দেশের খবর: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দলটির হাইকমান্ড বলছে-মামলার কারণে কেউ অংশ না নিতে পারলে কোনো আসনে যেন দলের প্রার্থী শূন্য না থাকে, সে জন্য প্রতিটি আসনে বিকল্প প্রার্থী রাখা হয়েছে। কিন্তু বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া নেতারা বলছেন-এভাবে ঢালাও মনোনয়ন দিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করা হয়েছে। একই আসনে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হলেও মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন অনেক পোড় খাওয়া নেতা। অনেকে মনোনয়ন পেয়েও নির্বাচন করছেন না। এ নিয়ে দলটিতে চলছে নানা গুঞ্জন।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্তত তিন সদস্য এবার ভোট করছেন না। ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যেও কেউ কেউ নির্বাচন করছেন না। কেউ কেউ মনোনয়নই পাননি। ভোটে না থাকার তালিকায় রয়েছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টারাও। বাদ নেই যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের নেতারাও।
ভোটে না থাকা নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ মনোনয়ন পাননি। কেউ কেউ মনোনয়ন পেয়েও নির্বাচন করছেন না, কাঙ্ক্ষিত আসন না পাওয়ায়। আবার কেউ মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেও শেষ পর্যন্ত জমা দেননি।
এমন নেতার মধ্যে রয়েছেন-দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.)মাহবুবুর রহমান, নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ। রয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, গাজীপুরের সাবেক মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নান। ভাইস চেয়ারম্যান এজেডএম জাহিদ হোসেন মনোনয়ন পেলেও সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় ভোট করতে পারছেন না।
চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যে নির্বাচন থেকে দূরে রয়েছেন-অধ্যাপক মামুন আহমেদ। আমানউল্লাহ আমান ও মশিউর রহমান মনোনয়ন পেলেও হাইকোর্টের রায়ে নির্বাচন করতে পারছেন না।
যুগ্ম মহাসচিবদের মধ্যে রয়েছেন-রুহুল কবির রিজভী, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও হাবিব-উন নবী খান সোহেল। তারা সবাই একাদশ সংসদ নির্বাচনে দর্শক। বিএনপির রাজনীতিতে তারা সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। দলের সংকটে সামনে থেকে নেতাকর্মীদের আগলে রেখেছেন। এদের বেশিরভাগেরই নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাকিরা আগে নির্বাচন না করলেও এবার করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। দলের চার সহসাংগঠনিক সম্পাদকও মনোনয়ন নিয়ে ক্ষুব্ধ। তারা হলেন-মাহবুবুল হক নান্নু, আ ক ন কুদ্দুসুর রহমান, সেলিমুজ্জামান সেলিম ও মাশুকুর রহমান। মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন-সাবেক সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমদ (লক্ষ্মীপুর-১) ও হারুন অর রশিদও (চাঁদপুর-৪)। তারা দুজনই ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত হন।
দলের মনোনয়নপত্র নেননি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, নজরুল ইসলাম খান, রুহুল কবির রিজভী। মনোনয়নপত্র তুলেও নির্বাচন করছেন না যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব-উন নবী খান সোহেল। আবার সাবেক এমপিসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েক নেতাকে মনোনয়নই দেয়া হয়নি। নজরুল ইসলাম নির্বাচন না করলেও তাকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
যে কারণে ভোটে নেই মাহবুবুর রহমান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. মাহবুবুর রহমানও নির্বাচন করছেন না। তিনি দিনাজপুর-২ আসন থেকে দুবার দলের মনোনয়ন পান। একবার সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন। নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়; তাই নির্বাচন করছি না।
নজরুল ইসলাম খান স্থায়ী কমিটির এই নেতার নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। তবু শোনা যাচ্ছিল স্বাভাবিক নির্বাচন হলে তিনি এবার জামালপুরের একটি আসনে নির্বাচন করতে পারেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়ে উঠল না। তিনি বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ কক্সবাজার থেকে নির্বাচন করেন। তার আসনে স্ত্রী হাসিনা আহমেদকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলায় ভারতের আদালতে খালাস পেলেও তিনি এখনও দেশে ফিরতে পারেননি। এ কারণে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি।
আবদুল আউয়াল মিন্টু নির্বাচন না করা প্রসঙ্গে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, আমার কখনই নির্বাচন করার শখ ছিল না। পরিবারের মধ্যে আমার বাবা-ভাই নির্বাচন করেছেন। অতীতে আমি কখনও নির্বাচনে অংশ নিইনি। এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। দলের নেতাকর্মী-সমর্থকরা গ্রেফতার-মামলা ও হয়রানির মুখে পড়ছেন প্রতিনিয়ত।
এ রকম অবস্থায় আমি মনে করছি-নির্বাচনে অংশগ্রহণের চেয়ে নির্বাচন পরিচালনায় আমার সময় ও অবদান রাখা উচিত। সে জন্য দলের বৃহত্তর স্বার্থে আমি নির্বাচন না করে দলের নির্বাচনী কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কারণ নির্বাচন পরিচালনায় দলে এখন পর্যাপ্ত ও অভিজ্ঞ লোকজনের অভাব রয়েছে। সে জন্য আমি মনে করছি-দলের এ রকম গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নির্বাচন করার চেয়ে নির্বাচনী কাজে সময় ও শ্রম দেয়া জরুরি। তিনি বলেন, দলও মনে করে যে নির্বাচন পরিচালনার কাজে আমি সম্পৃক্ত থাকি। আমার মনোনয়নপত্র দাখিল নিয়ে যেসব খবর গণমাধ্যমে আসছে তা সঠিক নয়। এ নিয়ে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি মহল।
অধ্যাপক এমএ মান্নান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এমএ মান্নান চেয়েছিলেন গাজীপুর-২ আসন থেকে নির্বাচন করতে। গত সিটি নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত মান্নানকে সংসদ নির্বাচনও মূল্যায়ন করা হয়নি। তবে তার ছেলে মঞ্জুরুল আলম রনিকে যৌথভাবে ওই আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।
রিজভী রুহুল কবির রিজভীর রয়েছে শক্ত রাজনৈতিক পটভূমি। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। ‘৯০-এর গণআন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ছিলেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি। রুহুল কবির রিজভী বহুদিন ধরে বিএনপির কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি এর আগে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ছিলেন। পরে যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। দলের সংকটময় মুহূর্তে রিজভী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের বার্তা সারা দেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে পৌঁছে দেন। মাসখানেক টানা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তার থাকার ইতিহাসও রয়েছে। রিজভী কুড়িগ্রাম কিংবা রাজশাহীর একটি আসন থেকে নির্বাচন করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে নেই। মনোনয়নপত্রই সংগ্রহ করেননি।
নির্বাচন না করার বিষয়ে রিজভী গণমাধ্যমকে বলেন, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে এবং তারেক রহমানকে নির্বাসিত রেখে তিনি নির্বাচন করবেন না। এ ছাড়া বর্তমান ‘একনায়কতান্ত্রিক’ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে লড়াই করছে। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন তিনি করবেন না।
আলাল যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের রাজনৈতিক হাতেখড়ি ছাত্রদলের রাজনীতি দিয়ে। পরে তিনি যুবদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে প্রায় এক দশক সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল একজন সুবক্তা হিসেবে পরিচিত। টিভিতে টকশোয় দলের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। গত এক দশকে তার বিরুদ্ধে অন্তত ১০০ মামলা হয়েছে। বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে। তবু হাল ছাড়েননি। আলাল ২০০৮ সালে মোহাম্মদপুর-আদাবর আসন থেকে নির্বাচন করেন। এবার বরিশাল-৫ আসন থেকে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু দল তাকে মনোনয়ন দিয়েছে বরিশাল-২ আসন থেকে। তিনি মনোনয়নপত্র জমা দেননি।
বরিশাল-২ আসনে এবার আলালের পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সরফুদ্দিন সান্টুকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আর আলালের কাঙ্ক্ষিত আসনে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপির আরেক যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার। মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ভোটে না থাকার রহস্য কি? দলীয় মনোনয়ন পেয়েও কেন তিনি নির্বাচন করছেন না তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা কথা হচ্ছে।
কেউ কেউ বলছেন, কাঙ্ক্ষিত আসন বরিশাল-৫ (সদর) আসনে মনোনয়ন না পাওয়ায় নাখোশ হয়েছেন আলাল। কারণ তিনি আগেই বলে রেখেছিলেন-ওই আসনে দলীয় মনোনয়ন না পেলে ভোট করবেন না।
অনেকে বলছেন, বরিশাল-৫ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী সরোয়ার। ওই আসনে মনোনয়ন দৌড়ে সরোয়ারের কাছে হেরে যাওয়াটাকে মেনে নিতে পারছেন না আলাল। তাই হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়ে ভোট থেকেই সরে দাঁড়িয়েছেন।
তবে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন ভিন্নকথা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নির্বাচন করতে পারছেন না। তাদের একজন কারাবন্দি, অন্যজন নির্বাসিত। এমতাবস্থায় জাতীয়তাবাদী আদর্শের একজন কর্মী হিসেবে তিনি নির্বাচন করতে পারেন না।
আলালের ভাষ্য-‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান তারা আমাদের জাতীয়তাবাদী শক্তির মূল অনুপ্রেরণার উৎস ও উজ্জীবনী শক্তি। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারলে আমিও সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী নই। এ জন্যই আমি মনোনয়নপত্র দাখিল করিনি।’
সোহেল হাবিব-উন নবী খান সোহেলের রাজনৈতিক পটভূমি খুবেই সুদৃঢ়। তিনি ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। পরে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হিসেবে সারা দেশে এ অঙ্গ-সংগঠনকে মজবুত ভিত্তি দেন। সোহেল বিএনপির তরুণ প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয়। দলের পোড় খাওয়া নেতাদের মধ্যে তিনি একজন। তিনি ঢাকার রাজনীতিতে সক্রিয়। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি পদে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। এসব মামলায় তিনি এখনও কারাবন্দি।
সোহেল ২০০৮ সালে ঢাকা-৮ আসন থেকে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। এবারও ওই আসন থেকেই তার পক্ষ হয়ে মেয়ে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু বিএনপির হাইকমান্ড তাকে অন্য আসন দিতে চেয়েছিল। তাই তিনি নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সোহেল কারাবন্দি থাকায় এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে সোহেলের মেয়ে জান্নাতুল ইলমি সূচনা এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন ফেসবুকে। সেখানে তার বাবার মনোনয়ন সম্পর্কে ইলমি লেখেন- ‘এমন না যে তাকে আসন দেয়া হয়নি। একাধিক আসনের প্রস্তাব ছিল। কিন্তু আমাদের দাবিতে আপসহীন ছিলাম। যোগ্যতার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে।’