অনলাইন ডেস্ক: ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ তথা ব্রেক্সিটবিষয়ক খসড়া চুক্তিতে ইইউ নেতাদের চূড়ান্ত অনুমোদনের লক্ষ্যে শনিবার বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। কিন্তু জিব্রাল্টার ইস্যুতে মতামত দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত না হলে ইইউর আজকের সম্মেলনে অংশ না নেওয়ার হুমকি দিয়েছে স্পেন। ইইউর এই সদস্য দেশ সম্মেলনে অংশ নিক বা না নিক, তাতে ব্রিটেনের এ জোট ছাড়ার ইতিহাস সৃষ্টি আটকাবে না বলে জানায় সংবাদমাধ্যমগুলো।
ইউরোপীয় কূটনীতিকরা জানান, আজ রবিবার ইইউর সম্মেলনে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে নতুন কোনো উল্লেখযোগ্য আলোচনা হবে না। দেড় বছর ধরে ইইউ নেতাদের সঙ্গে ব্রিটেন আলোচনা করে যে খসড়া চুক্তি দাঁড় করিয়েছে, আজ তাতে সম্মতি দেওয়াই সম্মেলনের লক্ষ্য। এর পরও চূড়ান্ত কথাবার্তার জন্য ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জ্যঁ ক্লদ জাংকার এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্কের সঙ্গে বসছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মে। ব্রেক্সিট চুক্তিতে আজ সব ইইউ নেতার সমর্থন পেলে আগামী ২৯ মার্চ থেকে তা কার্যকর হবে।
ব্রেক্সিট নিয়ে এমন এক চূড়ান্ত মুহূর্তে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ হুমকি দিয়েছেন, জিব্রাল্টার ইস্যুতে দাবি পূরণ না হলে তিনি আজকের সম্মেলনে যোগ দেবেন না। কিউবা সফররত এ স্প্যানিশ নেতার দাবি, ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর জিব্রাল্টার ইস্যুতে স্পেনকে ভেটো প্রদানের ক্ষমতা দিতে হবে এবং এ ইস্যুতে সরাসরি লন্ডনের সঙ্গে আলোচনা করার অধিকার দিতে হবে। উল্লেখ্য, ব্রিটিশদের অধীনে থাকা জিব্রাল্টার নিজেদের বলে দাবি করে স্পেন। এ বিতর্কের জেরে স্পেন আজকের ইইউর সম্মেলন বর্জন করলে তাতে জোটের অন্য নেতাদের ব্রেক্সিট চুক্তিতে অনুমোদন প্রদান আটকাবে না। কিন্তু বিষয়টি বাকি ইইউ সদস্যদের জন্য বিব্রতকর হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগের মুহূর্তে বাকি সদস্যরা নিজেদের ঐক্যবদ্ধতা প্রমাণ করতে চায়।
এ মুহূর্তে স্পেনের বক্তব্য যা-ই হোক, ইউরোপীয় জোট ত্যাগ করে ইতিহাসে ছাপ ফেলতে যাচ্ছে ব্রিটেন। কারণ তারাই প্রথম জোটত্যাগী। ইতিহাস সৃষ্টির এ লগ্নে ঠিক কী কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা দেখে নেওয়া যাক—
ব্রেক্সিটবিষয়ক দুই নথি: জোট ত্যাগের জন্য ব্রিটেন দুটি আলাদা নথি প্রস্তুত করেছে। এর একটিতে রয়েছে আইনি বাধ্যবাধকতার বিস্তারিত বিবরণ। ৫৮৫ পৃষ্ঠার এ নথিতে ইইউর সঙ্গে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের মতো প্রায়োগিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব বিষয় ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। তবে এ সময়সীমা ২০২২ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে।
রাজনৈতিক ঘোষণাসংবলিত দ্বিতীয় নথি মাত্র ২৬ পৃষ্ঠার। এতে অর্থনীতি, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র, আইন, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইইউ-ব্রিটেন সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এসব ব্যাপারে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।
ইইউ নেতাদের ভাবনা: ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তবে ইইউর বাকি সদস্যরা মনে করে, ব্রিটেনের জোট ছাড়া সিদ্ধান্ত কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এক ঐতিহাসিক ভুল। তাদের অভিমত, জোট ছাড়ার পর বাকিদের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক আগের চেয়ে খুব একটা ভালো পর্যায়ে যাবে না।
মের কাছে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের গুরুত্ব: জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাখোঁর মতো প্রভাবশালী ইইউ নেতাদের সম্মতি আদায় করে ব্রেক্সিট কার্যকর করা আন্তর্জাতিক বিচারে মের জন্য গুরুত্বপূর্ণই বটে। তাই বলে স্বদেশি রাজনীতিকদের সম্মতি আদায় করার গুরুত্ব কোনোভাবেই কম নয়, বরং এটাই তাঁর জন্য অনেক বড় এক চ্যালেঞ্জ। নির্মম হলেও সত্য, তাঁর খসড়া ব্রেক্সিট চুক্তি ব্রেক্সিটপন্থী ও ব্রেক্সিটবিরোধী কারোরই তেমন পছন্দ নয়। নীতিগতভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ের প্রতি এত অনাস্থা সৃষ্টির ঘটনা ব্রিটেনের ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল। ফলে সামনের মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ব্রেক্সিট ইস্যুতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে ভোটাভুটি হওয়ার কথা, তাতে মের খসড়া ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদন পাবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি পাস না হলে: ভোটাভুটিতে খসড়া ব্রেক্সিট চুক্তির ভবিষ্যৎ যদি নেতিবাচক হয়, তবে সেখানেই বিষয়টি থেমে যাবে, তা নয়। পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বেশ কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। এই যেমন—ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে পার্লামেন্ট সদস্যরা (এমপি) একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হতে পারেন কিংবা খসড়া চুক্তিতে পরিবর্তন আনা হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে, কয়েক সপ্তাহ পর মে ওই একই চুক্তির ওপর আবার ভোটাভুটির আয়োজন করতে পারেন এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থার কথা বিবেচনা করে এমপিরা হয়তো তাতে সম্মতি দিয়ে দিতে পারেন। ইইউর সঙ্গে কোনো রকম চুক্তি ছাড়াই ব্রিটেনের জোট ত্যাগের সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া ব্রেক্সিট চুক্তির ওপর গণভোটের আয়োজন কিংবা চূড়ান্ত বিপর্যয় হিসেবে ব্রিটেনে আগাম সাধারণ নির্বাচনের আশঙ্কাও তাঁরা করছেন।
মের প্রতি রাজনীতিক ও ভোটারদের সহানুভূতি: ব্রেক্সিট চুক্তির মতো জটিল বিষয় ধৈর্যের সঙ্গে সামাল দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী মের প্রতি বিরোধী রাজনীতিকদের পর্যন্ত এক ধরনের সহানুভূতি ও প্রশংসার দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে—এমনটা মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। ওই সব রাজনীতিকের মতো অনেক ভোটারের মনেও মের ব্যাপারে এক ধরনের গোপন প্রশংসা কাজ করছে। জরিপ বলছে, খসড়া ব্রেক্সিট চুক্তি তাদের পছন্দ নয়, কিন্তু অন্য কোনো নেতা এর চেয়ে ভালো কিছু করতে পারতেন বলেও তারা মনে করে না। মের প্রস্তাবিত চুক্তির ব্যাপারে তারা গণভোটে অংশ নিতে বেশি আগ্রহী বলে জরিপে দেখা গেছে। সূত্র : এএফপি, বিবিসি।