জাতীয়

শরিকদের ছাড় দিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ে গলদঘর্ম দুই জোট

By Daily Satkhira

November 24, 2018

রাজনীতির খবর: ১৪ দল এবং মহাজোটের নতুন দুই শরিক এইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা) ও অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ত সময় পার করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ১৪ দলের কোনো কোনো শরিক দলের এবং জাপা ও যুক্তফ্রন্টের নেতারা দফায় দফায় দৌড়াচ্ছেন গণভবনে। কেউ কেউ ছুটছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে। শরিকদের প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার সমন্বয় ঘটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে। বিশেষ করে বেশকিছু আসনে দলীয় প্রার্থী ও শরিকদের চাওয়ার মূল্যায়ন করতে গিয়ে রীতিমতো অগ্নিপরীক্ষার অবস্থা। আওয়ামী লীগ, ১৪ দল ও মহাজোটের শরিকদের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে সর্বশেষ যে বার্তা পাওয়া গেছে তা হলো আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলের শরিকদের বড় ধরনের কোনো মতপার্থক্য নেই। মূল ঝামেলা হচ্ছে এরশাদ ও তার দলকে নিয়ে। অন্যদিকে, বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা ও যুক্তফ্রন্টের চাওয়ার সঙ্গে বাস্তবের হিসাব মেলাতেও বেগ পেতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে।

শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে জটিলতা হচ্ছে কি-না, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘দর কষাকষি হলেও কোনো ধরনের টানাপড়েন নেই। এখানে বানরের পিঠা ভাগ করে তো লাভ নেই। সবকিছু আমাদের (আওয়ামী লীগের) নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। এখানে কে কত সিটে জিততে পারবে, এটাই হলো আমাদের প্রাইম কনসিডারেশন। যারা ইলেক্টেবল, উইনেবল, তাদেরই আমরা সিলেক্ট করব।’ জোটের আসন ভাগাভাগি চূড়ান্ত হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে তিনি বলেন, মৌখিকভাবে হয়েছে। শরিকদের কত আসন দেওয়া হতে পারে সেই প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটা আমি একটা অনুমান করতে পারি। আমি বারবার বলেছি প্রার্থীকে ইলেক্টেবল হতে হবে, উইনেবল হতে হবে। সেক্ষেত্রে শরিকদের ৬৫-৭০টি আসন ছাড়া হতে পারে, ২/৪টা হয়তো বাড়তেও পারে।’

ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের আরও একাধিক দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলীয় ও জোট শরিকদের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ মূল যে বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে তা হলো-যেই আসনে যাকে প্রার্থী করা হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারবে তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। ১৪ দলের শরিকদের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মোটামুটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে- বড় ধরনের ও যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়া শরিকদের যারা বর্তমানে যেই যেই আসনে সংসদ সদস্য রয়েছেন তাদেরকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। এর বাইরে ১৪ দল শরিকদের কারও কারও অন্য শক্তিশালী প্রার্থী থাকলে সেক্ষেত্রেও ছাড় দিতে প্রস্তুত আওয়ামী লীগ। সবমিলিয়ে আসন বণ্টন নিয়ে ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য কোনো সমস্যা নেই দলটির।

আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে ১৪ দলকে নিয়ে তেমন সমস্যা না হলেও এরশাদের জাপাকে নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। বর্তমান দশম সংসদে জাপা ৩৪টি আসনে জয়ী হলেও এখন দলটি আওয়ামী লীগের কাছে ৫০টি আসন চায়। যদিও মূল টার্গেট অন্তত ৪৫টি আদায় করা। এই পর্যন্ত ৪০ থেকে ৪২টি আসনের বিষয়ে মোটামুটি সমঝোতা হলেও মানতে চাচ্ছেন না এরশাদ। সমঝোতার বাইরে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আরও পাঁচটি আসন চাচ্ছেন আওয়ামী লীগের কাছে। এনিয়ে গতকাল শুক্রবার রাত পর্যন্ত কোনো ফয়সালা হয়নি।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়ে জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ, কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার মিলে একটা উদ্যোগ নিলেও এরশাদ তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই তিন নেতাকে এরশাদ জানিয়ে দিয়েছেন, প্রার্থী চূড়ান্ত করার বিষয়ে তিনি একাই সিদ্ধান্ত নেবেন। জানা গেছে, জাপা চেয়ারম্যান তার বারিধারার বাসায় ব্যক্তিগত দু’তিন জন লোককে নিয়ে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছেন। এতে তার একক পছন্দ-অপছন্দই প্রাধান্য পাচ্ছে। জিএম কাদের গতকাল বলেন, ‘প্রার্থী বাছাইয়ের কাজটা উনি (এরশাদ) একাই করছেন। কী করছেন জানি না।’

এদিকে, বিকল্পধারা প্রেসিডেন্ট ও যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান অধ্যাপক বি. চৌধুরী মঙ্গলবার গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে ২২ জনের তালিকা দিয়ে এসেছেন। যুক্তফ্রন্টের টার্গেট অন্তত ১০টি আসনে ছাড় পাওয়া। তবে বি. চৌধুরীর চাহিদার সঙ্গে বাস্তবতার হিসাব মেলাতে পারছে না আওয়ামী লীগ। বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান জানান, যারা নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারবেন বিকল্পধারা তাদের নামই প্রস্তাব করেছে, এক্ষেত্রে কোনো অযৌক্তিক দাবি করা হচ্ছে না।

তালিকা চূড়ান্ত করতে বেগ পেতে হচ্ছে বিএনপিকে

আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে এসে বেগ পেতে হচ্ছে নীতি নির্ধারকদের। এক দশক ধরে নির্বাচন না করায় এবং জোটের পরে ঐক্যফ্রন্টের সাথে আসন ভাগাভাগির নতুন সংযুক্তির কারণে প্রার্থীর সংখ্যা অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়েছে। কাকে রেখে কাকে দিবে মনোনয়ন- এনিয়ে বেশ অস্বস্তি চলছে । আবার অনেক আসনে দলের পুরানো সংসদ সদস্যের ইন্তেকাল ও বয়সজনিত অক্ষমতার কারণে সেখানে নতুন মুখের ছড়াছড়ি। সবাই চান প্রার্থী হতে। ইতোমধ্যে বিএনপির প্রায় তিন হাজার প্রার্থীর সাক্ষাত্কার সম্পন্ন করেছেন দলের পার্লামেন্টারী বোর্ড সেখানে কাউকে সবুজ সংকেত দেয়নি। কিংবা কেউ রেড সিগন্যালের আভাসও পাননি। ফলে সবাই আশাবাদী। তবে কেউ নিশ্চিত নন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্ভাব্য প্রার্থীদের শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন। একজনকে দল প্রার্থী করবে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে তার পক্ষে কাজ করা ও দলের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। তাদেরকে যে বার্তাগুলো দেওয়া হচ্ছে তা হলো-১. ফাঁকা মাঠে গোল নয়, ২. ভোট কেন্দ্র পাহারা, ৩. ধানের শীষ যার হাতে, পক্ষ তারই, ৪. বিদ্রোহী হলে কঠোর ব্যবস্থা, ৫. বলা মাত্র মনোনয়ন প্রত্যাহার।

স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের সাথে আসন বণ্টন নিষ্পত্তির পর বিএনপির প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করে ঘোষণা দেয়া হবে। এক্ষেত্রে আওয়ামীজোট কাকে কোন আসনে প্রার্থী করছে সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। তাদের প্রার্থীর ওজন বুঝে হেভিওয়েট না সাহসী তরুন প্রার্থী দেয়া হবে তা নির্ধারিত হবে।

দলটি গতকাল শরিকদের সাথে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বৈঠক করলেও চূড়ান্ত করতে পারেননি। জোট ও ফ্রন্টের নেতারা ইতোমধ্যে যে তালিকা দিয়েছে তাতে বিএনপির নীতি নির্ধারকরা বিস্মিত। দুই শতাধিক প্রার্থীর তালিকা পেয়েছেন তারা। সেখান থেকে কতজনকে বিএনপি ছাড় দিতে পারবে তা নিয়ে হিসাবে মেলাতে গলদঘর্ম অবস্থা নেতাদের। কারণ ৩০০ আসনেই বিএনপির যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন। সেখানে জামায়াত, এলডিপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য বড় ভাগ বসাতে চায়। দলের একজন নেতা বলেন, আমাদের সাথে আছে মোট ২৭ টি দল। ২০ দলীয় জোটের মধ্যে আছে ২৩ দল আর ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে আছে ৪ দল। এই জোটে মাঠের শক্তিতে বিএনপির পরেই জামায়াতের অবস্থান। তাদের সাথে আসন ভাগাভাগি নিয়ে জটিলতার চেয়ে কর্নেল অব.অলি আহমেদের এলডিপিকে নিয়ে আমাদের চিন্তা বেশি। কারণ তাদের দলে নির্বাচনী জয়ী হওয়ার মতো নেতার সংখ্যা মাত্র দুই জন। অথচ তারা প্রথমে ৩০ জনের একটি তালিকা জমা দেয়। পরে আমরা সংক্ষিপ্ত তালিকা চাইলে ১২ জনের নাম দিয়ে এখন কমপক্ষে ৮টি আসন চাচ্ছেন। এর মধ্যে কর্নেল অলি আহমেদ (চট্টগ্রাম-১৩) ও রেদোয়ান আহমেদকে (কুমিল্লা-৭) ছাড় দেয়ার কথা বললে তারা সেটা মানতে রাজি নন। জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী বিএনপির কাছে ৫০ জনের তালিকা দিয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে ৩৪ আসন দিয়েছিল বিএনপি। ২টি আসন ছিল ওপেন। সেই অনুপাতে তারা বলছেন, তারা গত দশ বছরে সবচেয়ে বেশী নির্যাতিত ও ত্যাগ স্বীকার করেও বিএনপির সাথে আছেন। ফলে তাদের চাহিদা এবার একটু বেশী। ২০০৮ সালের চেয়ে এবার বেশী আসনে বিএনপির কাছে ছাড় চায় জামায়াত। তবে বিএনপির দায়িত্বশীল একজন নেতা জানান, প্রার্থী তালিকা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে যেসব আসন দিয়েছিল এবারও সেখান থেকে জয়ী হওয়ার মতো আসনগুলোতে ছাড় দিতে পারে বিএনপি।

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ১২ আসনের তালিকা দিয়েছে। এর মধ্যে দলটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিমকে চট্টগ্রাম-৫ আসনটি ছাড় দেওয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিএনপিকে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। কারণ ওই আসনে বিএনপির একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাশী। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর নাসির, চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা ও কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য ওই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী।

জাতীয় পার্টির (জাফর) ১৬ জনের একটি তালিকা বিএনপির কাছে জমা দিয়েছে। পার্টির চেয়ারপারসন জয়া কাজী চান কুমিল্লা-১৪ (চৌদ্দগ্রাম) আসন। তবে ওই আসনে জামায়াতের হেভিওয়েট প্রার্থী ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরও মনোনয়ন চাইছেন। জাগপা তিনটি আসনের তালিকা দিলেও মরহুম শফিউল আলম প্রধানের মেয়ে ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধানকে পঞ্চগড়-২ আসন দেওয়া হতে পারে।

ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বিজেপির চাওয়া তিনটি আসন। তবে ভোলা-১ আসনটি পার্থকে দেওয়া হবে এটি মোটামুটি নিশ্চিত। এ ছাড়া খেলাফত মজলিস ৪টি আসন দাবি করলেও তাদের একটিতে ছাড় দেওয়া হতে পারে।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের দুটি অংশ থেকে ৫ জন করে তালিকা দেওয়া হয়েছে। এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নড়াইল-২ থেকে নির্বাচন করতে চান। মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মেয়ে পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশের রীতা রহমান নীলফামারী-১ আসন চান।

ঐক্যফ্রন্টের দলগুলো চায় শতাধিক আসন। তার মধ্যে মাহমুদুর রহমান মান্না একাই চান ৩৫টি আসন। তবে মাহমুদুর রহমান মান্না (বগুড়া-২), এস এম আকরাম (নারায়ণগঞ্জ-৫) মনোনয়ন পেতে পারেন। গণফোরাম ও ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, মোস্তফা মহসিন মন্টু, জাসদের আসম আবদুর রবকে ছাড় দেয়া হবে এটা নিশ্চিত। আবদুল কাদের সিদ্দিকী একটি আসনে পাবেন। এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সংখ্যার ভিত্তিতে নয়; আসন বণ্টন হবে প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনার ভিত্তিতে। ১০ বছর আগে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে মারাও গেছেন। ফলে অনেক যাচাই-বাছাই করে এবার প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।

নজরুল ইসলাম খান বলেন,আসন ভাগাভাগিতে জোটের শরিকদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। ‘উইনেবল’ প্রার্থী হলে শরিকদের আসন ছাড় দিতে আপত্তি নেই আমাদের। জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা যার বেশি, তাকেই মনোনয়ন দিবে দল।