিউজিল্যান্ডে এই কদিন সেটা নিলেও এমনিতে যে লাল বল থেকে দূরে দূরেই ছিলেন বরাবর! দেশের বাইরে টেস্ট অভিষেক হলে সবকিছুর সঙ্গে ঠিকভাবে মানিয়ে নিতে পারবেন তো?তাসকিনের কথা ভুল ভাঙাল। লাল বল হাতে কম নিলেও ওই জিনিসের ওপর তাঁর চোখ সব সময়ই ছিল, ‘সময় পেলেই ইউটিউবে স্টুয়ার্ট ব্রড, ডেল স্টেইনদের বোলিং দেখি। তাদের আট-দশ ওভারের স্পেলগুলো, বিধ্বংসী ডেলিভারি…এই সব। তাদের দেখে কিছু জিনিস বোঝার চেষ্টা করি।’ টেস্ট না খেললেও ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে খেলা হয়ে গেছে ৩৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সঙ্গে ইউটিউবের ফুটেজ আর টেলিভিশনে খেলা দেখে টেস্টের বোলিংটাও মোটামুটি বুঝে নিয়েছেন তাসকিন, ‘আমি যেটা বুঝি, টেস্টে একটানা ভালো বোলিং করে যাওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই স্ট্যামিনা এখন আমার আছে। সঙ্গে ভালো জায়গায় বল ফেলা, ভেরিয়েশন, সুইং করানো…এসবও লাগবে।’কথা বলার সময় হাত দিয়ে বল গ্রিপের শ্যাডো দেখাচ্ছিলেন। চোখ জোড়াও যেন রেস্তোরাঁর পাথরের মেঝেতে খুঁজে বেড়াচ্ছিল উইকেট। টেস্ট খেলার রোমাঞ্চের অপেক্ষা হয়তো এমনই। এ সময়টার অপেক্ষায় কত রাত-দিন কেটেছে, সেটা তাসকিনের চেয়ে ভালো আর কে জানেন? টেস্ট নিয়ে কথা এগোয়, আর কণ্ঠে আবেগ বাড়ে, ‘ছোটবেলায় সারা দিন মাঠে পড়ে থাকতাম। বাসা থেকে আব্বা-আম্মা গিয়ে আমাকে মাঠ থেকে তুলে আনতেন। আমার সেই প্রিয় সময়টা আবার আসছে…এখন আমি টানা পাঁচ দিন মাঠে থাকব। কেউ আমাকে নিতে আসবে না…।’অপেক্ষার ফল মধুর হয়। তাসকিনের জন্যও কথাটা সত্যি। তাঁর টেস্ট অভিষেকের সময় বাংলাদেশ দলের পেস বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশ। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম পাঁচ শ উইকেট নেওয়া ক্যারিবীয় কিংবদন্তি খেলোয়াড়ি জীবনে কখনো চোট-আঘাতের সঙ্গে আপস করেননি। ওয়ালশকে যত দেখেন, ততই মুগ্ধ হন তাসকিন, ‘নেটে হেলে-দুলে এসে এখনো যে রকম বোলিং করেন, অবিশ্বাস্য! কী মারাত্মক সুইং, বল এখানে পড়ে ওখানে যায়। খেলা ছাড়ার এত দিন পর এই বয়সে কীভাবে পারেন বুঝি না।’ভয় নেই। ওয়ালশ যখন সঙ্গে আছেন, টেস্ট বোলিংয়ের সবই বুঝে যাবেন একটা সময়ে। তাসকিনকে লাল বলের আগাম অভিনন্দন।