জাতীয়

ভোটের উৎসব সব দলে

By daily satkhira

November 13, 2018

দেশের খবর: বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, বিকল্পধারাসহ বিভিন্ন দলের দাবির মুখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের তারিখ এক সপ্তাহ পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। সোমবার দুপুরে এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা জানিয়েছেন, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ২৮ নভেম্বর। আর ভোটগ্রহণের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর। তবে ওই সময় মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের তারিখ জানাননি তিনি। পরে সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে পুনর্নির্ধারিত সময়সূচি প্রকাশ করা হয়। পুনর্নির্ধারিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৩০ ডিসেম্বর ভোট অনুষ্ঠিত হবে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা যাবে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তফসিল পুনর্নির্ধারণের ফলে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী জোট গঠন করার জন্য নতুন করে তিন দিন সময় পেল।

বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলোর দাবি ছিল অবশ্য নির্বাচন এক মাস পেছানোর। তবে যেটুকু পিছিয়েছে তাতেই বিএনপি শিবিরেও দেখা দিয়েছে ভোটের আমেজ। দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের আমেজ দেখা দিল ১০ বছর পর।

গত শুক্রবার আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের ফরম বিতরণ শুরু করার পর থেকে ধানমণ্ডি এলাকায় যানজট লেগে থাকছে প্রতিদিনই। গতকাল বিএনপির মনোনয়ন ফরম বিক্রির কার্যক্রম শুরু হওয়ায় নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আশপাশের সড়কেও দেখা দিয়েছে যানজট। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা সকাল থেকে দল বেঁধে ভিড় করতে শুরু করেন নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে। এতে সেখানে অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে।

বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়া সোমবার ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ অন্যান্য দলকে নিয়ে সমন্বয় ও আলোচনা করে আসন বণ্টনের নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষেও তিনি নিজের মত জানিয়েছেন। বিএনপির চার নেতা গতকাল খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ মত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে থাকতে হবে এবং নির্বাচনও করতে হবে। তিনি আরো বলেন, যত বেশি সম্ভব বিদেশি পর্যবেক্ষক নির্বাচনের সময় আনতে হবে। আইনজীবী বা অন্য কোনো মাধ্যমে মনোনয়নপত্রে আজ খালেদা জিয়ার সই নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

সারা দেশে ৩০০টি সংসদীয় আসনের প্রতিটিতেই বড় দুই দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী বেশি। প্রথম তিন দিনেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন তিন হাজার জনের বেশি নেতা। গতকাল প্রথম দিনেই সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এক হাজার ১৯৮টি ফরম বিক্রি করেছে বিএনপি। ওই কার্যক্রম চলে রাত ৮টা পর্যন্ত।

দুই দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী বেশির ভাগ নেতাই নিজের শক্তি দেখাতে মিছিল নিয়ে যাচ্ছেন দলীয় কার্যালয়ে। অনেকের মিছিলে থাকছে মোটরসাইকেল ও গাড়ির বহর। সোমবার দুপুর ১টায় ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম জমা দিতে যান বর্তমান

এক সংসদ সদস্য মোটরসাইকেলের বহরের পাশাপাশি বাস, পিকআপ ও ট্রাকে করে বিশাল মিছিল নিয়ে যান তিনি। ওই সময় মোহাম্মদপুর থেকে জিগাতলার দিকে যাওয়া সব যানবাহনকে থেমে থেমে মিছিলের পেছন পেছন যেতে হচ্ছিল। এর আগেও ছিল অন্য প্রার্থীদের এমন মিছিল। দুপুর সোয়া ২টার দিকে ওই কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম জমা দিতে যান ঢাকা-৭ আসনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী হাসিবুর রহমান মানিক। তাঁর গাড়িবহর এলিফ্যান্ট রোড থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় হয়ে জিগাতলার দিকে যাওয়ার সময় মিরপুর রোডে দুই দিকের যান চলাচল কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে। ধানমণ্ডি এলাকায় যানজট সামলাতে হিমশিম খেতে দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের।

নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ে দীর্ঘদিন ছিল না তেমন কোনো কর্মসূচি ও নেতাকর্মীদের আনাগোনা। মাঝেমধ্যে দলটির পক্ষে শুধু সংবাদ সম্মেলন করা হতো। কিন্তু সোমবার চিত্র ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। দলটির কার্যালয় ও সামনের চত্বর উপচে পড়ছিল দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ঘিরে সারা দেশ থেকে আসা হাজার হাজার নেতাকর্মীর ভিড়ে। দলটির কার্যালয় ঘিরে ছিল না পুলিশের কোনো তৎপরতা। সারা দেশ থেকে আসা নেতাকর্মীদের মাঝে ছিল না কোনো গ্রেপ্তার আতঙ্ক।

বিএনপি কার্যালয়ের উল্টো দিকের পানের দোকানি রফিক মিয়া বলেন, ‘প্রায় এক যুগ ধরে আমি এখানে এই দোকান চালাই। কয়েক বছর ধরে দেখছি এই কার্যালয় পুলিশ প্রায় সময়ই ঘেরাও করে রেখেছে। পরিত্যক্ত অফিসের মতো ছিল ভবনটি। কোনো দলের কার্যালয় নাকি অন্য কিছু, তা বোঝার উপায় ছিল না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। আজ সকাল ৭টায় দোকান চালু করার পর দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার টাকার পান বিক্রি করতে পেরেছি। আরো বিক্রি হবে।’

খালেদা জিয়ার জন্য তিনটি আসনে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ট্রেনে উঠল বিএনপি।

সিইসির বক্তব্য: রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সোমবার দুপুরে ইভিএম প্রদর্শনীর মেলা উদ্বোধনকালে সিইসি কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘গতকাল (রবিবার) অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনে এসে ভোটে অংশগ্রহণ করবে বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ সিইসি বলেন, ‘বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট, বিকল্পধারাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এটা অত্যন্ত স্বস্তির বিষয়। আমরা তাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ আমাদের বিশ্বাস ছিল, সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। সেই আলোকে নির্বাচন কমিশন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল পুনরায় নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’

কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘গতকালের আগ পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। আজ (সোমবার) সকালে আমরা বসেছিলাম সিদ্ধান্ত নিতে। সেখানেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’

ইসির প্রজ্ঞাপন: পরে সন্ধ্যায় ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে পুনর্নির্ধারিত তফসিল প্রকাশ করা হয়। এই তফসিল অনুসারে আগামী ২৩ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট অনুষ্ঠিত হবে। রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা যাবে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, তফসিল পুনর্নির্ধারণের ফলে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী জোট গঠন করার জন্য নতুন করে তিন দিন সময় পেল। এর আগে গত রবিবার ছিল অভিন্ন প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নির্বাচনী জোট গড়ার শেষ দিন। কয়েকটি রাজনৈতিক দল বা জোট নির্বাচন পিছিয়ে দিতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করলেও নির্বাচনী জোট গড়ার জন্য সময় বাড়ানোর আবেদন করেনি।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ক্ষোভ: এদিকে নির্বাচনী তফসিল পুনর্নির্ধারণে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ ও যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। গত রবিবার বিকেলে নির্বাচনের তফসিল এক মাস পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে সিইসিকে চিঠি দিয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিব ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সিইসির কাছে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সই করা এক চিঠিতে নির্বাচন সাত দিন পেছানোর দাবি জানায় যুক্তফ্রন্ট। একইভাবে গত শনিবার বাম গণতান্ত্রিক জোটও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে পুনরায় তফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছিল। আর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, রাজনৈতিক জোটগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন ভোটের তারিখ পিছিয়ে দিলে তাতে তাদের আপত্তি থাকবে না। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন তফসিল পুনর্নির্ধারণ করে নির্বাচনের জন্য নতুন যে তারিখ ঘোষণা করেছে, তাতে যুক্তফ্রন্টের দাবি শতভাগ পূরণ হয়েছে।

গত ৮ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিলেন সিইসি। ওই তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৩ ডিসেম্বর ভোট হওয়ার কথা ছিল।

বিদেশি পর্যবেক্ষক আনার নির্দেশনা খালেদার: বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ চার নেতা সোমবার দুপুরে কারাগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অন্য তিনজন হলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও মির্জা আব্বাস। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘ম্যাডাম আমাদের জন্য দোয়া করেছেন। তিনি আশা করছেন, জনগণের যে ঐক্য আমরা তৈরি করেছি, সেই ঐক্যের মধ্য দিয়ে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব।’ ফখরুল বলেন, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। তাঁর শারীরিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অবিলম্বে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানান ফখরুল।

একটি সূত্রে জানা যায়, সাক্ষাৎকালে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, যত বেশি সম্ভব বিদেশি পর্যবেক্ষক আনতে হবে নির্বাচনের সময়। ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের মনোভাব ইতিবাচক। আসন বণ্টন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি তো আমরা নিজেরা বসে ঠিক করব।’ কারাগারে খালেদার সঙ্গে দলের নেতারা দেড় ঘণ্টা কথা বলেন। একটি সূত্রের মতে, দলীয় ও শরিকদের আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনা উঠলে খালেদা জিয়া সংশ্লিষ্ট দলগুলোর সবাইকে নিয়ে এটি সমন্বয় করতে বলেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ম্যাডাম অসুস্থ, অত্যন্ত অসুস্থ এবং উনার চিকিৎসা এখনো ঠিকমতো হচ্ছে না। পিজি হাসপাতালে রেখে ডাক্তাররা চিকিৎসা করার জন্য যে পরামর্শ দিয়েছিল, কর্তৃপক্ষ সেই পরামর্শ গ্রাহ্য করেনি। হঠাৎ করেই তাঁকে কারাগারে নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা তখনই বলেছি এটা অমানবিক। অবিলম্বে তাঁকে আবারও পিজি হাসপাতালে নিয়ে তাঁর চিকিৎসার সুব্যবস্থা করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘আইনের মধ্যে কোথাও নেই, যিনি চলতে পারেন না, অসুস্থ তাকে হুইলচেয়ারে করে আদালতে হাজির করতে হবে এবং আবার কারাগারে নিয়ে আসতে হবে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। চার দিন ধরে তাঁকে থেরাপি দেওয়া হয়নি। আজকে বোধ হয় থেরাপিস্ট যাচ্ছেন। ফলে ম্যাডামের ব্যথা আরো বেড়ে গেছে।’

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সোমবারই প্রথমবারের মতো দলটির নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরেছেন।

রিটার্নিং অফিসারদের দিনব্যাপী ব্রিফিং আজ: এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিয়োগকৃত রিটার্নিং অফিসারদের (মূলত জেলা প্রশাসক) আজ মঙ্গলবার সার্বিক বিষয়ে ব্রিফ করবেন সিইসি। সকাল ১০টায় ইসির অডিটরিয়ামে দিনব্যাপী এ ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হবে। এতে রিটার্নিং অফিসারদের দিকনির্দেশনা দেবেন সিইসিসহ অন্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিব।