জাতীয়

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গি কার্যক্রম: নির্বাচনি ডামাডোলে মধ্যে হামলার পরিকল্পনা

By Daily Satkhira

December 13, 2018

দেশের খবর: নির্বাচনি ডামাডোলের মধ্যে জঙ্গি হামলার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। বর্তমানে সৌদি আরব ও মালোশিয়া প্রবাসী দুই ব্যক্তির অর্থায়নে জেএমবি তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। তারা এরই মধ্যে সহযোগিতা কার্যক্রমের আড়ালে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অন্তত ৪০ জন রোহিঙ্গাকে নিজেদের দলে ভিড়িয়েছে। নির্বাচনের সময় ‘টার্গেট কিলিং’ এবং কক্সবাজারে থার্টি ফার্স্ট নাইটের কোনও একটি অনুষ্ঠানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের।

বুধবার (১২ ডিসেম্বর) রাতে রাজধানীর কমলাপুর থেকে তিন জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানতে পারে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলো- জেএমবির কক্সবাজারের আঞ্চলিক প্রধান আব্দুল হাকিম, চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক প্রধান নোমান ও সাধারণ সদস্য শফি। তাদের কাছ থেকে ৩০টি কমান্ডো নাইফ, একটি চাপাতি, ৩০টি এক্সপ্লোসিভ কনটেইনার ও দেড় কেজি বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। এই তিন জনের বিরুদ্ধে শাহজাহাপুর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

জানা যায়, শুধু জেএমবিই নয় বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলোও জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। চলতি মাসেই নিষিদ্ধ ঘোষিত আরেক জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর ঢাকার একাধিক স্থানে প্রকাশ্যে মিছিল করে নির্বাচন ও গণতন্ত্রবিরোধী স্লোগান দিয়েছে ও লিফলেট বিলি করেছে। এছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষিত আরেক জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামও টার্গেটেড কিলিংয়ের পরিকল্পনা করছিল। চলতি সপ্তাহে এই সংগঠনের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যারা জঙ্গিবাদবিরোধী চলচ্চিত্র পরিচালনা ও অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত খিজির হায়াত খানকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক পন্থাকে ‘কুফরি মতবাদ’ বলে মনে করে। একারণে নির্বাচনকে বানচাল বা বাধাগ্রস্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। এছাড়া নির্বাচনের সময় যেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনকেন্দ্রীক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, এই তারা এই সময়কে তাদের ভাষায় ‘বিশেষ সুযোগ’ হিসেবে দেখে থাকে। বুধবার গ্রেফতার হওয়া তিন জঙ্গি জানিয়েছে, জেএমবির সামরিক কমান্ডার আহনাফের নির্দেশনায় তারা কক্সবাজারের থার্টি ফার্স্ট নাইটের যে কোনও একটি অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করা এবং নির্বাচনের সময় টার্গেট করে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। এজন্য তারা একসঙ্গে এতগুলো কমান্ডো নাইফ ও বিস্ফোরকদ্রব্য এবং আইইডি কন্টেইনার সংগ্রহ করেছিল।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা আরও বলছেন, এই প্রথম এতগুলো কমান্ডো নাইফ একসঙ্গে উদ্ধার করা হলো। টার্গেটেড কিলিংয়ে জঙ্গিরা এসব কমান্ডো নাইফ ব্যবহার করে, যাতে হত্যাকাণ্ডের সময় শব্দ না হয়। এসব কমান্ডো নাইফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শরণার্থীদের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে সংগ্রহ করেছে বলে গ্রেফতার ব্যক্তিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালের অক্টোবরে ঢাকার গাবতলী ও আশুলিয়ায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার পর যেসব কমান্ডো নাইফ উদ্ধার করেছিল পুলিশ, সেসবের সঙ্গে মিল রয়েছে নতুন করে উদ্ধার করা কমান্ডো নাইফের। উদ্ধার হওয়া আইইডি কন্টেইনারগুলো দিয়ে হাতে তৈরি গ্রেনেড প্রস্তুত করা হয়। নব্য ও পুরাতন এই দুই ধারার জেএমবি সদস্যরা বহুদিন ধরে এসব কন্টেইনার ব্যবহার করে বিস্ফোরকদ্রব্য তৈরি করে আসছিল।

এ ব্যাপারে সিটিটিসির স্পেশ্যাল অ্যাকশন গ্রুপের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘জেএমবি আঞ্চলিকভাবে সংগঠিত হয়ে হামলার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে তারা রোহিঙ্গাদের অর্থ সহযোগিতার মাধ্যমে সিমপ্যাথি আদায় করে নিজেদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত। আমরা এই গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদের বিষয়েও অনুসন্ধান চালাচ্ছি।’

এ বিষয়ে সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে জেএমবির এই গ্রুপটিকে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছে মালয়েশিয়া ও সৌদি প্রবাসী দুই ব্যক্তি। ইতোমধ্যে এই দুই ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারীর ব্যক্তিটি কক্সবাজারের স্থানীয়। তিনি বহুদিন ধরে জেএমবিকে নেপথ্যে থেকে পরিচালনা করতেন। তদন্তের স্বার্থে পুলিশ তার নাম প্রকাশ করেনি। আর সৌদি আরব প্রবাসী ওই ব্যক্তির নাম আব্দুর রাকিব। একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সৌদি প্রবাসী জঙ্গি অর্থায়নকারী ব্যক্তিটি বাংলাদেশে জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তিনি মদিনা ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছেন। বহুদিন ধরে অবস্থান করছেন সৌদি আরবে। সম্প্রতি তিনি দেশে এসে কিছুদিন থাকার পর আবার সৌদি আরবে ফিরে যান। শায়খ আব্দুর রহমানও একসময় সৌদি আরবে লেখাপড়া করেছেন। দেশে ফিরে তিনি জেএমবি নামে জঙ্গি সংগঠন যাত্রা করেছিলেন, ২০০৬ সালে গ্রেফতারের পর এক বছরের মধ্যে বিচার শেষে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ ও অর্থ সাহায্যের আড়ালে তারা নিজেদের সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ করে আসছিল। ইতোমধ্যে প্রায় এক কোটি টাকা এই কাজে খরচ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অন্তত ৪০ জন জঙ্গি সদস্য তারা রিক্রুট করেছে। যাদের মাধ্যমে নির্বাচনি ডামাডোলের মধ্যে টার্গেট কিলিং ও হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। গ্রেফতার হওয়া সিএনজি চালক আড়ালে জঙ্গিবাদি কার্যক্রম চালাত। আহনাফ নামে জেএমবির সামরিক কমান্ডারের হাত ধরে জঙ্গিবাদে পথচলা শুরু হয় তার।

জঙ্গি প্রতিরোধে নিযুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ‘কক্সবাজারে আহলে হাদিসের পরিচালনায় একটি ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। এই সেন্টারের মাধ্যমে আহলে হাদিস মতবাদ প্রচার করা হয়।’ এ প্রসঙ্গে সিটিটিসির স্পেশ্যাল অ্যাকশন গ্রুপের অতিরক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আহমেদুল ইসলাম বলেন, ‘‘জেএমবির এই গ্রুপটি নিজেদের হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ শুরু করেছিল। জঙ্গিরা আবার এক হয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা তাদের নিয়মিত নজরদারি করছি।’