দেশের খবর: বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের চাকরিতে নিয়োগে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যায়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) বিরুদ্ধে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে অহেতুক সময় ক্ষেপণের অভিযোগ উঠেছে। আর নিয়োগে দীর্ঘসুত্রিতার কারণে জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে লাখো বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীর। ২০১৬ সাল থেকে এই নিয়োগ বন্ধ থাকায় শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীরা আজ বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। ৩ টি কারণে নিয়োগ শুরু হচ্ছে না বলে নিবন্ধন সনদধারীদের অভিযোগ। ১. এনটিআরসি এ তথা সরকার পক্ষের নিয়োগ দেওয়ার সদিচ্ছার অভাব। ২. শিক্ষা প্রতষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের শিক্ষক নিয়োগে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার লোভ। এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে সুবিধা আদায় করা। ৩. নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্য করার জন্য মামলা ও রিট করে নিয়োগ ঠেকিয়ে রাখা।
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যায়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো বাংলাদেশের প্রায় ৩৩০০০ (তেত্রিশ হাজার) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিৎ করা।
২০০৫ সালে একটি বিশেষ আইনের মাধ্যমে ‘এনটিআরসিএ’ গঠন করা হয়। ২০০৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই সংস্থার অধীনে একটি বিশেষ নিবন্ধনসহ মোট ১৪ টি নিবন্ধন পরীক্ষা হয়। ১৪ তম নিবন্ধন পরীক্ষার চূড়ান্ত রেজাল্ট এখনও প্রকাশ হয়নি। ১-১৩ তম নিবন্ধন পরীক্ষায় সনদপ্রাপ্তদের মোট সংখ্যা ৬ লাখ ৪ হাজার ৬৮৫ জন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির হাতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষমতা থাকায়, দুর্নীতির মাধ্যমে ঘুষ নিয়ে অযোগ্য শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছিলো। বিষয়টি সরকারের নজরে এলে ২০১৫ সালে একটি বিশেষ আইনের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির ক্ষমতা খর্ব করে শূন্যপদে এনটিআরসিএ-র মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্বান্ত নেওয়া হয়।
২০১৬ সালের ৬ জুন এনটিআরসিএ প্রথমবারের মত কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সময় ১-১২ তম শিক্ষক নিবন্ধনকারীদের থেকে নিয়োগের আবেদন নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে টেলিটকের মাধ্যমে ই রিকুইজিশনের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে শূন্যপদের চাহিদা সংগ্রহ করে এনটিআরসিএ। জানা যায় এ শূন্যপদের চাহিদার সংখ্যা ছিলো প্রায় ১৫০০০ টি। এনটিআরসিএ পৃথক পৃথক প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি পদের বিপরীতে নিয়োগের আবেদনে টেলিটকের মাধ্যমে ১৮০ টাকা করে জমা নেয়। এ সময় ৯২ হাজার শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারী প্রায় ১৪ লাখ আবেদন করেছিলো। এবং প্রকৃত পক্ষে নিয়োগ পেয়েছিলো ১৩০০০ জনের মত শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারী।
অনেক নিবন্ধন সনদধারী এ সময় ম্যানেজিং কমিটির বিরোধিতা এবং নারী কোটার কারণে নিয়োগ পাননি। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সৃষ্ট পদে এনটিআরসিএ-র সুপারিশকৃতদেরকে জোরপূর্বক নিয়োগ দেওয়ায় অনেক সুপারিশকৃত নিবন্ধন সনদধারী নিয়োগ পেয়েও এখনও এমপিও পায়নি।
২০১৬ সালের নিয়োগে থানা কোটা, জেলা কোটা, বিভাগীয় কোটা ও জাতীয় মেধাকোটা প্রয়োগ হওয়ায় অনেক বেশি নাম্বারপ্রাপ্ত নিবন্ধন সনদধারী নিজ থানায় পদ খালি না থাকায় নিয়োগ পাননি।
বেশি নাম্বার পেয়ে সনদপ্রাপ্ত মেধাবীরা নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায়, নিয়োগ বঞ্চিতরা শাহবাগ ও প্রেসক্লাবসহ বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলায় বেশ কয়েকটি মানববন্ধন,সংবাদসম্মেলন ও আন্দোলন করেছে। পরে ১-১২তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাশ করে সনদপ্রাপ্ত হয়েও নিয়োগ বঞ্চিতদের একাংশ আদালতে রিট দায়ের করে। পৃথকভাবে প্রায় ২০৫টির মত রিট হয়। দীর্ঘ শুনানি শেষে বিচারপতি রেজাউল ইসলাম ও বিচারপতি মুহাম্মদউল্লাহ এর সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ ১৬৬টি মামলা ফিক্সড করে ৭ টি পয়েন্ট সম্বলিত একটি ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন।
রায়ের ৭ টি পয়েন্ট নিম্নরূপ: ১) নিয়োগ পাওয়া পর্যন্ত শিক্ষক নিবন্ধন সনদের মেয়াদ থাকবে। সনদের নিদির্ষ্ট কোনো মেয়াদ থাকবে না।
২) রায়ের কপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে এনটিআরসিএ-কে শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের নিয়ে একটি সম্মিলিত জাতীয় মেধাতালিকা নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
৩) নিয়োগে কোনো থানা বা জেলাকোটা থাকবে না। সম্মিলিত জাতীয় মেধাতালিকার মাধ্যমে শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের নিয়োগের সুপারিশ করতে হবে।
৪) প্রতিবছর নতুনদের নিয়ে এনটিআরসিএ সম্মিলিত জাতীয় মেধাতালিকা আপডেট করবে।
৫) এনটিআরসিএ সম্মিলিত জাতীয় মেধাতালিকা অনুসারে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রিটকারী ও অন্যান্য প্রত্যাশিত আবেদনকারীদের নাম নিয়োগের উদ্দেশ্যে প্রস্তাব ও সুপারিশ করবে।
৬) নিয়োগের সুপারিশকৃত নিবন্ধনধারীদেরকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি ৬০ দিনের মধ্যে নিয়োগ প্রদানে ব্যর্থ হলে উক্ত ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৭) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বয়সসীমা নির্ধারণ নেই। সরকারের উচিৎ অতি দ্রুত বয়স নির্ধারণ করা।
১৪ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সালে হাইকোর্ট ডিভিশন এই রায় দিলেও রায়ের কপি বের হতে সময় লাগে ৩ মাস ২০ দিন। এরপর এনটিআরসিএ তালবাহানা করতে করতে ১০জুলাই, ২০১৮ তারিখে তাদের ওয়েবসাইটে ১-১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় সনদপ্রাপ্তদের নিয়ে একটি সম্মিলিত জাতীয় মেধাতালিকা প্রকাশ করে।
এ সম্মিলিত জাতীয় মেধাতালিকা অসুসারে নিয়োগ দেওয়ার জন্য গত ২৬ শে জুলাই, ২০১৮-তে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দুই দফা সময় বৃদ্ধি করে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ই-রিকুইজিশনে মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে শূন্যপদের চাহিদা নেয়া হয়। জানা যায় এর মাধ্যমে এনটিআরসিএ ৪০ হাজারের বেশি শূন্যপদের চাহিদা পেয়েছে।
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এনটিআরসিএ-র ওয়েবসাইটে শূন্যপদের চাহিদা প্রকাশ ও গণ নিয়োগবিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কথা থাকলেও তারা তালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ করছে। কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করলে বলে, এই মাসের শেষে, সামনের মাসের শুরুতে বা মাঝামাঝিতে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিবে। নির্বাচনের সাথে নিয়োগের কোনো সম্পর্ক নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।
ওদিকে, শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীরা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আশায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় আছে। তাদের কাছে প্রতিটি দিন যেন এক একটি বছরের সমান মনে হচ্ছে। নিয়োগ প্রত্যাশী শিক্ষক নিবন্ধনধারীদের হতাশা ও আবেগের কোনো মূল্য এনটিআরসিএ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রায় ২ মাস এনটিআরসিএ-র চেয়ারম্যান বদল নিয়েও জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় নাটক করেছে। ১৮ ই সেপ্টেম্বর এনটিআরসিএ-র চেয়ারম্যান আজাহার হোসেনকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়। তার স্থলে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব প্রদান করা হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র খান মুহাম্মদ বেলালকে। কিন্তু খান মুহাম্মদ বেলাল দায়িত্ব নিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় ৪ অক্টোবর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব প্রদান করা হয় সেকায়েপের সাবেক পরিচালক মো. মাহমুদুল হককে।
এরপর ১৬ ই অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় জাতীয় রাজস্ববোর্ডের সদস্য এস এম আশফাক হোসেনকে এনটিআরসিএ-র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব প্রদান করে। তবে তিনি তখন লন্ডনে ট্রেনিংয়ে ছিলেন। ফলে দায়িত্ব বুঝে নেননি। ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান মো. মাহমুদুল হকও বিদেশ গমন করেন। ফলে ৩ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় এনটিআরসিএ-র সদস্য নাসির আহমদকে। ১২ই নভেম্বর এসএম আশফাক হোসেন এনটিআরসিএ-র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব বুঝে নেন।
এসএম আশফাক হোসেন বলেন, ‘নিয়োগ নিয়ে কিছু প্রার্থীর পক্ষ নিয়োগ পাওয়ার জন্য নানা ধরনের মামলার কারণেই আসলে নিয়োগ দিতে দেরি হচ্ছিলো। আদালত স্থগিতাদেশ দিলে তো আর আমাদের কিছু করার থাকে না। তবে মামলাগুলোর রায় হয়ে গেছে। আর রায়গুলো আমাদের অনুকুলেই রয়েছে। আর আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই আমরা ১৫তম নিবন্ধর পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দিবো। এবং এরপর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।’ তিনি জানান প্রায় ৪২ হাজারের বেশি শূন্যপদ নিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছে।
শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের একটি অংশ মেধাতালিকায় যাদের অবস্থান অনেক পিছনে তারা নিয়োগ পাবেনা জানে বলেই অন্য শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের নিয়ে রিট ব্যবস্যা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই চক্র নিয়োগের স্বপ্নে বিভোর হতাশাগ্রস্থ শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এবং তাদেরকে মামলার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ার ভুয়া স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
প্রার্থীদের আরো অভিযোগ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের প্রতি পদের আবেদনে ১৮০ টাকা করে জমা দেওয়াটাও তাদের পক্ষে সম্ভব না। বিষয়টি নিয়ে এনটিআরসিএ-কে তাদের অনুরোধ, ‘আমরা বেকার। বেকারদের কাছ থেকে এতো টাকা আবেদন ফি হিসেবে না নিয়ে যেন চয়েজ সিস্টেমে আবেদন নেয়া হয়।’