জাতীয়

মৃত্যুফাঁদ থেকে সাবধান

By daily satkhira

November 19, 2018

অনলাইন ডেস্ক: রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সড়কের আশপাশে এবং বাসাবাড়িতে গ্যাস পাইপলাইন ছিদ্র ও চুলার সংযোগ থেকে বের হওয়া গ্যাসে প্রায়ই ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার থেকেও ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে প্রাণ হারাতে হচ্ছে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষকে। আগুনে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসতে হচ্ছে অনেককে। আবার কারও কারও পুরো পরিবার চলে যাচ্ছে না ফেরার দেশে।

দু-একজন আবার দগ্ধ হয়ে দুর্বিষহ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকেন। সর্বশেষ গত শুক্রবার যাত্রাবাড়ীতে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার থেকে লিকেজ হওয়া গ্যাসে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ম্ফোরণের ঘটনায় এক শিশুসহ দু’জনের করুণ মৃত্যু হয়েছে। একই ঘটনায় দগ্ধ হয়েছে আরও পাঁচজন। তাদের মধ্যে চারজন একই পরিবারের। এর আগে ২ নভেম্বর গ্যাসের আগুনে আশুলিয়ায় একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে গ্যাসের আগুনের কারণে এমন মর্মন্তুদ দুর্ঘটনার দায় নিচ্ছে না কেউ। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা যন্ত্রণাকাতর জীবনের দায়ভার বয়ে বেড়াচ্ছেন।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে গ্যাস দুর্ঘটনায় ১০৩টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে গ্যাসলাইন লিকেজে ৫৫টি এবং এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে ৪৮টি। এতে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে শিশুসহ ছয়জন এবং গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে ৩১ জনকে। অবশ্য চিকিৎসাধীন অবস্থায় যেসব দগ্ধ হাসপাতালে মারা যায়, তাদের হিসাব ফায়ার সার্ভিস রাখে না। সে কারণেই মৃত্যুর সংখ্যা পাওয়া যায়নি তাদের কাছ থেকে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসেই গ্যাসের লিকেজ এবং এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ম্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে সাতজনের। প্রায়ই এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডে নতুন নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে হতাহতের তালিকায়। গ্যাসলাইন লিকেজ, গ্যাস সিলিন্ডার ও সিলিন্ডারের হোসপাইপ লিকেজ থেকে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড বেশি ঘটছে। প্রশ্ন উঠেছে এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের মান নিয়েও।

গত শুক্রবার সকালে যাত্রাবাড়ীর ধলপুর এলাকায় ১৪ নম্বর আউটফল সিটি করপোরেশনের কোয়ার্টারে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন পরিচ্ছন্নকর্মী সুমন মিয়া। এ সময় সিলিন্ডারের গ্যাস লিকেজ হয়ে বিস্ম্ফোরণ ঘটে। আগুন ছড়িয়ে পড়ে ঘরের ভেতর। তার পরিবারের চারজনসহ মোট ছয়জন দগ্ধ হয়। বিস্ম্ফোরণে ঘরের দরজা খুলে ছিটকে পড়ে দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা আট বছরের শিশু তাহসিনের ওপর। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয় দগ্ধদের। গতকাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়।

ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ধলপুরের ওই বাসার এলপিজি সিলিন্ডার লিকেজ হয়ে গ্যাস বের হয় এবং তা পুরো ঘরে জমে যায়। পরে এতে আগুনের স্পর্শ পেয়ে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ম্ফোরণ ঘটে।’

গত ২ নভেম্বর ভোরে আশুলিয়ায় আবদুর রবের বাসায় গ্যাসের পাইপলাইনে বিস্টেম্ফারণের পর লাগা আগুনে দগ্ধ হয়েছিলেন আবদুর রবসহ তার পরিবারের পাঁচ সদস্য। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল তাদের সবাইকে। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় চারজনের। স্বামী-সন্তান ও শ্বশুর-শাশুড়ি হারিয়ে শুধু বেঁচে আছেন রবের স্ত্রী গার্মেন্ট কর্মী রিপা আক্তার।

৬ নভেম্বর মোহাম্মদপুরের একটি বাসায় সিলিন্ডারের গ্যাস বের হয়ে বিস্ম্ফোরণের পর লাগা আগুনে দগ্ধ হয়ে সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। একই ঘটনায় তার স্ত্রী সাজেনা আখতার দগ্ধ হয়ে ভর্তি হন বার্ন ইউনিটে। ১৩ অক্টোবর উত্তরখানের বাসায় গ্যাসের চুলার আগুনে দগ্ধ হয়ে স্বামী-স্ত্রীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪০-৪৫ বছরের বেশি সময়ের পুরনো গ্যাস বিতরণ লাইন রয়েছে ঢাকায়। এসব গ্যাসলাইনের ব্যাপারে তেমন তদারকি নেই তিতাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির। গ্যাসলাইনে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করা এবং বাড়ির মালিক ও ভাড়াটেদের অসাবধানতা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া বাসাবাড়িতে সঠিকভাবে গ্যাসলাইন সংযোগ, এলপিজি সিলিন্ডার এবং চুলার ফিটিংস সঠিকভাবে না হওয়ার কারণেও অগ্নিকাণ্ড ঘটছে।

তিতাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মোস্তফা কামাল বলেন, ‘গ্যাসের পাইপলাইনের দুর্ঘটনা যে খুব বেশি ঘটেছে, তা ঠিক নয়। এটি বিভিন্ন সময়ে হয়ে আসছে। অনেক জায়গায় গ্যাসের অবৈধ সংযোগ রয়েছে। তিতাস জানতে পারলে এসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারপরও অজ্ঞাতসারে অনেকেই অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করছে। যেখানে তিতাসের নেটওয়ার্কই নেই। অনিরাপদ এসব গ্যাস সংযোগ থেকেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। এ জন্য জনগণকেও সচেতন হতে হবে।’ পুরনো লাইনের রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিতাসের নেটওয়ার্ক অনেক বড়। তাই চাইলেই পুরনো সব লাইন একবারেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এলাকা ধরে পুরনো লাইনগুলো বদলানো হচ্ছে।’

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘গ্যাস পাইপ কিংবা সিলিন্ডার লিকেজ থেকে গ্যাস বের হলে শব্দ এবং পচা ডিমের মতো দুর্গন্ধ ছড়াবে। এ ধরনের গন্ধ পাওয়ামাত্র জানালা দরজা খুলে গ্যাস বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষ একটু সচেতন হলে আগুন থেকে অনেকটাই পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। ঢাকায় অনেক পুরনো গ্যাসের লাইন আছে। সেগুলো দ্রুত তিতাসকে বদলাতে হবে।’ এ ছাড়া এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘সিলিন্ডার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু তা করা হয় না। সংশ্নিষ্টদের এ ব্যাপারে নজরদারি বাড়ানো দরকার।’

বিস্ম্ফোরক অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম বলেন, ‘এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ম্ফোরক অধিদপ্তর থেকে পরীক্ষা করা হয় না। এলপি গ্যাস বিক্রয় কোম্পানি এগুলো পরীক্ষা করে এবং অধিদপ্তর সেটি তদারকি করে।’ মানসম্মতভাবেই এসব সিলিন্ডার তৈরি করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সিলিন্ডার সাধারণত বিস্ম্ফোরিত হয় না। সিলিন্ডারের রেগুলেটরের সঙ্গে চুলার সংযোগস্থলে ভালোভাবে ফিটিং না করার কারণে গ্যাস লিকেজ হয়ে গ্যাস জমে থাকে। এর পরই চুলা জ্বালাতে গিয়ে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ম্ফোরণ ঘটে। সিলিন্ডার ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। দেশে কমপক্ষে ৫০ লাখ গ্রাহক। দেড় কোটির বেশি সিলিন্ডার রয়েছে দেশে।’

ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. হাসান মোহাম্মদ মোস্তফা আফরোজ বলেন, ‘পাঁচ বছর পরপর সিলিন্ডার পরীক্ষা করা উচিত এবং সিলিন্ডারের গায়ে পরীক্ষা করার তারিখ খোদাই করে রাখতে হবে। কিন্তু এ ধরনের কোনো তারিখ সিলিন্ডারের গায়ে থাকে না। সিলিন্ডার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরীক্ষা না করলে ঝুঁকি থেকে যায়।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল বলেন, ‘গ্যাসের আগুন খুবই বিপজ্জনক। কারণ বিস্ম্ফোরণ ঘটে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং এ ধরনের ঘটনায় একই পরিবারের একাধিক সদস্য দগ্ধ হয়। গ্যাসের আগুনে ক্ষতি বেশি হয়। সম্প্রতি গ্যাসের আগুনে পোড়া রোগী হাসপাতালে বেশি আসছে।’