বিদেশের খবর: ইউক্রেইনে ৬০ দিনের জন্য ‘মার্শাল ল’ বা সামরিক আইন জারি করতে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কো। তবে আদেশটি কার্যকর হওয়ার জন্য পার্লামেন্টের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে।
প্রেসিডেন্টের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে সোমবার একথা জানানো হয়েছে। রাশিয়া অধিকৃত ক্রিমিয়ার কের্চ প্রণালীতে ইউক্রেইনের তিনটি জাহাজ জব্দ করার জেরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট এ সামরিক আইন জারির উদ্যোগ নিলেন। রাশিয়া ‘বিনা উস্কানিতে পাগলের মত আচরণ করেছে’ বর্ণনা করে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট পোরোশেঙ্কো সামরিক আইন জারি সংক্রান্ত এ ডিক্রি সই করার কথা জানান। তবে এর অর্থ যুদ্ধ ঘোষণা নয় বলেও জোর দিয়ে বলেছেন তিনি। নতুন করে যুদ্ধে জড়ানোর পরিকল্পনা ইউক্রেইনের নেই বলে জানান পোরোশেঙ্কো।
রোববার ক্রিমিয়া উপকূলে ইউক্রেন নৌবাহিনীর তিনটি জাহাজ আটক করেছে রাশিয়া। জাহাজগুলো জব্দ করার আগে সেগুলোর দিকে গুলি ছুড়ে বেশ কয়েকজন ইউক্রেনীয় নাবিককে আহত করেছে রুশ নিরাপত্তা বাহিনী।
ইউক্রেইনের জাহাজগুলোকে আটকাতে রাশিয়া প্রায় ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কৃষ্ণ সাগর থেকে আজোভ সাগরে জাহাজ চলাচলের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। এজন্য তারা ক্রিমিয়ার কাছের কের্চ প্রণালীর সেতুর নিচে ট্যাংকার ফেলে রেখেছিল। ইউক্রেইনের জাহাজ আটকের পর সোমবার সকালে রাশিয়া সেতুর নিচ থেকে ট্যাংকার সরিয়ে নেয়। ২০১৪ সালে ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের পর থেকেই দুই প্রতিবেশী দেশ মুখোমুখি অবস্থানে আছে। কৃষ্ণ সাগর থেকে আজোভা সাগরে জাহাজ চলাচল নিয়েও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। যদিও নৌযানের অবাধ চলাচলের জন্য ২০০৩ সালে সম্পাদিত দুই দেশের একটি দ্বিপাক্ষিত চুক্তি আছে। সম্প্রতি রাশিয়া নিরাপত্তার অজুহাতে ইউক্রেইন থেকে রওয়ানা হওয়া বা ইউক্রেইনগামী সব জাহাজে নজরদারি শুরু করেছে।
ইউক্রেইন সরকারের অভিযোগ, রাশিয়া আজোভ সগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের অর্থনীতি ধ্বংস করতে চাইছে। আজোভ সাগরে বেরদিয়ানস্ক ও মারিউপোল নামে ইউক্রেইনের গুরুত্বপূর্ণ দুইটি সমুদ্রবন্দর আছে।
গত সেপ্টেম্বরে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, তার দেশের মোট রপ্তানি রাজস্বের একচতুর্থাংশ আসে মারিউপোল বন্দর থেকে। জাহাজ জব্দ করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর কিয়েভে রুশ দূতাবাসের সামনে অন্তত দেড়শ বিক্ষোভকারী জড় হয়। তারা দূতাবাসের দিকে জ্বলন্ত বস্তু ছুড়ে মারে, তাতে দূতাবাস প্রাঙ্গনে থাকা অন্তত একটি গাড়িতে আগুন ধরে যায়।
ইউক্রেইন তাদের আটক নৌজাহাজগুলো ফেরত চেয়েছে এবং নাবিকদের মুক্তি দাবি করেছে। একইসঙ্গে রাশিয়াকে শাস্তি দিতে দেশটির ওপর নতুন করে আরো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া এবং এরই মধ্যে বহাল থাকা নিষেধাজ্ঞাগুলো আরো কঠোর করার জন্য ইউক্রেইন এর পশ্চিমা মিত্রদেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে। ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর সোমবার নেটো জরুরি বৈঠক ডেকেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক ও কানাডা এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে।
ইউক্রেইনে সামরিক আইন জারি হলে সরকার যেকোনো ধরনের বিক্ষোভ দমনের ক্ষমতা পাবে। গণমাধ্যমকে নজরদারি, নির্বাচন স্থগিত করা এবং নাগরিকদের সামরিক ঘাঁটিতে কাজ করতে বাধ্য করতে পারবে।
যদি পার্লামেন্ট মার্শাল ল জারির অনুমতি দেয় তবে ২০১৪ সালে ইউক্রেইন-রাশিয়ার সংঘাতের পর আবার সামরিক আইন জারির ঘটনা ঘটবে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে হামলা চালিয়ে এর ক্রিমিয়া উপদ্বীপ অধিগ্রহণ করে রাশিয়া। যার জেরে দেশটির দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে রুশপন্থি বিদ্রোহীদের সঙ্গে ইউক্রেইন সেনাবাহিনীর লড়াই শুরু হয়। ওই যুদ্ধ ১০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েৎ ইউনিয় ভেঙ্গে যাওয়ার পর ইউক্রেইন স্বাধীনতা লাভ করে। পশ্চিমা সমর্থন পুষ্ট ইউক্রেইনে হুমকি বলে মনে করেন রাশিয়া।
রোববার কী ঘটেছিল? অবৈধভাবে জলসীমায় প্রবেশের অভিযোগ তুলে রোববার অধিকৃত ক্রিমিয়া উপকূলে ইউক্রেন নৌবাহিনীর দুইটি গানবোট এবং একটি টাগবোট আটক করে রাশিয়া। জাহাজগুলো জব্দ করার আগে সেগুলোর দিকে গুলি ছুড়ে বেশ কয়েকজন ইউক্রেনীয় নাবিককে আহত করেছে রুশ নিরাপত্তা বাহিনী।
এর আগে রাশিয়া কৃষ্ণ সাগর থেকে আজোভ সাগরে জাহাজ চলাচল আটকাতে ক্রিমিয়ার কাছের কের্চ প্রণালী বন্ধ করে দিয়েছিল। কের্চ প্রণালীর ওপরের সেতুটি রাশিয়ার মূলভূখণ্ডের সঙ্গে অধিকৃত ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করেছে। কৃষ্ণ সাগর থেকে ইউক্রেইনের কোনো জাহাজ আজোভা সাগরে যেতে হলে এই সেতুর নিচ দিয়েই যেতে হয়।
এ নিয়ে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়। শুরুতে ইউক্রেইন রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের নৌযানে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগ তোলে। জবাবে রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, আগে থেকে না জানিয়ে তাদের জলসীমায় গানবোট পাঠিয়ে ইউক্রেইন ইচ্ছা করে ‘যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি’ করেছে।
তাদের জাহাজগুলো কোনো আইন ভঙ্গ করেনি দাবি করে রাশিয়া ‘সামরিক আগ্রাসন’ চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ইউক্রেন। রাশিয়াকে শাস্তি দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে তারা। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কো সামরিক বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পোরোশেঙ্কো জানিয়েছেন, দেশে সামরিক আইন জারির জন্য পার্লামেন্টের কাছে প্রস্তাব রাখবেন তিনি।
ক্রিমিয়াকে নিজেদের সীমান্তভুক্ত করে নেওয়া ও ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলে মস্কোপন্থি বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়াকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেইনের সম্পর্ক আগে থেকেই নাজুক হয়ে আছে, এর মধ্যে এ ঘটনা দেশ দুটিকে বৃহত্তর সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে বলে ধারণা পর্যবেক্ষদের।