খোলা মত

মাছশূন্য হবে সুন্দরবন!

By daily satkhira

November 24, 2018

মো. আবদুস সালিম: বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম সুন্দরবন। তবে নানা প্রতিকূলতার কারণে দিন দিন বনের জৌলুস হারিয়ে যাচ্ছে। পশুপাখি, গাছপালা, মাছ… ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদও কমে যাচ্ছে। সার্বিক কারণ হল সেখানকার পরিবেশ ক্রমশ খারাপ হয়ে যাওয়া।

সম্প্রতি পরিবেশবাদীরা জানিয়েছেন, মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে সুন্দরবনের প্রায় ২৭ প্রজাতির মাছ। এর অন্যতম কারণ ওই এলাকার পানি ও মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি। আর লবণাক্ততা প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। তারা সম্প্রতি জানিয়েছেন, সুন্দরবন এলাকায় প্রতি বছর লবণাক্ততা বাড়ছে প্রায় ২ পিপিটি বা পার্টস পার ট্রিলিয়ন হারে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দুই বছরের বেশি সময় ধরে ৮০ প্রজাতিরও বেশি মাছের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন।

তারা জানতে পেরেছেন, প্রায় ২৭ প্রজাতির মাছ লবণাক্ততা খুবই কম সহ্য করতে পারে। মাছগুলো হল- শিং, মাগুর, টাকি, কাতল, কই, কাকিলা ও শোল মাছ। এ তালিকায় আরও আছে- কাটারি, বোয়াল, জাতপুঁটি, তিতপুঁটি, কানি পাবদা, গাচুয়া ও পাবদা মাছ। আর দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে তার তালিকাও তৈরি করেছেন তারা। এগুলো হল- মেনি মাছ, লোয়াচ, টেংরা, বাজারি টেংরা, বাটা, ফলি, কালিবাউস ও কেওড়া মাছ।

লবণাক্ততা বাড়ার কারণে বিরূপ প্রভাব পড়ছে মিঠা পানির মাছের ওপর। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় সোয়া ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা। শূন্য থেকে পাঁচ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে এ ২৭ প্রজাতির মাছ। এরা তার বেশি লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না।

মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে এসব মাছ থাকতে পারছে না সুন্দরবন এলাকায়। চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে অন্য জায়গায়। অর্থাৎ মাছের পরিমাণ দ্রুত কমে আসছে সুন্দরবনে। এরই মধ্যে কমে গেছে খুলনার পাইকগাছা এলাকায় মিষ্টি বা স্বাদু পানিতে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৫৯ শতাংশ মাছ।

আর প্রায় ২১ শতাংশ মাছ হ্রাস পেয়েছে বাগেরহাটের রামপালে। এসব এলাকায় লবণাক্ততা বেড়ে পাঁচ পিপিটিতে পৌঁছালে আর দেখাই যাবে না এসব মাছ। যেসব স্থানের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি, ওইসব এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত।

যেমন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে সাতক্ষীরা জেলার কয়েকটি স্থান থেকেও। শিবসা, পশুর নদসহ আরও কয়েকটি নদ-নদী থেকেও লবণাক্ততার মাত্রা পরিমাপ করা হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে সুন্দরবন এলাকায় পানির লবণাক্ততা কোন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে তা নিয়েও গবেষণা করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, লবণাক্ততার পরিমাণ বর্তমানের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি হতে পারে। তখন শুধু মিঠা পানির মাছই নয়, বরং অন্যান্য প্রাণীর ওপরও পড়বে এর চরম নেতিবাচক প্রভাব।

এখন প্রশ্ন হল কেন লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে? উত্তরে বলা যেতে পারে আমাদের নদ-নদীগুলোর প্রবাহ দিন দিন কমে যাচ্ছে, ভরাট হচ্ছে। যার কারণে সাগর থেকে লবণাক্ততা ওপর দিকে উঠে আসছে। এছাড়া বৈরী জলবায়ুর কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ওপরের দিকে লবণাক্ততা উঠে আসছে।

আর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে সুন্দরবনে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায়। এখন প্রশ্ন হল, তবে কি সুন্দরবন এলাকায় মাছ ঢুকবে না কিংবা সেখানে ঢুকলেও আবার চলে যাবে? এর উত্তর হল, কিছু সময়ের জন্য সুন্দরবনে মাছ এলেও এদের স্থায়িত্বকাল বেশি দিন হবে না।

এক দল গবেষক জানিয়েছেন, স্থানভেদে সুন্দরবন এলাকায় প্রতি বছর লবণাক্ততা বাড়ছে গড়ে ১ থেকে ১.৫ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম)। আবার সময় ও স্থানভেদে এর পরিমাণ ২ থেকে ২৮ পিপিএম। আর শীতের সময়ে তা হয় প্রায় ৩০ পিপিএম।

পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার মানে পাশাপাশি মাটির লবণাক্ততা বা স্যালাইনিটিও বেড়ে যাওয়া। এ কারণে মাটির লবণাক্ততা সমস্যা সমাধানকল্পে আগে প্রয়োজন পানির লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ করা। সুন্দরবন এলাকার পানির লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ করা মোটেই সহজ কাজ নয়।

কেননা লবণাক্ততার বিষয়টি জড়িত রয়েছে সাগরের লবণাক্ততার সঙ্গে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জমিতে লবণাক্ত পানি আটকে চিংড়ি চাষ করা হয়। এ কারণেও মাটির লবণাক্ততা বাড়ছে। কী কী কারণে লবণাক্ততা বাড়ছে সেই কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এরপর সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে লবণাক্ত এলাকায় থাকা পশুপাখির জন্য সুবার্তা বয়ে আনবে।

বর্ষাকালে লবণাক্ততার মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম থাকলেও এর হার অনেক বেশি থাকে ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত। গবেষণার ফলাফল থেকে জানা গেছে, ১৪ প্রজাতির মাছের লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে শূন্য থেকে ১০ পিপিটি পর্যন্ত।

২২ প্রজাতির মাছের রয়েছে প্রায় ২০ পিপিটি পর্যন্ত সহনীয় ক্ষমতা। আট প্রজাতির মাছের রয়েছে প্রায় ৩০ পিপিটি পর্যন্ত লবণ সহনীয় সক্ষমতা। প্রায় ৩৫ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে প্রায় চার প্রজাতির মাছ। মাছগুলো হল- হগনি, হরিণা চিংড়ি, কড্ডি চিংড়ি এবং বাগদা চিংড়ি। এমন এক খারাপ সময় হয়তো আসবে যখন মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে এদেরও পাওয়া যাবে না। সর্বোচ্চ লবণাক্ততা সহ্য করতে সক্ষম ইলিশ মাছ। পোয়া মাছও প্রায় একই ধরনের লবণাক্ততা সহিষ্ণু। সুন্দরবন বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভর করছে প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা। মধু, মোম, ফল, কাঠ, মাছ, গোলপাতা, জ্বালানি ইত্যাদি সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার হল সুন্দরবন। বনটি অক্সিজেনেরও বিশাল ভাণ্ডার। আমাদের জন্য সুন্দরবনের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব যে কত বেশি তা বোঝা যেতে পারে আরও কয়েক দশক পড়ে; যদি এর পরিবেশকে স্বাভাবিক পর্যায়ের দিকে ফিরিয়ে আনা না যায়।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)