রাজনীতির খবর: আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা শেষ হলেও প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পারেনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। শরিকদের সঙ্গে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে গিয়ে দু’দলই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে।
দলের পাশাপাশি জোটের শরিকদের আসন ভাগাভাগি নিয়েও সমঝোতায় পৌঁছতে পারছেন না তারা। দফায় দফায় আলোচনায় বসেও সমাধান আসছে না। শরিকদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে উভয় দলের হাইকমান্ড।
তাদের চাহিদার সঙ্গে বাস্তবতার মিল না থাকায় কঠিন সংকটে পড়েছেন নীতিনির্ধারকরা। ফলে শরিক দলগুলো দলীয়ভাবেই মনোনয়ন জমা দিয়েছে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত এ ব্যাপারে সমঝোতার চেষ্টা চলবে। শেষ পর্যন্ত সমাধান হলে একজন রেখে বাকিদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু বাস্তবে ছাড়কৃত আসন বাদে অন্যগুলো থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
আইনি সমস্যা এবং আসন সমঝোতা না হওয়ায় অনেক আসনে এখন মহাজোটের একাধিক প্রার্থী। কোথাও নৌকার বিরুদ্ধে নৌকা। আবার কোথাও নৌকার বিরুদ্ধে শরিক দলের প্রতীক। প্রার্থী প্রত্যাহারের সময়সীমার আগেই এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আশায় বুক বাঁধছেন মহাজোটের একাধিক নেতা।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের ১৩টি আসনে ছাড় দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এর মধ্যে কয়েকটি আসনে নৌকার প্রার্থীকেও মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এ নিয়েও শরিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টও প্রত্যাশিত আসন পায়নি। তাদের দুটি আসনে ছাড় দেয়া হয়। তবে যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে সারা দেশে ৫১টি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হয়েছে।
একই অবস্থা বিএনপির ক্ষেত্রেও। মাঠের বিরোধী দলটি দুটি জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট। উভয় জোটের শরিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও আসন বণ্টন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি।
এ অবস্থায় কোনো ঝামেলায় না গিয়ে শরিকদের চাহিদামতো মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত চিঠিও দেয়া হয়। শরিকরা যার যার মতো করে মনোনয়নপত্র জমা দেয়।
শরিকদের মধ্যে যেসব দল নিবন্ধিত তাদের কেউ কেউ নিজেদের প্রতীকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। জানা গেছে, ২০ দলের শরিকদের সর্বোচ্চ ৪০-৪৫টি আসনে ছাড় দিতে পারে বিএনপি। কিন্তু জোটের শরিকরা মনোনয়নপত্র জমা দেয় প্রায় একশ’ আসনে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, শরিকদের যোগ্য ও উইনেবল প্রার্থী দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আমরাও (আওয়ামী লীগ) যারা যোগ্য তাদের মনোনয়ন দিয়েছি।
জয় নিশ্চিতে যেখানে যে প্রার্থীর দরকার আমরা মহাজোটগতভাবে সে সিদ্ধান্তই নেব। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২০ দলীয় জোটের শরিক ও ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আসন নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। এ নিয়ে কোনো সংকট হবে না। সময় স্বল্পতার কারণে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগে আসন ভাগাভাগি চূড়ান্ত করা হয়নি। আশা করি প্রত্যাহারের আগে এ ব্যাপারে আমরা একটা সমঝোতায় আসতে পারব।
সমঝোতা না হওয়ায় অধিকাংশ আসনে একাধিক প্রার্থী মহাজোটের : মনোনয়ন নিয়ে জটিলতা কাটেনি আওয়ামী লীগের। দলীয় প্রার্থীর আইনি সমস্যা আর মহাজোটের আসন সমঝোতা না হওয়ায় বেশিরভাগ আসনে এখন একাধিক প্রার্থী।
আইনি জটিলতার কারণে ১৪টির মতো আসনে একাধিক প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। শাসক দলের প্রার্থী হিসেবে চাঁদপুর-২ আসন থেকে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও নূরুল আমিন রুহুল মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। চাঁদপুর-৪ আসন থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান বুধবার মনোনয়নপত্র জমা দেন। এ আসনে প্রথমে মনোনয়নপত্র দেয়া হয় বর্তমান সাংসদ মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়াকে। তিনিও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
ঢাকা-৭ আসনে সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমেরও আইনি জটিলতা রয়েছে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন। এজন্য হাজী সেলিমের পাশাপাশি বিকল্প প্রার্থী হিসেবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাতকেও দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। ঢাকা-১৭ আসনে চিত্রনায়ক ফারুক ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাদের খান মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এ আসনে মহাজোট শরিক বিএনএফের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এক আসনে মহাজোটের এত প্রার্থী জটিলতা সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন নেতারা।
এদিকে মহাজোটের শরিকদের অনেক আসনে আওয়ামী লীগও প্রার্থী দিয়েছে। কুড়িগ্রাম-১ আসনে আসলাম হোসেন সওদাগর, কুড়িগ্রাম-৩ আসনে এমএ মতিন এবং কুড়িগ্রাম-৪ আসনে মো. জাকির হোসেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এদিকে আওয়ামী লীগের আসন বরিশাল-২ এ প্রার্থী হয়েছেন শাহে আলম। একই আসনে মহাজোটের শরিক দলের প্রার্থীও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। জোটের আসন ভাগাভাগি শেষ না হওয়ায় দলগতভাবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিকরা।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, ৩০০ আসনের মধ্যে ৫১টিতে দলীয় মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে মহাজোটের শরিক যুক্তফ্রন্ট। মহাজোটগতভাবে এখনও কোনো আসন পায়নি এ জোট।
তবে জোটের মুখপাত্র মাহী বি. চৌধুরীকে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়ন নিশ্চিত বলে জানা গেছে। মহাজোটের শরিক বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ৬২টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। মহাজোটগত সমঝোতা না হলেও এসব প্রার্থী এবার নির্বাচন করবে বলে জানিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ।
১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ৩৩টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। মহাজোট থেকে আসন পেয়েছে ৫টি। বর্তমান এ দলের এমপির সংখ্যা ছয়। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগেই প্রত্যাশিত আসন সমস্যার সমাধান হবে বলে বৃহস্পতিবার জানান দলটির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হাসান বাদশা।
১৪ দলের শরিক গণতন্ত্রী পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা হয়নি বলে জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ডা. সাহাদৎ হোসেন। নির্বাচনে এ দল ১০টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। তরিকত ফেডারেশন মহাজোট থেকে ২টি আসন নিশ্চিত করেছে। নির্বাচনে ২৫টি আসনে প্রার্থী দেয়ার কথা জানিয়েছেন দলের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। প্রধানমন্ত্রী চাইলে এসব আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
জাতীয় পার্টি (জেপি) ১৯টি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। বর্তমান সংসদে ২টি আসন থাকলেও এবারের জন্য এখন পর্যন্ত একটি আসন নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আগেই আসন সমঝোতা হবে বলে বিশ্বাস দলটির সাধারণ সম্পাদক শেখ সহিদুল ইসলামের।
৫১টি আসনে দলীয় মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-ইনু)। জোটের আসন বণ্টনে দলটিকে ৩টি আসন নিশ্চিত করা হয়েছে। সামনে আরও পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানান দলের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আকতার। মহাজোটে নতুন অন্তর্ভুক্ত জাকের পার্টি ১০৬টি আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছে। মহাজোটের পক্ষ থেকে ফরিদপুর-২ আসনটি দেয়ার কথা থাকলেও তা নিশ্চিত করা হয়নি। একইভাবে ১৪ দলীয় জোটের অন্য শরিকরাও নিজেদের মতো করে বিভিন্ন আসনে দলীয় মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে।
২০ দলীয় জোট : আসন নিয়ে জোটের শরিকদের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয়নি। শরিকদের মধ্যে নিবন্ধিত দলগুলো তাদের প্রতীকে প্রার্থিতা জমা দিয়েছে। যেসব দলের নিবন্ধন নেই সেগুলো ধানের শীষের পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেয়।
জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীকে ২৫টি আসনে ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু দলটির ধানের শীষের প্রতীকে ২৫টি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। স্বতন্ত্র হিসেবে আরও ২০ আসনে তারা প্রার্থী দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদের সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, আমরা ৪৫টি আসনে মনোয়নপত্র জমা দিয়েছি। জোটের পক্ষ থেকে আমাদের ২৫টি আসনে ছাড় দেয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি আসন আমাদের চাহিদা রয়েছে। তাই কৌশলগত কারণে আমরা বেশ কয়েকটি আসনে স্বতন্ত্র মনোনয়পত্র জমা দিয়েছি। চূড়ান্ত সমঝোতা হলে বাকিগুলো প্রত্যাহার করা হবে।
জানা গেছে, আসন সমঝোতা না হওয়ায় যে যার মতো করে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। জোটের শরিকদের যেসব আসনে ছাড় দেয়া হয়েছে এর মধ্যে অনেক আসনে বিএনপির প্রার্থীও রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও জোটের দুই শরিককে ছাড় দেয়া হয়েছে। পিরোজপুর-২ আসনে জোটের শরিক জামায়াতের শামীম সাঈদী ও লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরানকে ধানের শীষে মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাকে ছাড় দেয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
জোটের আরেক শরিক এলডিপি ১০টি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের তিনটি আসন দেয়া হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এলডিপি চাচ্ছে ন্যূনতম ৫টি আসন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দরকষাকষি চলছে। খেলাফত মজলিসের পক্ষ থেকে ১৭টি আসনে মনোনয়পত্র জমা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিএনপি তাদের মাত্র একটি আসনে ছাড় দিয়েছে। এটা জানার পরও তারা অনেকগুলো আসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছে মূলত বার্গেনিং করার জন্য। জোটের শরিক জাগপা দলীয়ভাবে সাতটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে একটির বেশি আসন ছাড় দেয়া হবে না।
এ প্রসঙ্গে জাগপার সাধারণ সম্পাদক খন্দকার লুৎফর রহমান জানান, আমরা দলীয়ভাবে সাতটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। বিএনপি যে ক’টি আসনে ছাড় দেবে সেগুলো রেখে বাকি আসনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা হবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট : জানা গেছে, বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সর্বোচ্চ ২০টি আসনে ছাড় দেয়া হতে পারে। এ নিয়ে ফ্রন্টের শরিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও কোনো সমঝোতা হয়নি। শেষপর্যন্ত যার যার মতো করে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হয়। ফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্য নয়টি আসনে ধানের শীষ নিয়ে মনোনয়ন জমা দিয়েছে। তবে চূড়ান্তভাবে এ দলটিকে সর্বোচ্চ দুটি আসনে ছাড় দেয়া হতে পারে। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সারা দেশে দলীয়ভাবে ৪০টি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত কাদের সিদ্দিকীকে সর্বোচ্চ ২-৩টি আসনে ছাড় দেয়া হতে পারে।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের যুগ্ম-সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, দলীয় ভাবে আমরা ৪০টি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। তবে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক বিএনপির সঙ্গে যেসব আসনে সমঝোতা হবে সেগুলো রেখে বাকিগুলো প্রত্যাহার করা হবে।
ফ্রন্টের আরেক শরিক জেএসডি দলীয়ভাবে ৬০টি মনোনয়পত্র জমা দিয়েছে। তবে তাদের সর্বোচ্চ দুটি আসনে ধীনের শীষ দেয়া হতে পারে। এ প্রসঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, ফ্রন্টের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে বাকি আসনের মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হবে।
গণফোরামের পক্ষ থেকে সারা দেশে শতাধিক আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে গণফোরাম ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রার্থীদের সর্বোচ্চ ১৫টি আসনে ছাড় দেয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে।