জাতীয়

সারাদেশ তাকিয়ে আছে গণভবনের দিকে

By Daily Satkhira

November 07, 2018

*প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ফের সংলাপ আজ *৭ দফা দাবি পুনরুল্লেখ করবে ঐক্যফ্রন্ট; সংবিধানসম্মত বিকল্প প্রস্তাব দেওয়ারও প্রস্তুতি, তবে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের বাদ দেওয়ায় নতুন মাত্রা যুক্ত হলো *ফলাফল যাই হোক সংলাপের পর্দাও নেমে যেতে পারে আজ

দেশের খবর: প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আজ বুধবার ফের সংলাপে বসছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। বেলা ১১টায় গণভবনে এই সংলাপ শুরু হওয়ার কথা। গত ১ নভেম্বর দু’পক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম দফা সংলাপে কার্যকর কিংবা ‘বিশেষ কোনো সমাধান’ না আসায় ঐক্যফ্রন্টের আগ্রহেই আজ আবারও সংলাপ হতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গণসহ দেশের প্রায় প্রতিটি মহলেই বলাবলি হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সংকট নিয়ে নিকট-অতীতের কোনো রাজনৈতিক সংলাপই ফলপ্রসূ হয়নি। দৃশ্যমান তৃতীয় কোনো পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়াই দেশে প্রথমবারের মতো সরকার প্রধানের সঙ্গে মূল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সরাসরি এই সংলাপের ভাগ্যও আজই জানা যেতে পারে। আজ সকাল সবার চোখ নিবদ্ধ থাকবে গণভবনের দিকে। সংলাপ শেষ হওয়ার পর বোঝা যেতে পারে আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ কোনদিকে মোড় নিতে যাচ্ছে।

‘সীমিত পরিসরে’ আবারও সংলাপ চেয়ে রবিবার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। এতে সাড়া দেন প্রধানমন্ত্রী। আজকের সংলাপেও সরকারি দলের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতারা ছাড়াও ১৪-দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু থাকবেন। অপরপক্ষে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের ১১ নেতা অংশ নেবেন। অন্যদের মধ্যে থাকছেন- বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ; জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও কেন্দ্রীয় নেতা এস এম আকরাম, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর।

আজকের সংলাপ সামনে রেখে গতকাল মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর মতিঝিলে ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে দীর্ঘ বৈঠক করেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। এর আগে বিএনপি নেতারা নিজেদের মধ্যে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৈঠক করেন। সেখান থেকে মির্জা ফখরুল, ড. মোশাররফ ও মওদুদ আহমদ যান ড. কামালের চেম্বারে। বৈঠকে আজকের সংলাপে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলে জানা গেছে, আজকের সংলাপেও ঐক্যফ্রন্ট প্রথমে তাদের সাত দফা দাবি পুনরুল্লেখ করবে। যার মধ্যে রয়েছে- খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি, সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, সংসদ ভেঙে দেয়া, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা, নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন, ‘গায়েবী মামলা’সহ হয়রানিমূলক সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দেয়া, বিরোধী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে আর কোনো মামলা না দেয়া এবং কাউকে গ্রেপ্তার না করা।

১ নভেম্বর প্রথম দফা সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের অভিযোগের প্রেক্ষিতে নতুন করে কাউকে গ্রেপ্তার না করার বিষয়টি দেখা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন বলে সংলাপ শেষে দাবি করেছিলেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। জানা গেছে, আজকের সংলাপে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে ফ্রন্টের পক্ষ থেকে বলা হবে- প্রথমদিনের সংলাপের পরেও সারাদেশে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে; গত কয়েকদিনেই শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দাবি করবেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। বিএনপি মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায়ও এখনও বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। জনসভায় ফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘এবার মুখের কথায় চলবে না, লিখিত অঙ্গীকার করতে হবে, গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে।’

প্রথমবারের সংলাপে মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেছিলেন, গত এক মাসেই ৬ হাজারের বেশি গায়েবী মামলা হয়েছে, যাতে লক্ষাধিক নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন- এরকম কিছু ঘটে থাকলে তালিকা দিন, আমরা দেখবো। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সেই আশ্বাস অনুযায়ী আজকের সংলাপে মামলা ও আসামির বিষয়ে লিখিত তথ্য দেবেন মির্জা ফখরুল।

ঐক্যফ্রন্ট সূত্রে জানা গেছে, আজকের সংলাপে সরকারপক্ষ কোনো অবস্থাতেই সংবিধানের বাইরে যেতে রাজি না হলে সেক্ষেত্রে সংবিধানসম্মত বিকল্প প্রস্তাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে গণভবনে যাচ্ছেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। সরকারপক্ষ থেকে যদি বলা হয়, আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী অনির্বাচিত নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও সংসদ বাতিলের সুযোগ নেই। তখন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলবেন, আপিল বিভাগের ওই একই রায়েই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ৪২দিন আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার কথা রয়েছে। একই রায়ে সংসদ চাইলে বিচারপতিদের বাদ দিয়ে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে পারারও সুযোগ রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে জরুরিভিত্তিতে সংসদের অধিবেশন ডেকে এই দুটি সংশোধনী আনার দাবি তুলবে ঐক্যফ্রন্ট।

সংবিধানসম্মত বিকল্প প্রস্তাবনা তৈরীর জন্য ইতোমধ্যে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও শেখ বোরহান উদ্দীনের সঙ্গে পরামর্শসভা করেছে ঐক্যফ্রন্ট। এই তিন সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞ ইতোমধ্যে একটি প্রস্তাবনা তৈরী করে ড. কামাল হোসেনকে দিয়েছেন। এই প্রস্তাবে তারা বলেছেন, প্রয়োজনে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই সংবিধানসম্মতভাবে সমস্যার সমাধান সম্ভব। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সময়ে ছোট একটি মন্ত্রিসভা থাকবে। আর সংবিধান অনুযায়ীই নির্দিষ্ট হারে ঐক্যফ্রন্টের প্রস্তাব থেকে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী করা হবে। যারা টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হবেন তাদেরকে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে।

ঐক্যফ্রন্ট নেতারা জানান, এই বিকল্প প্রস্তাবটি দেওয়ার ক্ষেত্রেও সরকারকে তিনটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হবে। এগুলো হচ্ছে- সংসদ ভেঙে দেওয়া, বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সিইসি নিয়োগ, নতুন করে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার না করা এবং গ্রেপ্তারকৃতদের জামিনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের বিরোধিতা না করা।

এদিকে, নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে চারজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীকে গতকাল বাদ দেয়া হয়েছে। যা আজকের সংলাপের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করছে। কারণ ঐক্যফ্রন্টের সাংবিধানিক বিকল্প প্রস্তাবে ফ্রন্ট প্রস্তাবিত নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী করার কথা বলার প্রস্তুতি রয়েছে। জানা গেছে, আজকের সংলাপে এবিষয়ে যদি সরকারপক্ষ বলে-আদালতের রায় অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সময়ে মন্ত্রিসভায় কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তির থাকার সুযোগ নেই। তাহলে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে বলা হবে, টেকনোক্র্যাট আর অনির্বাচিত এক জিনিস নয়। সরকার থাকবে নির্বাচিত, সেখানে সংবিধান অনুযায়ীই নির্দিষ্ট হারে কয়েকজন টেকনোক্রাট মন্ত্রী থাকতে পারেন; সংবিধান এটা অনুমোদন করে।

জানা গেছে, সংবিধানসম্মত এই বিকল্প প্রস্তাবের কথা আজকের সংলাপে ড. কামালের লিখিত বক্তব্যে থাকতে পারে। তবে এই বিকল্প প্রস্তাবে শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছে বিএনপি।

প্রসঙ্গত, ১ নভেম্বরের সংলাপে লিখিত বক্তব্যেও ড. কামাল প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনি সংবিধানসম্মত সমাধানে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু এটাও আপনার অজানা নয় যে, কোনো বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের দরকার পড়লে তা নিয়ে আলোচনা করাও সংবিধানসম্মত। কারণ সংবিধান সংশোধনের বিধান সংবিধানেরই অংশ। তবে বিরাজমান পরিস্থিতিতে সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে সংবিধানসম্মত একাধিক পথ খোলা আছে বলে আমরা মনে করি। আমরা আমাদের সাত দফার পাশাপাশি ১৩তম সংশোধনী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের আলোকে, বিশেষ করে দশম ও একাদশ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করা, নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি ছোট মন্ত্রিসভা গঠনসহ বিভিন্ন নির্দেশনা, ২০১৩ সালে বিরোধী দলকে নির্বাচনী মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানে আপনার প্রস্তাবের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।’

ওই বক্তব্যে ড. কামাল আরও বলেছিলেন, ‘সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদের খ উপদফায় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার বিধান রয়েছে। সুতরাং সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা সংবিধানসম্মত এবং তা ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের সংসদীয় রীতি মেনে চলা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অনুশীলনের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ। বাংলাদেশেও ২০১৪ সালের নির্বাচনটি ব্যতিরেকে এর আগের নয়টি সংসদ নির্বাচন সংসদ ভেঙে দেওয়া অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে গণপরিষদ ভেঙে দিয়েই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়।’

ঐক্যফ্রন্টের একাধিক নেতা গতকাল রাতে জানান, আজকের সংলাপে তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার অ্যাক্ট স্থগিত রাখার দাবি জানাবেন। একইসঙ্গে টেলিফোনে আড়িপাতা বন্ধের কথাও বলবেন। প্যারোলে নয়-জামিনে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি করবেন। এছাড়া বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার বন্ধ করার ওপর জোর গুরুত্ব দেবেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা।

ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে তফসিলের তারিখ পেছানোর জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে সিইসি নুরুল হুদার বক্তব্য, সংলাপ নিয়ে আগামীকাল প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন এবং শুক্রবার থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিতরণের তারিখ নির্ধারিত হওয়ায় অনেকেই মনে করছেন, তফসিল পেছানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যার কারণে ফলাফল যাই হোক, আজই পর্দা নামতে পারে সংলাপের।