দেশের খবর: আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এমপি হতে চান ১২ হাজারের বেশি নেতা। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে রয়েছেন তারা। এ প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণরা অবতীর্ণ হবেন ৩০ ডিসেম্বরের ভোটযুদ্ধে। তাদের বড় অংশই শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে যেতে পারবেন না। তবে অতীতের কোনো নির্বাচনেই এত মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন না। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বলছেন, দেশ ও জনগণের সেবা করতেই এমপি হতে চান তারা। তবে রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা বলছেন, ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রবেশের জন্যই এই ইঁদুর দৌড়। এ দেশে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা কারোরই অজানা নয়। এমপি হয়ে তারা এই সুবিধা ভোগ করতে চান। তাই রাজনীতির মাঠে বিচরণ না করা আমলা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চিকিৎসক, অভিনেতা, খেলোয়াড়রাও শামিল হয়েছেন দলীয় মনোনয়ন জেতার দৌড়ে।
গত ২৮ বছরে চারটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা তিন হাজার ছাড়ায়নি। ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ভোট করেন ২ হাজার ৭৮৭ জন। ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে প্রার্থী ছিলেন ২ হাজার ৫৭২ জন। ২০০১ সালে অষ্টম সংসদে ভোটে দাঁড়ান ১ হাজার ৯৩৯ জন। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা চালুর পর ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৬৭ জনে।
এবার ৩০০ আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ১১ হাজার ২১টি! সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে বিএনপি। দলটির পাঁচ হাজার টাকা দামের মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে চার হাজার ৫৮০টি। জমা দিতে লাগবে আরও ২৫ হাজার টাকা। আসনপ্রতি বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ১৫ জনের বেশি।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমের দাম ৩০ হাজার টাকা। ফরম কিনেছেন চার হাজার ২৩ জন। প্রতি আসনে দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী ১৩ জনের বেশি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির (জাপা) ২৫ হাজার টাকার মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৪১৮টি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ৬৩ আসনে ভোট করে ৬১টিতে জামানত হারানো বিকল্পধারার শনিবার পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ১২৫টি। দলটি ২০০৪ সালে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনে জিতেছিল। এরপর কখনই কোনো নির্বাচনে জিততে পারেনি দলটি।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক জেএসডি ও গণফোরামের মনোনয়ন ফরম বিক্রিতেও এবার দারুণ কাটতি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৪৫টি আসনে ভোট করে একটি বাদে সবক’টিতে দলটির প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। এবার তাদের মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৪৬৫টি। দলটি ১৩২টি আসনে প্রার্থী বাছাই করেছে।
গণফোরামের মনোনয়ন চেয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া। গণফোরাম কখনই কোনো আসনে জিততে পারেনি। জেএসডি সংসদে শেষবার আসন পেয়েছিল ২২ বছর আগে, ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক এলডিপি ২০০৮ সালে একটি আসনে জয়ী হয়েছিল। এবার তাদের মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৫৫টি।
ক্ষমতাসীন জোটের শরিক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা ২৬৩। ১৪ দলের শরিক সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন শতাধিক। সেখান থেকে ৩২ জনকে বাছাই করেছে দলটি।
ধর্মভিত্তিক দল মনোনয়ন ফরম বিক্রি করছে না। দলীয় ফোরামে আলাপ আলোচনায় প্রার্থী ঠিক করছে। চরমোনাইয়ের পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। তারাই দলের মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন।
ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী তালিকায় আগ্রহীর সংখ্যা ৩৫। বিএনপি জোটের শরিক বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ ২০, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ২৫ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। জাপার জোটের শরিক খেলাফত মজলিশ ৩০ আসনে ও ইসলামী ফ্রন্ট ৭৩ আসনে প্রার্থী বাছাই করেছে। নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামীর নেতারা স্বতন্ত্র পরিচয়ে ভোটে অংশ নিচ্ছেন। দলটির নেতারা ৬১টি আসনে মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
বামপন্থি দলগুলোর জোটে বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক সিপিবির মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৬৫টি। বাসদেরও বিক্রি হয়েছে এ সংখ্যার কাছাকাছি।
রাজনৈতিক বিশ্নেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ভোটের রাজনীতিতে ব্যক্তির চেয়ে প্রতীকের পরিচয় বড়। তাই রাজনীতিতে নামতে ইচ্ছুকরা পরিচিত প্রতীকের পেছনে ছুটছেন। তারা হয়ত ধারণা করেন বড় দলের মনোনয়ন পেলেই জয় প্রায় নিশ্চিত, তাই এই প্রতিযোগিতা। এ কারণেই আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাপার সাড়ে ১১ হাজার মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে।
নিবন্ধিত ৩৯ দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা এবার ১২ হাজার ছাড়িয়েছে। মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে আওয়ামী লীগের কোষাগারে এসেছে ১২ কোটি টাকার বেশি। বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন ৫২ জন। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রার্থীর আধিক্যে উষ্ফ্মা প্রকাশ করেছেন।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অবশ্য দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীর ছড়াছড়িকে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বলেছেন। তিনি বলেছেন, দলীয় নেতৃত্বই মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ উন্মুক্ত করেছেন।
১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীর বড় অংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা দলীয় কর্মসূচিতে থাকেন না। আন্দোলনের কর্মসূচিতে তাদের দেখা মেলে না। কিন্তু ভোটের মৌসুমে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০ দলের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান বলেন, সাড়ে চার হাজার মনোনয়ন ফরম বিক্রিকে তারা ইতিবাচক মনে করছেন। তার মতে, স্বৈরশাসনের অবসানে ভোটের উৎসবে শামিল হয়েছেন দলের নেতাকর্মীরা। সাড়ে পাঁচ হাজার ফরম বিক্রিকে বিএনপির জনপ্রিয়তার প্রমাণ বলেও মনে করেন তিনি।
এবারের মনোনয়ন দৌড়ে একই ব্যক্তির দুটি ভিন্ন দলের মনোনয়ন ফরম কেনার ঘটনাও ঘটেছে। ওয়ান-ইলেভেনের আলোচিত সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী গত ১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। তিন দিন পর কেনেন জাপার মনোনয়ন ফরম। পরের দিন পেয়ে যান জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ।
কখনও দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ এবং এম এম কাউয়ুম, সাবেক স্বাস্থ্য সচিব এম এম নিয়াজউদ্দিন মিয়াসহ অন্তত ৫০ আমলা। পেশাজীবী রাজনীতিতে যুক্তরা আছেন এ দৌড়ে। প্রায় সকল ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারাও আছেন মনোনয়ন দৌড়ে।
কখনও রাজনীতিতে না থাকলেও বাংলাদেশে ওয়ান ডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। বিএনপির মনোনয়ন চান জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক। লাঙল চেয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পরিচিতি পাওয়া আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নীতিহীন রাজনীতির নিকৃষ্ট উদাহরণ ১২ হাজার মানুষের এমপি হতে চাওয়া। একদল থেকে আরেক দলে যাচ্ছে শুধু মনোনয়ন নিশ্চিত করতে। কারণ এমপি হতে পারলেই অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার সুযোগ অবারিত।