অনলাইন ডেস্ক: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ধ্বংসযজ্ঞ, মানবচর্মের গহীনে নিহিত এক হিংস্র দানবসত্ত্বার উপস্থিতির নিদর্শন। ১৯১৪ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে এই ধ্বংসলীলা চলে ১৯১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। চার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধে, আন্দাজ করা হয় ১,৫০০ দিন ধরে প্রতিদিন ৬,০০০ মানুষ নিহত হয়। কমপক্ষে ৭৪ মিলিয়ন সৈন্য এই যুদ্ধে অংশ নেয়। মিত্রশক্তির ১৮ মিলিয়ন সৈন্য এই যুদ্ধে প্রাণ হারায়। কেন্দ্রীয় শক্তির মারা যায় প্রায় ১২ মিলিয়ন সৈন্য। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন বিশাল সংখ্যক মানুষ। এই মহাযুদ্ধের করালগ্রাসে বদলে যায় ইউরোপের নকশা, বদলে যায় পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস। কীভাবে এই তাণ্ডবলীলা শুরু হয়েছিল, তা একবার পেছন ফিরে দেখা যাক।
বসনিয়া সঙ্কট ১৮৭৮ সালে বার্লিন সম্মেলন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে (অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য) বসনিয়া ও হার্জগোভিনা ভোগ দখলের অধিকার দিয়েছিল। তারপরেও অঞ্চল দুটি তুরস্ক সাম্রাজ্যের আংশিক নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিশ শতকের গোড়ার দিকে নব্য তুর্কি আন্দোলনের সূচনা হলে তুরস্ক সাম্রাজ্যের সংকট তীব্র হয়। এই আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে ১৯০৮ সালে অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যারেন্থাল উক্ত প্রদেশ দুটিকে সরাসরি দখল করে নেওয়ার ঘোষণা দেন। রাশিয়া এর তীব্র বিরোধিতা করে। কারণ বসফরাস ও দার্দানালিস প্রণালীর কারণে রাশিয়া এই এলাকার উপর নির্ভরশীল ছিল। একইসাথে সার্বিয়াও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে, কারণ বিপুল সংখ্যক স্লাভ জাতিভুক্ত মানুষ বসনিয়া ও হার্জগোভিনাতে বসবাস করতো। অস্ট্রিয়া কর্তৃক অধিকৃত হলে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যের প্রজায় পরিণত হতো।
রাশিয়ার সমর্থন পেয়ে সার্বিয়া সামরিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ত্রিশক্তি মৈত্রী চুক্তির অন্যতম মিত্রদেশ ইতালিও অস্ট্রিয়ার পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ হয়। কারণ অ্যাড্রিয়াটিক উপকূলে ইতালির স্বার্থ জড়িত ছিল। তবে জার্মানির কাছ থেকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরি পূর্ণ সমর্থন পায়। এই সংকটের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিল অনেক গভীর। রাশিয়া বুঝেছিল, জার্মানি তার শক্তিশালী শত্রুতে পরিণত হয়েছে। তাই সে ব্রিটেনের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। জার্মানির শক্তিশালী নৌবহর ব্রিটেনের জন্যেও আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই ব্রিটেন ফ্রান্সের সাথে মিত্রতার বন্ধন সুদৃঢ় করতে প্রয়াসী হয়। এদিকে অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যেও তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হয়।
মরক্কো সংকট ১৯০৫ সালের পর থেকে মরক্কোতে ফরাসি প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ১৯১১ সালে একটি বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে ফ্রান্স মরক্কোর রাজধানী ফেজ দখল করতে সেনা পাঠায়। জার্মানি এতে বাধা দেয়। তারা প্যান্থার নামে একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠায় ও দাবি করে যে নিরাপত্তার অজুহাতে ফ্রান্স মরক্কো দখল করলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সমগ্র ফরাসি কঙ্গো জার্মানির হাতে তুলে দিতে হবে। ব্রিটেনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান দাপট আর নিজ দেশের আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের ঢেউ ফ্রান্সকে সাহসী করে তুলেছিল। তারা জার্মানির দাবি প্রত্যাখ্যান করে। উত্তর আফ্রিকার উপকূলে একটি জার্মান বন্দরের অবস্থান ব্রিটেন মেনে নিতে চায়নি, তাই তারাও সরাসরি জার্মানির বিরোধিতা শুরু করে। সংঘাতপ্রবণ ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে অবশ্য ১৯১১ সালের ৪ নভেম্বর সমঝোতা হয়, কিন্তু এই মরক্কো সংকট ইউরোপের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে বৈরিতাকে তীব্রতর করে।
বলকান যুদ্ধ সেই দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক উত্তেজনার অন্যতম প্রধান উৎস হয়ে উঠেছিল অটোমান তুরস্ক সাম্রাজ্য। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার নিয়ন্ত্রক ছিল এই এই বিশাল অটোমান সাম্রাজ্য। ১৯১১ সালের শেষের দিকে লিবিয়াকে উপনিবেশে পরিণত করার লক্ষ্যে ইতালি লিবিয়া আক্রমণ করে, বেঁধে যায় ত্রিপোলির যুদ্ধ। অটোমান সাম্রাজ্য ইতালিকে বাধা দিলেও শেষমেষ ইতালি জয়লাভ করে লিবিয়া দখল করে নেয়। এরই মধ্যে সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, বুলগেরিয়া ও গ্রিস বলকান লিগ গঠন করে। অটোমান শাসন থেকে মুক্ত হওয়াই তাদের লক্ষ্য ছিল। ১৯১০ সালে আলবেনিয়ার বিদ্রোহ দমনে তুর্কি শাসকের অসাফল্য ও ১৯১১ সালে ত্রিপোলির যুদ্ধে ইতালির বিরুদ্ধে তুরস্কের চরম ব্যর্থতা বলকান লিগকে সাহস যুগিয়েছিল।
১৯১২ সালের ৮ অক্টোবর মন্টিনিগ্রো তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সার্বিয়া, বুলগেরিয়া ও গ্রিসও অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। এভাবে শুরু হয় প্রথম বলকান যুদ্ধ। এই বলকান লিগ একমাসের মধ্যেই অটোমান সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করে। জয়ী বলকান রাজ্যগুলো তুরস্ক সাম্রাজ্যের বেশ কিছু অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। আয়তনে ছোট হয়ে যায় অটোমান সাম্রাজ্য। ইতোমধ্যে আলবেনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইউরোপের বৃহৎ শক্তিবর্গ স্বাধীন আলবেনিয়াকে স্বীকৃতি দেয়।
প্রথম বলকান যুদ্ধের ফলে বুলগেরিয়া বিশেষ লাভবান হতে পারেনি। মেসিডোনিয়ার বিশাল অঞ্চল লাভ করেছিল সার্বিয়া আর গ্রিস। হতাশ বুলগেরিয়া তাই সার্বিয়া ও গ্রিসে আক্রমণ করে বসে। শুরু হয় দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ। তুরস্ক ও রোমানিয়ার সাহায্যপুষ্ট গ্রিস ও সার্বিয়া ১৯১৩ সালে বুলগেরিয়াকে পরাজিত করে। বুখারেস্ট শান্তিচুক্তির শর্তানুযায়ী পরাজিত বুলগেরিয়া রোমানিয়াকে দোব্রুজা ও তুরস্ককে আড্রিয়ানোপোল ছেড়ে দেয়। ‘Europe Since 1870’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক জেমস জল বলেন, “বলকান রাজ্যগুলোর সাফল্য এবং এমনকি তাদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রমাণ করেছিল যে বহুজাতিক সাম্রাজ্যগুলোর দিন শেষ হতে চলেছে।”
১ম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ১৯১৪ সালে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যাকাণ্ড ইউরোপের রাজনীতিতে চূড়ান্ত সংকটের জন্ম দেয়। ফার্দিনান্দ ছিলেন হ্যাবসবার্গ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন ফার্দিনান্দ সামরিক বাহিনী পরিদর্শনের জন্য সস্ত্রীক বসনিয়ার রাজধানী সেরাজেভোতে আসেন। এই সময়ই সার্বিয়ান উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘দ্যা ব্ল্যাক হ্যান্ড’ এর সদস্য গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপ যুবরাজকে হত্যা করে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি তৎক্ষণাৎ অভিযোগ তোলে যে সার্বিয়া সরকারই এই হত্যাকাণ্ডের মদদদাতা। যদিও এর পেছনে সার্বিয়ান সরকারের মদদের কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবুও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি চাইলো এই সুযোগে সার্বিয়াকে শিক্ষা দিতে। ওদিকে জার্মানি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে নিশ্চিত করে যে ফ্রান্স ও রাশিয়া সার্বিয়ার সমর্থনে এগোলে জার্মানি তাদের ব্যবস্থা করবে।
১৯১৪ সালের ২৩ জুলাই অস্ট্রিয়ান রাষ্ট্রদূত সার্বিয়ান সরকারের কাছে এক দীর্ঘ চরমপত্র পাঠান। এতে দাবি করা হয়, সকল হ্যাবসবার্গবিরোধী প্রকাশনা সার্বিয়া সরকারকে নিষিদ্ধ করতে হবে, সকল সার্ব জাতীয়তাবাদী সংগঠনকে দমন করতে হবে, যে সকল সার্বিয়ান প্রশাসনিক ও সামরিক আধিকারিক সার্ব জাতীয়তাবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে ও তাদের নামের তালিকা অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সরকারকে পাঠাতে হবে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই চরমপত্রের উত্তর দেবার জন্যেও সার্বিয়াকে তাগাদা দেওয়া হয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব এডওয়ার্ড গ্রে মন্তব্য করেন, এই চরমপত্র ছিল একটি স্বাধীন দেশ কর্তৃক অন্য একটি স্বাধীন দেশকে পাঠানো সবচেয়ে ভয়ংকর একটি দলিল।
সার্বিয়ার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল, হয় অস্ট্রিয়ার চরমপত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে কূটনৈতিক পরাজয় স্বীকার করা, নয়তো সার্বিক ঝুঁকি নিয়ে অস্ট্রিয়াকে প্রতিরোধ করা। চরমপত্র পাঠানোর দু’দিন পরে ২৫ জুলাই রাশিয়ার সরকার তার সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়। ২৮ জুলাই অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদিকে জার্মানদের বারবার সতর্কীকরণের পরেও রাশিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। প্রতিরক্ষার নিমিত্তে ১ আগস্ট জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জার্মানি ফ্রান্সকেও সতর্ক করতে থাকে, কিন্তু ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ভিভিয়ানি জার্মানিকে জানিয়ে দেন, ফ্রান্স তার নিজের স্বার্থানুযায়ী পদক্ষেপ নেবে। কাজেই, ৩ আগস্ট জার্মানি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
এদিকে ব্রিটেন তখনও কোনো পক্ষ অবলম্বন করেনি। তারা শুধু জার্মানিকে সাবধান করে দেয় যে তারা যেন ইংলিশ চ্যানেলে ফ্রান্সের উপর নৌ-আক্রমণ না চালায় আর ফ্রান্সকে আক্রমণ করার জন্যে তারা যেন বেলজিয়ামের ভূখণ্ড ব্যবহার না করে। কিন্তু জার্মানি এই সতর্কীকরণ উপেক্ষা করলে ৪ আগস্ট ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পুরোদমে শুরু হয়ে যায় ১ম বিশ্বযুদ্ধ। রাজনৈতিক নেতারা তো বটেই, সাধারণ মানুষও যেন একে অপরকে ধ্বংসের এক উন্মত্ত আকাঙ্ক্ষায় মেতে ওঠে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন না করার সতর্কবাণী উপেক্ষা করে জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রকেও শত্রুতে পরিণত করে। ১৯১৭ সালে আমেরিকা ১ম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে নতুন মাত্রা পায় এই মহাযুদ্ধ। বর্ধিঞ্চু শক্তির সম্যক প্রদর্শন মানুষ মাত্রেরই স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। সেটিই বৃহৎ পরিসরে দেখিয়ে দেয় ১ম বিশ্বযুদ্ধ।
সুদূরপ্রসারী ফলাফল ১ম বিশ্বযুদ্ধের ফলে ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুরোপুরি বিনষ্ট হয়ে যায়। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইউরোপ জুড়ে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে। মহা শক্তিশালী অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। আরব রাষ্ট্রগুলো তুরস্কের অধীনতা ছেড়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। খোদ তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটে এবং তুরস্কে একটি প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়।
নিজের শক্তির বড়াই করে বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানো জার্মানিকে জবরদস্তি চাপিয়ে দেয়া হয় ভার্সাই চুক্তি। জার্মানি ইউরোপে ২৫,০০০ বর্গমাইল এলাকা হারায়, তার বাণিজ্য বন্দরগুলো বিজয়ী মিত্রশক্তিদের জন্য খুলে দেয়া হয়। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামকে বিশাল পরিমাণ কয়লা, রেল ইঞ্জিন ও মোটর গাড়ি দিতে হয় জার্মানিকে। সেই সাথে যুদ্ধাপরাধের দায় হিসেবে তার উপর চাপে ক্ষতিপূরণের বিশাল বোঝা। জার্মানিকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়ার সকল ব্যবস্থা গৃহীত হয়। কিন্তু এই প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা জার্মানিকে চিরতরে পঙ্গু করতে পারেনি, বরং এনেছিল আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ। সে নিয়ে কথা হবে অন্য এক লেখায়।